ইতিহাসের সাক্ষী তাজমহল রোডের সেই চারতলা বাড়িটি
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের ধারে চারতলা একটি বাড়ি। ফ্যাকাশে হলদে রঙের বাড়িটির পলেস্তারা খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। কোথাও কোথাও জানালার কাচও ভেঙে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কোন আদ্যিকালের তৈরি একটি বাড়িকে নেহাত মায়ার ছলে আগলে রেখেছেন বাড়ির মালিক। বিশেষ করে, আকাশছোঁয়া অট্টালিকার যুগে এমন মায়ায় জড়ানো ভগ্নপ্রায় বাড়ি খুঁজে পাওয়া খানিকটা কষ্টসাধ্যই বটে।
বাড়িটি কিন্তু কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। হলদেটে এই বাড়িতে থাকতেন প্রয়াত প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। সুর, তাল এবং তানপুরার মূর্ছনায় যিনি মুখর করে রাখতেন বাড়ির চার ধার। আবার সময়ে-অসময়ে এই বাড়িতেই বেজে ওঠে নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের নুপূরের ঝুমুর ঝুমুর তাল। এই বাড়িটিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে।
বাড়ি কি কখনও ইতিহাসের অংশ হতে পারে? বাড়িকে কেন্দ্র করে কি কখনো গড়ে উঠতে পারে কোনো গল্প? ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ চারতলার বাড়িটি এমনই ইতিহাসে মোড়া একটি বাড়ি। যে বাড়ির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের গল্প। আনন্দ-বেদনায় মোড়া রোমাঞ্চকর ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটির মূল নায়ক ছিলেন শহীদ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্। সম্পর্কে তিনি সাদি মহম্মদের পিতা। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে মোহাম্মদপুরে বিহারীদের বর্বরোচিত হামলায় যিনি শহীদ হয়েছেন।
শহীদ সলিম উল্লাহ সড়ক
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের চারতলা বাড়িতে স্ত্রী জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্ এবং ১০ সন্তান নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ অবাঙালিদের অতর্কিত হামলায় খুন হন মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্সহ তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদপুরে শহীদ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্র নামে একটি সড়ক হয়। যার অবস্থান টাউনহল বাজারের পশ্চিম পাশে আসাদ অ্যাভিনিউ-তাজমহল রোডের একটি সংযোগস্থলে। সড়কটির নতুন নামকরণ হয় 'শহীদ সলিম উল্লাহ্ সড়ক'।
অনেকেই ভেবে বসেন, ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহর নামে বুঝি এই সড়কটির নামকরণ হয়েছে। যেটি আদতে ভুল। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে সড়কটি 'কায়েদে আজম' রোড নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭২ সালে মোহাম্মদপুর আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় সড়কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'শহীদ সেলিম উল্লাহ্ সড়ক'।
সলিম উল্লাহ্র চারতলা বাড়িটি
২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে তাজমহল রোডের বাড়িটি বেশ ফ্যাকাশে সাদাসিধে মনে হলেও ৫৩ বছর আগে এই বাড়ির দৃশ্যপটই ছিল অন্যরকম। মোহাম্মদপুর এলাকায় বড় বাঙালি বাড়ি হিসেবে চারদিকে সুনামও ছিল বেশ। এই বাড়িতেই নিয়মিত বসতো আড্ডা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন বিভিন্ন পরিস্থিতিই ছিল আড্ডার মূল বিষয়।
