রমজানের শুরুতেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় নাকাল ভোক্তারা
রমজান শুরুর মাত্র দুইদিন আগে, রোববার (১০ মার্চ) বেসরকারি চাকরিজীবী শফিকুল ইসলাম একটু সাশ্রয়ের খোঁজে কারওয়ানবাজার থেকে রোজায় প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা করছিলেন। তিনি পেঁয়াজ কিনেছেন ৯০ টাকা কেজি দরে, যা বাংলামোটরে তার বাসার পাশের মুদি দোকানে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোলা, ডাল, আদা, রসুন, মুরগিসহ নানান পদের কেনাকাটায় কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা করে সাশ্রয় করতে পেরেছেন তিনি।
শফিকুল বলেন, "সব পণ্যের দাম এত চড়া যে কেজিতে ৫-১০ টাকার সাশ্রয়ও আমার মত সীমিত আয়ের মানুষের জন্য অনেক বড় কিছু। এজন্যই কষ্ট করে এই বাজারে আসা।"
রমজান ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে শফিকুলের অবস্থা তার মতো সীমিত আয়ের লোকেদের দৈনন্দিনের বাজার খরচ মেটানোর সংগ্রামকে তুলে ধরে। গত রমজানের তুলনায় এ বছর রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় ৮টি পণ্য যেমন– পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর, গরুর মাংস, রসুন এবং আলুর দাম ৪ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) মাধ্যমে সারাদেশের এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে তেল, চিনি, ডালের মত পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম, মনিটরিং, চাঁদাবাজি বন্ধের ঘোষণা, ট্যাক্স ছাড় দিয়ে চিনি, খেজুর আমদানির সুযোগ, স্বল্প মূল্যে মাংস, দুধ ডিম, মাছ বিক্রির উদ্যোগ থাকার পরও বড় একটি ভোক্তা শ্রেণিকে এসব নিত্যপণ্যের জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এর বাইরে ডিম, তেল, ব্রয়লার মুরগির দামও বেশ চড়া, যেগুলোর ওপর মানুষের নির্ভরতাও বেশি।
টিসিবির বাজার বিশ্লেষণে ঢাকার খুচরা ও পাইকারি বাজারের তথ্য বলছে– পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, মশুর ডাল, খেজুর ও গরুর মাংসের দাম গত রোজার তুলনায় বেশি। এরমধ্যে পেঁয়াজ কিনতে ১৫০%, ছোলা কিনতে ২২%, চিনিতে ২১%, ডালে ১০%, একেবারেই সাধারণ মানের খোলা খেজুর কিনতে ৭%, গরুর মাংস কিনতে ৪%, রসুন কিনতে ৩৮% এবং আলু কিনতে ৭৫% বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
এর বাইরে গত বছরের রোজা শুরু হওয়ার আগের দিনে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ২৩০-২৫০ টাকার মধ্যে। ৭-১০ দিন আগেও যে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ২১০ টাকার মধ্যে, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা কেজি দরে। ব্রয়লার মুরগির এক হালি ডিমের দাম একই সময়ের ব্যবধানে ৪৭ টাকা থেকে কমে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অঙ্কের হিসেবে কম মনে হলেও প্রকৃত চিত্র বলছে দাম চড়া।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, "পরিবহনে বেপরোয়া চাদাবাজি এবং রোজা কেন্দ্রিক মিডলম্যানদের বাড়তি মুনাফার কারণে দামটা বেড়ে যাচ্ছে। এ সময় বাড়তি চাহিদার কারণেও বাজারে একটা চাপ তৈরি হয়।"
গরুর মাংসের দাম শুধুমাত্র রোজাকে উপলক্ষে ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেলের দাম গত বছর ছিল ১৮৫ টাকা, যা দুই দফায় কমে এখন ১৬৩ টাকা লিটার হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পর অনেক চাপাচাপিতে এইটুকু সাশ্রয়। খোলা চিনি নিয়ে হইচই গত বছরও ছিল, তখন দাম ছিল ১২০ টাকা। এবারে চিনি নিয়ে হইচইয়ের কমতি নেই, শুল্ক ছাড়ও দেওয়া হয়েছে আমদানিতে। কিন্তু দাম ১৪৫ টাকা, অর্থাৎ এখানেও বাড়তি খরচ ২১%।
এই যে খরচের চাপ, ভোক্তা সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে– বিষয়টি স্বীকারও করেছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। রোববার টাউনহল মার্কেটে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, "পেশাজীবী মানুষেরা বেশি চাপ বোধ করছেন। কারণ একটি নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে তাদের চলতে হয়।"
