নতুন স্বাভাবিক জীবনে বিয়ে: আনন্দটা ভাগ হয়ে যাক সবার সাথে, শুধু জাঁকজমকে নয়
আমার দাদা সংস্কৃতের একটা শ্লোক বলেছিলেন যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় এরকম- বিয়ে হওয়ার সময় পাত্রী দেখে পাত্রটি সুন্দর কিনা, পাত্রীর বাবা দেখেন পাত্র ভাল আয় করে কিনা, মা দেখেন পাত্রের সুনাম আছে কিনা, গুরুজনেরা দেখেন পরিবার কেমন। আর 'ইতরেজনা' মানে অভ্যাগতরা দেখেন খাওয়া দাওয়ার আয়োজন কেমন থাকবে বিয়েতে। শ্লোকের কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কারণ এই করোনাকালে প্রায় ৪ মাস ধরে বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে বলে বন্ধুদের অনেকে শুধু আলোচনা করেই বিয়ের খাবারের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করছে। বিয়ে বাড়ির খানাপিনার স্বাদই অন্যরকম। এর একটা আলাদা কদর আছে। বিশেষ করে বিয়ে বাড়ির কাচ্চিরতো কোন তুলনাই হয়না। যাহোক আমাদের মতো আমজনতার বিয়ের খাওয়া খেতে না পারার হাহাকার দেখে আমার মনে হলো যে দাদার কাছে শোনা শ্লোকটি একেবারে মিলে গেছে।
তবে শুধুতো খানাপিনাটাই বিয়ে নয়, এর সাথে জড়িত অনেককিছু। নিজেদের বিয়েকে ঘিরে কত কত প্ল্যান, কত প্রোগ্রাম সব বানচাল হয়ে গেল আসমা আর রাব্বির। ওদের দুই পরিবারও বিয়েকে কেন্দ্র করে প্রায় ২/৩ কোটি টাকার বাজেট করে ফেলেছিল। এইসব অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল পূর্বাচলে দিনব্যাপী গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। রাতে নিজেদের বাড়ির সুইমিং পুলে আলো ফেলে চাঁদের আলো তৈরি করাসহ একটা মারমার কাটকাট বিয়ের অনুষ্ঠান। মে মাসে বিয়েটা হতে পারলো না বলে ছোট করে অনলাইনে বিয়ে হলো। অতঃপর সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
সাব্বির আর দিনাতের তো আরো এককাঠি বেশি পরিকল্পনা ছিল। ওদের বিয়ের আয়োজন হয়েছিল মালয়েশিয়ার লাংকাউইতে। অতিথিরা নিজেদের খরচে যাবেন। থাকা, খাওয়া, বেড়ানোর খরচ বিয়ের উদ্যোক্তাদের। বুঝেন কী একটা অবস্থা। সব মাঠে মারা গেলো করোনা আসাতে। সেই ১৯৭৪ সালে আমার খালাতো বোনের ঢাকা-জার্মানি ফোনে বিয়ে হতে দেখে আমাদের পরিবার পরিজন চমকে উঠেছিল। ফোনে আবার বিয়ে হয় নাকি? আর এখন এমন কাল পড়লো যে সব বিয়েই হচ্ছে অনলাইনে।
শুধু এই দুই জোড়া ধনী যুগল নয়, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ ও ডিউক অব এডিনবরার নাতনির বিয়েও আটকা পড়ে গিয়েছিল এই করোনার কারণে। মে মাসের বিয়ে এসে হল ১৭ জুলাই, খুব ছোট পরিসরে। শুধুমাত্র দুই পরিবারের কাছের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। ৯৪ বছর বয়স্ক রাণী ও ৯৯ বছরের ফিলিপ আইসোলেশন ভেঙে এই প্রথম চারমাস পর কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। রাজকীয় এই বিয়েকে কেন্দ্র করে যা যা পরিকল্পনা ছিল, সেগুলোও আর হয়নি।
অনেকেই বিয়ের প্রোগ্রাম স্থগিত করেছেন। অনেকেই স্বল্প পরিসরে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলছেন। বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধনীরা এখন বিয়েতে ব্যাপক টাকা খরচ করেন। শুধু বিয়ের আয়োজন ও কেনাকাটা মিলে ৫/৬ কোটি পর্যন্ত খরচ করে ফেলতে পারেন অনেকেই। এসব দেখে দেখে মধ্যবিত্তরাও তাদের ব্যয়ের মাত্রা বাড়িয়েছেন। গত ১০/১৫ বছরের মধ্যে ঢাকার বিয়ের জাঁকজমক আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছে।
এতে অবশ্য লাভ হয়েছিল বিয়ে আয়োজনের সাথে জড়িত মানুষগুলোর। বিয়ের বাণিজ্যে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা জড়িত। এমনকি দরিদ্র পরিবারগুলোও ধার দেনা করে হলেও বিয়েতে ভালই খরচ করেন। কিন্তু করোনার কারণে এই ব্যয় বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষকরে স্বচ্ছল ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বিয়েতে খরচ করার কথা এখন তারা ভাবতেই পারছেন না।
করোনা আসাতে সব বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন বিয়ে হচ্ছে জুমে। বাংলাদেশ বলে নয়, বিশ্বের সব দেশেই করোনার কারণে বিয়ের বাজারে ধ্বস নেমেছে। নিউইয়র্কের মতো জায়গাতেও ভার্চুয়াল বিয়েকে বৈধ করার জন্য নতুন আইন করতে হয়েছে। করোনাতে যুক্তরাজ্যেও বহু বিয়ে বাতিল ও স্থগিত হয়ে গেছে। অবশ্য বিবিসি জানিয়েছে ৪ জুলাই থেকে ইংল্যান্ডে আবার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তবে মাত্র ৩০ জন এতে অংশ নিতে পারবেন। এই লকডাউনে প্রায় ৭৪ হাজার বিয়ে ও পার্টনারশীপ রেজিস্ট্রেশনের আয়োজন বন্ধ হয়ে ছিল।