সলিম উল্লাহ্র সেই বাড়িতে জড়ো হতেন নানান গুণীজন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় শেখ কামালও যেতেন সময় পেলে। যোগ দিতেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, কাজী ফিরোজ রশিদ, নুরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নানান পর্যায়ের সভাও হতো বাড়িতে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় সেই সময়ে প্রচুর উর্দু ভাষাভাষী বিহারী বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে বাঙালী ও অবাঙালী সমন্বয় কমিটির প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্। তাছাড়া মোহাম্মদপুর থানার আওয়ামীলীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তাই তার বাড়িতে রাজনৈতিক কর্মীদের ঘন ঘন যাত্রা বিহারীরা ভালো চোখে দেখতো না। যেহেতু মুক্তির আন্দোলনই বাঙালিদের আলোচনার প্রধান বিষয়, তাই বিহারীদের ক্ষোভ এসে পড়ে সলিম উল্লাহ্ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর।
ঘটনার সূত্রপাত
ঘটনার শুরু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তারিখে। দিনটি ছিল পাকিস্তান দিবস। তখন পাকিস্তান দিবসে সাধারণত বাড়ির ছাদে টাঙানো হতো পাকিস্তানের পতাকা। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের পতাকার নকশা তৈরি হয়ে যাওয়ায় সলিম উল্লাহ্ সিদ্ধান্ত নেন, তার বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকাই উড়বে।
ভাবনা অনুসারে, বড় সাটিন কাপড়ে বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করে টাঙিয়ে দেওয়া হয় ছাদে। সেই পতাকায় মানচিত্রের নকশা তোলার কাজ করেন সাদি মহম্মদ এবং সেলাই করেন সলিম উল্লাহ্র স্ত্রী জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্। সেলাই শেষে বাংলাদেশের পতাকা ছাদে টাঙিয়ে দেন সলিম উল্লাহ্ পুত্র সাদি মহম্মদ।
চারতলার প্রশস্ত ছাদে পতাকা ঝোলানোর বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তানিরা। ফলস্বরূপ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার সেদিনই সলিম উল্লাহ্র বাড়িকে রেকি করে চলে যায়। ২৫শে মার্চেও ঘটে একই ঘটনা। সেই ভয়াল রাতেই শুরু হয় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর তাণ্ডব। নির্বিবাদে চলতে থাকে গণহত্যা।
হামলার সূচনা বাড়িতেই
সাদি মহম্মদের বাংলাদেশ টেলিভিশনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের বরাতে উঠে আসে ২৬শে মার্চের ভয়াল চিত্র। যেভাবে তাজমহল রোডের চারতলার বাড়িটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল, তা বলছিলেন তিনি। সাদি মহম্মদের ভাষ্যে, ২৬শে মার্চ জুম্মার নামাজের সময় সবাই বাড়িতেই বসেছিলেন। চিন্তা করছিলেন, কোথায় পালানো যায়, কী করা যায় সেগুলো নিয়ে। এর মধ্যেই দুপুরে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যান বাবা সলিম উল্লাহ্। নামাজ পড়তে গিয়েই ভয়ানক কিছু ঘটার আশঙ্কা করেছিলেন। ফিরে আসার পর পর শুরু হয় সলিম উল্লাহ্র বাড়ির ওপর হামলা। ঢিল মারা, বোমা ছোঁড়া সবই চলছিল সমান তালে।
হামলা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে সকলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাড়ির চারতলায়। কারণ বাড়ির নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয় পাক বাহিনী। চারপাশ থেকে শোনা যাচ্ছিল মেশিনগানের আওয়াজ। বোমাও ছোঁড়া হচ্ছিল ছাদে। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে যায় বাড়ির তিনতলা। অগত্যা সলিম উল্লাহ্ বলেন, বাড়ির দরজা খুলে দিতে। ঝাঁপিয়ে পড়েও যাতে বাঁচা যায় সেই আকুতিই ছিল সবার মধ্যে।