তিনি বলেন, "তাদেরকে সুবিধা দিতে সরকার ন্যায্য মূল্যের দোকান চালুর চিন্তা করছে। সেটি কীভাবে করা সম্ভব, কীভাবে করলে সবাই সমান সুবিধা পাবে– তা নিয়ে আমরা ভাবছি। তবে এখন সরকারের কাছে অগ্রাধিকার হলো, বাজার নিয়ন্ত্রণ।"
তবে প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, দুই একটা জিনিসের দাম বেশি থাকলেও বাজারে অস্থিরতা নেই। দৌড়ঝাঁপ নয়, আলাপ আলোচনায় বিষয়টির সমাধান সম্ভব।
একই দিনে রমজানকে সামনে রেখে শিল্পগোষ্ঠী টি কে গ্রুপের সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান অবশ্য খেজুরের দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, "খেজুরের দাম বেড়েছে, সরকার তা নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দাম বেধে দিতে বাধ্য হবে।"
পাইকারি বাজারে গত বছর রোজায় ৯০-১১০ টাকা দামের খেজুর এবারে ১৪০-১৫০ টাকা, যা খুচরা বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারের ২০০ টাকার খেজুর ৪৮০ টাকায় এবং ৩০০-৩৫০ টাকার খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়।
রোজায় এ পণ্যটি ৪০-৫০ হাজার মেট্রিক টন চাহিদা রয়েছে এবং বছরের এই এক মাসে খেজুরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পণ্যটির ব্যবসাও এই এক মাস কেন্দ্রিক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, এই মাসে প্রায় ৩ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে দেশে, যা অন্য মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া, অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদাও এই সময় বেড়ে যায়, যার ফলে দামও বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, "সরকারের পদক্ষেপ অনেক, কিন্তু সেটার ইফেক্ট কতটা বাজারে পড়ছে, আদৌ সেটা পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা সেটা দেখতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ব্যবসায়ীদের এই অভ্যাস দূর করা সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "এখন বাইরে থেকে পেঁয়াজ এনে টিসিবি তাদের পণ্যের সঙ্গে পেঁয়াজ দিতে পারতো তাহলে কিন্তু পেঁয়াজের বাজার কমে আসতো, কিন্তু সেই উদ্যোগ নেই। এভাবে করে ইফেক্টিভ উদ্যোগ নেওয়াটা জরুরি।"
চট্টগ্রামে অস্থির কাঁচাবাজার
ইফতার আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ বেগুন, শসা, লেবু, কাঁচামরিচ, গাজর ও ধনিয়াপাতা। ফাল্গুন মাসে ক্ষেত থেকে বাজার– কোনো পর্যায়েই এসব কাঁচাপণ্যের সংকট থাকার কথা না। কিন্তু রমজানের আগ মুহূর্তে বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
ক্রেতারা বলছেন, রমজানের আগ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় সব কাঁচাপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বিক্রেতারা।
তবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন- রমজানকে ঘিরে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত সব পর্যায়ে কাঁচা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় সব কাঁচাবাজারে গতকাল সোমবার (১১ মার্চ) প্রতিকেজি বেগুন ৭০-৮০ টাকা, শসা ১০০-১২০ টাকা, ক্ষিরা ৭০-৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০-১২০ টাকা, গাজর ৮০-১০০ টাকা, ধনিয়া পাতা ১৬০-২০০ টাকা, এবং লেবু এক ডজন ১৫০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অথচ গত দুইদিন আগেও এসব পণ্যের মধ্যে বেগুন ৩০-৫০ টাকা, শসা ৪০-৫০ টাকা, ক্ষিরা ৩০-৪০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০-৬০ টাকা, গাজর ২৫-৪০ টাকা, ধনিয়া পাতা ৪০-৮০ টাকা, এবং লেবু এক ডজন ৬০-১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।