রেস্তোরাঁর অনুমোদন নিতে চান? লাল ফিতের দুঃস্বপ্নের জন্য প্রস্তুত!
গত চার বছর ধরে রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের গাউছিয়া টুইন পিক ভবনে প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জ রেস্তোরাঁ ব্যবসা করে আসছিলেন মো. আবুল আহসান আনোয়ার। নানান ভোগান্তি পোহানোর পর সিটি কর্পোরেশন, ডিসি অফিস, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, কল কারখানা অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ ১৩টি সংস্থা থেকে সনদ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি।
এসব সনদ নিতে তার ঘুরতে হয়েছে ৩ থেকে ৪ মাস। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে উপঢৌকন দিয়েও দ্রুত সময়ের মধ্যে কয়েকটি সংস্থার সনদ নিতে হয়েছে।
আবুল আহসান আনোয়ার দ্য বিজিনেস স্টয়ান্ডার্ডকে বলেন, "আমি একে একে ১৩টি সংস্থা থেকে সনদ নিয়েছি। যার অধিকাংশ জায়গায়ই একই ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে। হাজারো ভোগান্তি পোহায়ে সনদ গ্রহণ করতে গেলে ব্যবসা করবো কখন?"
এরপরেও গত ৪ মার্চ তার রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে দেয় রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
"আমাদের কাছে একটি সংস্থা থেকেই প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জমা নিয়ে সবগুলো সংস্থা পর্যালোচনা করে সার্টিফিকেট দিতে পারে। তাহলে তো আমাদের এ ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। আর কাজ করতে গেলেই এদেশে টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না," যোগ করেন তিনি।
আবুল আহসান আরও বলেন, "আমরা এ ভবন বাণিজ্যিক হওয়াতেই রেস্টুরেন্ট করেছি। সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার আগে তিন ধাপে কর্মকর্তারা আমাদের রেস্টুরেন্ট ভিজিট করে গেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও ভিজিট করেছে। এমনকি, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের লোকজন এসেও ভিজিট করে সার্টিফিকেট দিয়েছে। এখন হুট করে এসে অবৈধ বললে আমরা কোথায় ব্যবসা করবো?"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান, বনানীতে অন্তত ৪টি রেস্টুরেন্টের এক মালিক টিবিএসকে বলেন, "রাজউকের কোনো গাইডলাইনেই উল্লেখ নাই যে কোন ধরনের ভবনে রেস্টুরেন্ট করা যাবে। তাই অধিকাংশ কমার্শিয়াল ভবনেই রেস্টুরেন্ট করা হয়। ১৩টি সংস্থার মধ্যে আমি ৭/৮টি সনদ নিতে পেরেছি প্রায় ২ বছর চেষ্টা করে। বাকি কয়েকটি সনদ আছে, যেগুলোর শর্ত পূরণ করে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব।"
"আমার অধিকাংশ সনদ গ্রহণ করতে ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। দালাল ধরে সনদ নিতে হয়েছে। কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও টাকা ছাড়া সনদ মেলে না। রাজউক, সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে কয়েকধাপে আমাকে টাকা দিতে হয়েছে," বলেন তিনি।
এ ভোগান্তি শুধু উল্লেখিত দুই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরই নয়। প্রায় ১৩টি সংস্থা থেকে সনদ নিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের প্রায় সবারই এসব ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা সনদ ও ছাড়পত্র যেন পেতে পারেন, এজন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তাদের দাবি, ব্যবসাবান্ধব নীতি ও স্মার্ট পদ্ধতি ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি অনেকটাই দূর করবে।
এদিকে, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্তব্যরত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক রেস্টুরেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ব্যবসায়ীরা সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই এসব রেস্টুরেন্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে।
যখন বিভিন্ন সংস্থা থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয় তখন কর্মরত কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ' করেই চলছে ঐসব রেস্টুরেন্ট।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৫,০০০ রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে। এরমধ্যে ৯৬ শতাংশ অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে।
এসব দোকানের অনেকেই সঠিকভাবে অনুমতি না নিয়েই রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছে বলে জানায় সরকারি অগ্নিনির্বাপক সংস্থাটি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বপা), বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার তথ্য বলছে– গত ৯ বছরে বাংলাদেশে ১,৯০,১৬৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে ১,০৫১ জন নিহত ও ৩,৬০৬ জন মানুষ আহত হয়েছেন।
সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটিতে যে আগুন লাগে, সেখানেও প্রায় সবগুলো ফ্লোরেই ছিল রেস্তোরাঁ; এবং আগুনের সূত্রপাতও হয়েছিল নিচতলার একটি রেস্তোরাঁ থেকে।
এছাড়া খিলগাঁও, ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় এমন বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক ভবনেই গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ কিংবা খাবারের দোকান।
তবে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে নিয়ম মেনে পরিচালিত রেস্টুরেন্টগুলোও বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়দের।
১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে গুলশান-১ এ মল্লিকা রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ৫টি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র আছে। এগুলো হলো– সিটি কর্পোশেনের ট্রেড লাইসেন্স, লেবার কোর্ট সনদ, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র, এনবিএর এর তরফ থেকে ভ্যাট এবং ইনকাম ট্যাক্স সার্টিিফিকেট।
"আমরা যতগুলো ছাড়পত্র সম্পর্কে জানি তার সবগুলোই সংগ্রহ করেছি। আজ প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ব্যবসা করছি। এখন শুনছি যে ১২-১৩টা সার্টিফিকেট লাগে," বলেন মল্লিকা রেস্টুরেন্টের সত্ত্বাধিকারী মো. রতন মোল্লা।
"আমরা কোনো প্রজ্ঞাপন দেখি নাই যে এতগুলো ছাড়পত্র লাগবে। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি, সরকারের নিয়ম মানতে তো কোনো সমস্যা নাই। তাহলে এতদিন কিছু না বলে হঠাৎ সার্টিফিকেট খোঁজা শুরু হয়ে গেল কেন," যোগ করেন তিনি।
"সব সার্টিফিকেট যদি একটি জায়গা থেকে দেওয়া হতো, তাহলে হয়ত এতটা সমন্বয়হীনতা থাকত না," বলেন তিনি।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান টিবিএসকে বলেন,"আমরা দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে এতো লাইসেন্স নিতে আর চাই না। আমাদের যেকোনো একটি সংস্থা দেখিয়ে দেওয়া হোক, সেখানে সকল কাগজপত্র জমা দিয়ে লাইসেন্স নেব। এখন যেভাবে গণহারে রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এতে আমাদের এই ব্যবসায় জড়িতরা টিকে থাকবে কীভাবে?"