দরজা খুলে দেওয়ার পর অবাঙালিরা প্রবেশ করে ঘরের ভেতর। সকলকে নির্দেশ দেয়, চারতলা থেকে নিচে নামার জন্য। দোতলা পর্যন্ত নামার পর সবাই পাশের বাড়িতে ঝাঁপ দেয়। সাদি তার বাবা-মাকে নিয়ে দৌঁড়ে আশ্রয় নেয় পাশের বাড়ির টয়লেটে। খুঁজতে থাকে পালানোর উপায়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি।
এক পর্যায়ে এয়ারফোর্সে চাকরি করা সলিম উল্লাহ্র একজন অবাঙালি প্রতিবেশী ছোরা হাতে এগিয়ে আসেন। সাদিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আঘাত করেন সলিম উল্লাহ্র ওপর। পেছনে বসিয়ে দেন ছোরা। আহত বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সাদি। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখেন, অজস্র অবাঙালি ছুরি হাতে দৌঁড়ে আসছে। ভয়াল পরিণতি এড়াতে পারেননি সাদি মহাম্মদের চাচা এবং খালাতো ভাইও। তাদেরকেও হত্যা করা হয় নির্মমভাবে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অতীতের স্মৃতি হাতড়ে সাদি আরও বলেন, "বাবার সাথে বেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর বাবা বললেন, 'তুই বরং যা, আমি তো মরেই যাচ্ছি। তুই বাঁচ।' আমি বললাম, 'আমি কোথায় যাবো আপনাকে ফেলে?' বাবা বললো, 'তবুও তুই বাঁচ।' বাবা তখন জোর করে হাত সরিয়ে দিলো। বাবাকে পথে ফেলে আমি পাশের বাড়িতে ছুটলাম। ওখানে দেখি অনেক বাঙালি লাশ পড়ে আছে। আমি এত লাশ কোনোদিন একসাথে দেখিনি। আমার কাছে মাটির মূর্তির মতো মনে হচ্ছিল। গোটা গায়ে রক্ত আর ঘাস শুকিয়ে আবরণ হয়েছিল। আবার ফিরতে লাগলাম। তখন দেখলাম, একটি ছেলে বড় একটি তলোয়ারের মতো কিছু নিয়ে ছুটে আসছে আমাকে মারবার জন্য। আমার পরনে ফুল প্যান্ট ছিল। আমি খুব জোরে দৌঁড় দিয়েছিলাম। ভাবলাম যে একবার দৌঁড় দেই, বাঁচার জন্য এইটুকু দৌঁড়ানো তো যায়। বাবাকে ফেলে চলে গেলাম। দৌঁড়াতে গিয়ে বাবাকেও দেখছিলাম যে পড়ে আছে রাস্তার একপাশে। সেই সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা রক্তাক্ত মানুষ পড়ে আছে। ভাবছি যে নিজে বাঁচার কত সাধ!'
বাড়ি আদায়ের নতুন সংগ্রাম
বাবা আর বড় ভাইকে ফেলে সাদি মহাম্মদের ঘর ছাড়ার সংগ্রাম চলেছিল অনেকদিন। মা জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্ ও ভাইবোনদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে।
নতুন জীবনযুদ্ধে সন্তানদের একমাত্র সম্বল ছিল মা জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্। সেলাইয়ের কাজ জানায় সেটিকে পুঁজি করে যাত্রা শুরু করেন নতুন জীবনের। দেশ স্বাধীনের পর তারা আবার ফিরে আসেন তাদের পুরোনো ঠিকানায়। যুদ্ধের তাণ্ডবে পুড়তে থাকা বাড়িটির সংস্কারের কাজ শুরু হয়।
তাতেও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাদের। যুদ্ধের পর সলিম উল্লাহ্র বাড়িটিকে শত্রুর সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে মামলাও হয়। পরে আদালতের রায়ে বাড়ির মালিকানা নিশ্চিত হয়। শহীদ সলিম উল্লাহ্কে ছাড়াই শুরু হয় নতুন সংগ্রাম।
চারতলা বাড়ির স্মৃতি
শহীদ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্র তাজমহল রোডের বাড়িটি নিয়ে নানান স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং চিত্রনাট্যকার সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন তার তাজমহল রোডের নানী বাড়িকে নিয়ে লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়।
