পুরান ঢাকার ইসলামবাগে প্রতি কদমেই অগ্নিঝুঁকি!
পুরান ঢাকার চকবাজারের ইসলামবাগের সরু গলিগুলোতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গড়ে উঠেছে কেমিক্যাল কারখানা, প্লাস্টিকের দোকান ও বিভিন্ন গুদাম। আর এ কারণে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে।
গত শনিবার (২৩ মার্চ) ইসলামবাগের একটি চারতলা ভবনে আগুন লাগে। এতে এক কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
অলিগলিতে গড়ে ওঠা অনিয়ন্ত্রিত এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যে সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য যে বিপদ ডেকে আনছে, তা এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি, তবে যেকোনো মুহূর্তে আবারও আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে ইসলামবাগ এলাকাজুড়েই।
শনিবার ইসলামবাগ এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার এ অংশে বিভিন্ন ভবন এতটাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে যে বেশিরভাগ গলিতেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করা অসম্ভব। সরু গলিগুলোতে বেশিরভাগ ভবনের নিচতলা ও দোতলায় কেমিক্যালের গোডাউন ও প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানা। ভবনের ওপরে অন্য তলাগুলোতে আবাসিক ব্যবস্থা। আগুনে পুড়ে যাওয়া ওই ভবনের আশপাশের প্রায় সবগুলো ভবনেই রয়েছে প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানা।
পশ্চিম ইসলামবাগের একটি সরু গলিতে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, একটি ভবনের নিচতলায় প্লাস্টিক গুঁড়া করার কাজ চলছে। এই গলি দিয়ে কোনো গাড়ি প্রবেশ করা তো দূরের কথা, আগুন লাগলে দ্রুত সরে পড়াটাও কঠিন।
এ গলির একটি মোড়ে দেখা গেল দুইটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার স্থাপন করা। এর সাথের বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো পাশের ভবনগুলোর সাথে একেবারেই লাগোয়া।
গলির একটু সামনেই ডান দিকে একটি প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির কারখানা। এর নিচতলার পুরোটা জুড়ে পড়ে আছে বিভিন্ন কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও পুরনো পাইপের স্তূপ। কারখানাটির সামনেই ৩-৪টি ড্রামে রাখা জ্বালানি তেল।
কারখানাটির কর্মচারী মো. সোহেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রায় দেড় বছর ধরে এখানে কাজ করছি। ঝুঁকি থাকলেও পেটের দায়ে কাজ করা। আমাদের এ কারখানায় সব পাইপের কাঁচামাল ও বিভিন্ন কেমিক্যাল রয়েছে। যদি এ গলিতে কোনোভাবে আগুন লাগে, তবে আমাদের বের হওয়াটাই কঠিন হয়ে যাবে।'
পুড়ে যাওয়া ভবনের পাশের ভবনের এক বাসিন্দা টিবিএসকে বলেন, 'গত দুই দিন এ কারখানাটি বন্ধ থাকায় এবং রাতে আগুন লাগায় মানুষগুলো বেঁচে গেছে। দিনে আগুন লাগলে তা নেভানো আরও কঠিন হতো। কারণ আশপাশের গলিগুলোতে যানজট লেগে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহজে প্রবেশ করতে পারত না।'
সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবই দায়ী
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, ইসলামবাগ ও চকবাজার এলাকায় ছোট-বড় কারখানাগুলো সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। তাদের কথা- এসব প্রতিষ্ঠান ও এখানকার সরু গলিগুলো মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলামের অভিযোগ- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে এসব এলাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। যে কারণে এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখান থেকে স্থানান্তরও করা যাচ্ছে না।
তিনি রাজউক ও ডিএসসিসির দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে সমন্বয়হীনতার সমালোচনা করেন।
রাজউকের দাবি, পুরান ঢাকাকে সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে ডিএসসিসি থেকে সে ধরনের কোনো সহযোগিতা রাজউক পায়নি।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'পুরান ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই রাসায়নিক গোডাউন সরাতে হবে এবং কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে।'
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খানও দ্রুত এসব কেমিক্যাল কারখানা সরাতে এবং পুরান ঢাকার সংস্কারে জোর দেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল সরকার পুরান ঢাকার এসব কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম স্থানান্তরের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।
৮ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ইসলামবাগের আগুন নিয়ন্ত্রণে
ইসলামবাগের প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুন তিন ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পুরোপুরি নির্বাপণ করতে সময় লেগেছে আট ঘণ্টা।
শনিবার দুপুরে লালবাগ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, 'সরু গলি না হলে আরও আগে আগুন নেভানো যেত, ক্ষয়ক্ষতিও অনেক কম হতে পারত।'
কারখানা কর্তৃপক্ষ এক থেকে দেড় কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি দাবি করলেও তাৎক্ষণিক এর পরিমাণ জানাতে পারেননি মোস্তাফিজুর।
শনিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে চকবাজারে আগুন লাগে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে ৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।