সাতছড়ি উদ্যানের পাখিদের জন্য করোনা এক আশীর্বাদ
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় ভারত সীমান্তবর্তী দেশের সবচেয়ে ছোট জাতীয় উদ্যান সাতছড়ি। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিস্তৃত বনটি মূলত মিশ্র চির সুবজ এবং পাতাঝরা বন। পার্শ্ববর্তী পাম বাগানসহ সব মিলিয়ে বনটির আয়তন ২৪৩ হেক্টর।
আকারে ছোট হলেও উদ্যানটি পাখিদের জন্য স্বর্গরাজ্য। এত ছোট জায়গায় এত বেশি পাখি দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। বিশ্বের অনেক সমৃদ্ধ বনেও এত পাখির দেখা মেলে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, যে কোনো বনে প্রতি এক কিলোমিটারের ভেতর সাধারণত ৫০ প্রজাতির বেশি পাখি বসবাস করে। কিন্তু সাতছড়ি একমাত্র বন যেখানে এক কিলোমিটারের ভেতর প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পাখিও পাওয়া যায় এখানে। তাই দেশের পাখিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের কাছেও এই বন রয়েছে পছন্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষে।
এখানে রয়েছে বিরল লালমাথা-কুচকুচি পাখি। আছে শ্যামাঘুঘু, হরিয়াল, সবুজ-ধুমকল, পাপিয়া, হুতুম-প্যাঁচা, নীলদাড়ি-সুইচোরা, সুমচাসহ নানা জাতের বিপন্ন, বিরল এবং মহাবিপন্ন পাখি, যা সুন্দরবন ছাড়া দেশের অনেক বনেই নেই। ময়না-টিয়ার দেখা এখানে খুব সহজেই পাওয়া যায়।
অন্যান্য সময় এই বনে ছিল দর্শনার্থীদের অবাধ বিচরণ। পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষসহ পর্যটকদের যত্রতত্র চলাফেরার কারণে বনের পাখিগুলো ছিল রীতিমতো বিরক্ত। যার প্রভাব পড়ত তাদের প্রজননে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপের পর থেকে মানুষের আনাগোনা না থাকায় বনের পাখিগুলো ফিরে পেয়েছে তাদের আপন রাজ্য। প্রজনন প্রক্রিয়া চলছে নিজস্ব পরিবেশে। আর নতুন বাচ্চার কিচিরমিচির শব্দে বনে তৈরি হয়েছে ভিন্ন পরিবেশ। আর এই অবস্থাকে পাখিদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব।
স্থানীয়রা জানান, অন্যান্য বছর পর্যটকরা বনে ঢুকে পাখিকে বিরক্ত করে। ঢিল ছুঁড়ে মারাসহ জোরে জোরে শব্দ করেন, প্লাস্টিক ফেলে আসেন। অনেকে আবার পাখির বাসা থেকে বাচ্চাদের ছবি তুলতে খুব কাছে চলে যান, যা পাখিদের ভীত করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, আমাদের পর্যটকের বড় একটি অংশ অসচেতন। তারা বনে ঢুকে পাখিকে বিরক্ত করে এক ধরনের আনন্দ পায়। যেমন ঢিল ছোঁড়া, সুযোগ থাকলে যে ডালে বা ছোট গাছে পাখির বাসা সেখানে উঁকি মারা। চিৎকার ও শিষ দেওয়া তো সাধারণ ঘটনা। সুযোগ পেলে হাত দিয়ে পাখির বাচ্চা বা ডিম ধরেও দেখে। অনেকের কাছে আবার এই বনটি পিকনিক স্পট।
''আমি ২৫ দিন আগে ওখানে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ছিলাম। বনে এত পাখি এর আগে দেখিনি। মানুষের যাতায়াত কম থাকায় পাখিরা নিজেদের মতো করে থাকছে। বাচ্চা দিচ্ছে'', যোগ করেন তিনি।
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার তৌহীদ পারভেজ বিপ্লব জানান, যারা বার্ডিং (পাখির ছবি তোলা) পছন্দ করেন তাদের জন্য সাতছড়ি একটি স্বর্গ। তবে অসেচতন কিছু মানুষ ছবি তুলতে গিয়ে পাখিকে বিরক্ত করে। এটা বন্ধ করা উচিৎ।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু জানান, দেশের মধ্যে পাখিদের জন্য এমন বৈচিত্রপূর্ণ উদ্ভিদ আর বৃক্ষে ভরা বন আর কোথাও নেই। সুন্দরবনের পর একসঙ্গে এত প্রজাতির পাখির দেখা আর কোথাও মেলে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে পাখির প্রজনন মৌসুম চলছে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বেশিরভাগ পাখির প্রজনন সময়। এই বছর করোনার কারণে মানুষের উৎপাত কম থাকায় সাতছড়ি বনে পাখিরা নিজেদের মতো প্রজনন করতে পারছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর পাখির প্রজনন মৌসুমে মানুষের যাতায়াত বন্ধ রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক জানান, এক কিলোমিটার বনে ৫০ প্রজাতির জায়গায় সাতছড়িতে ২০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এটা মোটেও ভালো খবর নয়। এত বড় দেশ আমাদের। কিন্তু পাখিদের বসবাসের ভালো জায়গা না থাকায় সেগুলো এখানে থেকে যায়।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে বনটি আমার কাছে খবই প্রিয়। কারণ এখানে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ এবং লতাপাতা আছে সেই সঙ্গে আছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। যা এই বনকে সমৃদ্ধ করেছে। ছোট একটি বনে দুইশ প্রজাতির পাখি তখনই থাকবে যখন তাদের জন্য আলাদা আলাদা খাবার পাওয়া যাবে। এটা একটা ভালো দিক।
''আমি প্রায় শতবার এই বনে গেয়েছি। দিনে দিনে বনটা বদলে যাচ্ছে। একবার দেখলাম ছড়া থেকে বালু নেওয়া হচ্ছে, ফলে পাশের মাটি গাছসহ ছড়ায় পড়ে যাচ্ছে। এই বছর করোনার কারণে মানুষ বনে যায়নি। ফলে পাখিরা বিরক্ত হয়নি। প্রজনন মৌসুমে এটা আশীর্বাদ'', বললেন ড. ইনাম।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ জানান, প্রকৃতি তার নিজের মতো করে ডানা মেলেছে। বেড়েছে পাখিসহ সব প্রাণীর উপস্থিতি। করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের ব্যাপারে পরিকল্পনা নিচ্ছি।