গাউসুলের ভাষ্যে, "আমি মূলত আমার নানী বাড়িতে বড় হয়েছি। একটু বড় হওয়ার পর অবশ্য বাবার সরকারী চাকরির কারণে বেশ কিছুদিন চট্টগ্রাম থাকতে হয়েছে, তবে নানী বাড়ির প্রভাব আমার ওপর থেকে আজও যায়নি। প্রতি ঈদে, ২৬শে মার্চ মানে নানার মৃত্যু দিবসে কিংবা পহেলা বৈশাখে, নানী বাড়ির আড্ডা আর পাতলা খিচুড়ি-গরুর মাংস, আমার শৈশবে পুনঃঅবগাহনের এক মহোৎসব। আমার মায়েরা ১০ ভাইবোন; ৬ ভাই আর ৪ বোন। তবে আমার মামারা একেকজন এক একটা অদ্ভূত চিস। বিশেষ করে, সাদি মামা আর শিবলি মামা, সবাই যাদের সাদি মোহাম্মদ আর শিবলি মোহাম্মদ নামে চেনে। ওদের পাগলামির গল্প বলে শেষ করা যাবে না।
"মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের কবরস্থানের ঠিক উল্টোদিকে পুরোনো ভগ্নপ্রায় চারতলা বাড়ি, পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের দেওয়া সেই ভালবাসা নিয়ে আজো বিদ্যমান আমার নানা বাড়ি। ঢাকা শহরের এমন একটা চকচকে জায়গায় এমন একটা বাড়ি, ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে ফেললেই সব ঝামেলা চুকে যায়, পাকিস্তানিদের স্মৃতির হাত থেকেও বাঁচা যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা, ছাদে ফুটো নিয়ে, বর্ষার পানি নিয়ে, বুড়ো বয়সে লিফট ছাড়া চারতলায় ওঠা-নামার ঝক্কি নিয়ে দিব্যি ঢ্যাং ঢ্যাং করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রাণপ্রিয় চারতলা, নানী বাড়ি আর সেই বাড়ির আধ পাগলা মানুষগুলো।"
"আমরাও নানা অজুহাত দেখিয়ে বাড়িটা ঠিক ওরকমই রেখে দিয়েছি। ২০১৮ তেও প্রতিদিন ১৯৭১ যাওয়া আসা করে, ভুলতে দেয় না। প্রতিদিন নতুন করে হৃদয়ে জখম। আজ জখমের কথা থাক, ও নিয়ে আরেকদিন বলা যাবে। আজ বলতে চাই, আমার দুই মামা, সাদি মোহাম্মদ আর শিবলি মোহাম্মদের পাগলামির গল্প। প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের এই চারতলা নানী বাড়ির মানুষগুলো কিন্তু এখনো আশির দশকে বসবাস করে। প্রতিদিন বাজার হচ্ছে, যে খুশি সে এসে খেয়ে চলে যাচ্ছে, এমন সব কাণ্ড।
"এখনো এই পাড়ায় মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে, গ্রামের বাড়ি থেকে হুট-হাট আত্নীয়- স্বজন না বলে কয়ে চলে আসে। যা হোক, গল্পে ঢুকি। সাদি মামাকে যারা একটু আধটু চেনে শিল্পী হিসেবে, তারা ধারণাও করতে পারবে না, কি অসম্ভব রকমের পাগলামি তাকে দিয়ে সম্ভব। এই সেইদিনই ফিমা মানে আমার বউ হঠাৎই আমার নানী বাড়িতে তার মোবাইল ফোন খুঁজে পাচ্ছিল না, অনেক খোঁজাখোঁজির পর হঠাৎই সেই ফোনের খোঁজ পাওয়া গেলো ডিপফ্রিজে; হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, 'ডিপফ্রিজে'। আমরা সাথে সাথে জানি, এটা সাদি মামার কাজ। এমনই একদিনের ঘটনা।"
"শুক্রবার দিন সকালবেলা, আমরা সবাই নাস্তার টেবিলে। সাদি মামার ঘরের দরজার পুরনো লকটা আর কাজ করছে না। মিস্ত্রী ডাকা হলো। মিস্ত্রী যথারীতি লকটা বেশ খানিকক্ষণ দেখে ঘোষণা করলো, 'এই লপ ঠিক করা যাবি না সার, লপ সেঞ্জ করতি হবে।' সাদি মামা চুপ করে বেশ শুনছিল, যেইমাত্র লোকটা 'লপ' শব্দ উচ্চারণ করলো, সাদি মামা একদম ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার ওপর, 'আপনি লপ বলছেন কেন, লক বলুন (শান্তিপুরি বাংলায়)।' আমরা বাকি যারা টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, তাদের ততক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে যে, আজকে লোকটার খবর আছে।