তিনি জানান, সারাদেশে সাড়ে চার লাখ রেস্তোরাঁর মধ্যে মালিক সমিতির অনুমোদন আছে মাত্র ৭০ হাজার রেস্তোরাঁর। কিন্তু সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই নিরাপদ রেস্তোরাঁ বাণিজ্য গড়তে সহায়তা করছে না। একটি নিদিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার কথা বলা হলে, তা বাস্তবায়নে সংস্থাগুলো এগিয়েও আসছে না।
তিনি বলেন, "আমরা ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার দ্বারস্থ হতে চাই না। হয় সিটি কর্পোরেশন কিংবা জেলা পরিষদ কিংবা অন্য কোনো সংস্থা দেখিয়ে দেওয়া হোক, সেখানে আমাদের সদস্যরা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে অনুমোদন নেবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিয়ে একটু বিবেচনা করুক।"
তবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যারা রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানান তিনি।
লাইসেন্স ও বিধি-বিধানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবস্থান
রাজউকও বলছে তাদের বিদ্যমান বিধিমালায় জটিলতা রয়েছে, যেগুলো দ্রুত সমন্বয় করা হবে।
মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠানে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, "দেশে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন এবং জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার মধ্যে বহুতল ভবন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বহুতল ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার মধ্যে সমন্বয় করা হবে।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম টিবিএসকে বলেন, কোনো রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার পরে ফায়ার অকুপেন্সি সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য সনদ নিতে এবং সক্ষমতা বাড়াতে ৩ মাসের সময় দেওয়া হয়।
"আমাদের বিভিন্ন টিম নিয়মিত এসব রেস্টুরেন্ট ভিজিট করে এবং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। কিন্তু শহরের হাজার হাজার রেস্টুরেন্টে নিয়মিত ভিজিট করার মতো লোকবল আমাদের নেই। এজন্য কিছু জায়গায় ব্যত্যয় দেখা যায়। তবে আমরা খবর পেলে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সরকারের অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে আমরা কাজ শুরু করেছি। সবগুলোর সংস্থার সাথে সমন্বয় করে যদি একটি আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, তবে সেটা সবার জন্যই সুবিধা। ওয়ান স্টপ সার্ভিস যদি হয়, তবে তা আমাদের জন্যও ভালো।"
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এফ-১ টাইপের ভবনে রেস্টুরেন্টের অনুমোদন নেই, তবে এফ-২ টাইপ ভবনে অনুমোদন আছে। ফায়ার সেফটি প্ল্যানের বিষয়ে রাজউকের আইনে সরাসরি উল্লেখ নেই। আমরা নতুন করে এসব বিষয় সংযুক্ত করেছি। স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি ফায়ার সেফটি প্ল্যানসহ অন্যান্য প্ল্যান রাজউকের কাছে দিতে হবে ভবন মালিকদের। আমরাও কিছু বিষয়ে সংশোধন করছি, যেন ব্যবসায়ীদের জন্য পরবর্তিতে অনুমোদন পেতে সুবিধা হয়।"
তিনি আরও বলেন, "যদি কারও ভবনের শ্রেণি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে আমাদের কাছে আবেদন করলে এবং সে অনুযায়ী সেফটি-সিকিউরিটি নিশ্চিত করলেই আমরা অনুমোদন দিয়ে দেব। আমরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নই।"
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যেসব সংস্থা থেকে রেস্টুরেন্ট মালিকদের সনদ নিতে হয় সেগুলো সমন্বয়ের জন্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সমন্বয়ে 'টাস্ক ফোর্স' গঠনপূর্বক নগরীতে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তার দ্রুত যথাযথকরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, "এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য শহরগুলোতেও এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে 'অতি বিপজ্জনক' ও 'বিপজ্জনক' ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এর তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট ভবনসমূহের সম্মুখে দৃশ্যমানভাবে 'চিহ্নিতকরণের' উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
তিনি আরও বলেন, "এখন যেভাবে অভিযান হচ্ছে তা পুরোপুরি লোক দেখানো। এভাবে সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এতে যেমন ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, তেমনি একটি মহলের পকেট ভারি হচ্ছে। এমন অভিযান, জরিমানা ঘুষ বাণিজ্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দায় এড়াতে চমক দেখিয়ে অভিযান শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণেই বার বার ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে।"
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আলী আহম্মেদ খান বুধবার একটি অনুষ্ঠানে বলেন, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন বা ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সাথে সাথে সনদ প্রদানের ক্ষেত্রেও দরকার সমন্বয়। অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফায়ার কোড তৈরি করার পরামর্শ দেন তিনি।