"লোকটা থতমত খেয়ে, ছোট্ট একটা ঢোক গিলে ফস করে আবার বলে উঠলো, 'লপ'। সাদি মামা চোখ গরম করে বলে উঠলো, 'আবার লপ বলছেন'। লোকটার চেহারা এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো, আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, একটু সাহায্যের আশায়। কিন্তু ও তো জানে না, কার পাল্লায় পড়েছে, এই ঝামেলা থেকে ওকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। আমরা বরং নাস্তা থেকে মনযোগ সরিয়ে নাটকে মন দিয়েছি, দেখি ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। সাদি মামা বললো, 'বলুন বলুন, লক বলুন, বলুন লক।' লোকটা এবার পৃথিবীর সমস্ত আত্নবিশ্বাস এক জায়গায় করে আস্তে আস্তে ঠোঁট দুটোকে কাছাকাছি আনতে লাগলো। ওর সাথে আমরাও কোরাসে ঠোঁট দুটোকে এক করে লক বলার দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। বাহ এই তো বেশ 'ল' বলে ফেলেছে, এখনি 'ক' টাও বলে ফেলবে, কিন্তু না আবারো সবাইকে নিরাশ করে লোকটার মুখ দিয়ে শেষ আবধি 'লপ' বেরিয়ে এলো।
"সাদি মামাও হাল ছাড়ার মানুষ না। লোকটাকে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বলল, 'এখানে বসুন, এক গ্লাস পানি খান, নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই।' তারপর শুরু হলো আসল যুদ্ধ, লোকটা বারবার লপ বলে যাচ্ছে, আর সাদি মামা বারবার লক লক করে যাচ্ছে, 'হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো বেশ হচ্ছে, হ্যাঁ জিহবাটাকে টাকরায় ঠেকিয়ে ক বলুন। বলুন ল, ক লক।' লোকটা বলছে, 'ল, ক, লপ।' সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। হঠাৎ সাদি মামা সিদ্ধান্তে পৌঁছল, 'বুঝেছি, ওকে মুখের যোগ ব্যায়াম করাতে হবে।' ব্যাস শুরু হয়ে গেলো মুখের যোগব্যায়াম। সাদি মামা মুখের সব কিম্ভূতকিমাকার অঙ্গভঙ্গি করছে, সাথে সাথে লোকটাও কাঁদো কাঁদো চেহারায় যোগ ব্যায়াম করে যাচ্ছে। আর আমরা মনযোগী দর্শকের মতো বসে আছি, নাটকের শেষ অংকের জন্য।
"প্রায় ৪৫ মিনিট চেষ্টার পর লোকটার মুখ দিয়ে হঠাৎই বেরিয়ে এলো, সেই অমোঘ শব্দ, 'লক'। সে কি দৃশ্য! লোকটা চিৎকার করে সাদি মামাকে জড়িয়ে ধরল। সাদি মামাও যার পর নাই খুশি। লোকটা আমাদের সাথে বসে চা-নাস্তা খেলো, লপ, থুক্কু লক ঠিক করলো এবং মোটা বখশিশ নিয়ে বিদায় হলো। তো এই হচ্ছে সাদি মামা। এমন আরো কয়েকশো গল্প আমার ভাগাড়ে আছে সাদি মামা, শিবলি মামাকে নিয়ে।"
"শেষ করবো এইবার ঈদের ঠিক আগের আগের একটা গল্প দিয়ে। ঈদের আগে শিল্পীদের ব্যস্ততা এমনিই একটু বেড়ে যায়। তেমনি একদিন, সকাল সকাল সাদি মামা হন্ত দন্ত হয়ে বাসা থেকে বেড় হচ্ছে। যাওয়ার সময় শিবলি মামাকে বলে গেলো, 'শিবলি, আমার রেকর্ডিং, তোর গাড়ি নিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম, তোর তো ভাইবার আছে, তুই বরং ভাইবার নিয়ে চলে যাস।' শিবলি মামাও বাধ্য ভাইয়ের মতো মাথা নেড়ে বললো, 'হ্যাঁ ঠিক আছে, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ভাইবার নিয়ে চলে যাবো।' এবার বুঝুন অবস্থা!!!"
তাজমহল রোডের চারতলা বাড়িটির আনন্দ কিছুটা হলেও ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে ২০২৩ সালে। সে বছরের জুলাই মাসে মৃত্যুবরণ করেন বাড়ির কর্ত্রী জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই বিষণ্ণতা গ্রাস করে পুত্র সাদি মহম্মদকে। চলতি বছরের মার্চ মাসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি। নিভে যায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদের জীবন প্রদীপ।
সাদি মহম্মদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক ছিলেন তিনি।
তার অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে 'আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে', 'শ্রাবণ আকাশে', 'সার্থক জনম আমার' ইত্যাদি। ২০১২ সালে চ্যানেল আই তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমী থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার পান সাদি মহম্মদ।