ভারতীয়দের জন্য ধাক্কাটা খুব বেশিই হয়ে গেছে। সাধারণত ভারতীয় বিয়ের আয়োজন খুব জৌলুসপূর্ণ হয়ে থাকে। বহুদিন ধরে, বহু টাকা ব্যয়ে এবং অনেক নিয়ম মেনে ভারতে বিয়ে হয় সব ধর্মের মানুষেরই। সেখানে বিয়ের বাজার খুবই রমরমা। সেই ভারতেও খুব ছোট আকারে বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে অনলাইনে। সেখানে বিয়ের বিলিয়ন ডলারের বাজার ভেঙে পড়েছে। ২০১৯ সালে বিয়ের ব্যবসায় আয় ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার।
যেহেতু বিয়ের কোন উৎসব থাকছেনা, তাই বিভিন্ন দেশের যুগলদের কেউ কেউ বিয়েতে অভিনবত্ব খুঁজে বের করছেন। ইন্দোনেশিয়াতে এক যুগল নিজেদের গাড়ির পার্কিং জোনে গাড়িতে বসেই বিয়েতে কবুল বললেন। ইসরাইলি দম্পতি বিয়ে করলেন জঙ্গলে গিয়ে। ইরাকি দম্পতি কারবালা প্রান্তরে গিয়ে বিয়ে সারলেন কারফিউয়ের মধ্যে।
বাংলাদেশের দীপার অনলাইন বিয়েটা কিভাবে একটা বিয়ে বিয়ে চেহারা পাবে, এজন্য সাহায্য নেয়া হলো ওয়েডিং প্ল্যানার এর। দীপা বলল, আমাদের বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু করোনা এসে সব আয়োজন বাতিল হয়ে গেল। শুধু বিয়েটা পড়ানো হলো অনলাইনে। এমনকী তার স্বামীও আসতে পারেনি আমেরিকা থেকে। ওয়েডিং প্ল্যানার বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন কিভাবে মাত্র ১০ জন অতিথির তালিকা করা হবে, রেজিস্ট্রেশন, গান বাজনা এবং প্যাকেটের খাবার। দু একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম কাজ করছে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোকে আকর্ষণীয় করার জন্য। তবে আয় খুবই সামান্য।
বাংলাদেশেও বিয়েকে কেন্দ্র করে যে শক্তিশালী বাজার গড়ে উঠেছিল, তা বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে করোনাকালে। বিয়ের বাড়িতে ফুল সরবরাহ করতো যারা, তাদের একজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সব মিলিয়ে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুল সরবরাহ করে গড়ে দিনে ১৫ হাজার টাকা আয় করতেন। এখন সেটা এসে দাঁড়িয়েছে দেড়/দুই হাজার টাকায়। ফুলের চাহিদা যখন আকাশচুম্বি, তখনই করোনার ধাক্কা।
করিম আহমেদের ছিল বিয়ের ও হলুদের জিনিষপত্রের দোকান। সেটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। মাণিক সাহা জানালো অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দামের মধ্যে উপহার দেয়ার জন্য সে চালু করেছিল তার দোকান " উপহার বিতান", যা এখন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ এখন দোকান খোলা রাখাই তার জন্য বেশি ক্ষতির।
আরব নিউজ লিখেছে যে খলিলুর রহমান একজন ম্যারেজ রেজিষ্টার যিনি করোনার আগে সারাদিনে লা করারও সময় পেতেন না। ওনার ডায়েরিতে কোন তারিখ খালি পড়ে থাকতো না। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এক ঝটকায় তা ঠিক উল্টা হয়ে গেছে। বলা যায় যে উনি মহামারির কারণে চাকুরি হারাতে বসেছেন। খলিলুর রহমান বলেন," সাধারণত মাসে আমি ২০ থেকে ৪০ টা বিয়ে রেজিস্ট্রি করি। এখন মাসে করছি ২ টা। আমাদের সবাইকে কাজ ছেড়ে দিতে হবে," উনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত হাজার বিয়ে রেজিষ্টারের মধ্যে একজন। সবার অবস্থাই এখন এরকম।
একজন ওয়েডিং ফটোগ্রাফার জানালেন তিনি ৫০০ লোকের বিয়েতে ছবি তোলার দায়িত্বে ছিলেন। এরপর বিয়েতে এল ১৫ জন। দিয়াবাড়িতে ও নদীতে গিয়ে ফটোশ্যুট করার আয়োজন ছিল বর বউয়ের। এর কোনটিই হয়নি। ফলে বিয়ের বাড়ির লোকেরাও অনেক কম টাকা দিয়েছেন। রিয়াজুল হাসান বললেন, "এতে আমাদের কোন লাভই হয়নি। আমাদের ক্যারিয়ার শেষ।"
বিয়ের বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেছেন করোনার কারণে এই তিন চার মাসের গ্যাপ বিয়ের বাজারে ধ্বস নামিয়েছে। এই ক্ষতি পূরণ করাও খুব কঠিন হবে। ছোট বড় সব কমিউনিটি সেন্টারগুলো বন্ধ চার মাস ধরে, এখানে কর্মরত বহু মানুষের চাকরি চলে গেছে , ডেকোরেটরের ব্যবসা বন্ধ, বাবুর্চিদের কাজ বন্ধ, হোটেলগুলোতে এখনও কোন লোক সমাগম নেই ।হোটেল কর্মচারিরাও সবাই বেকার হয়ে গেছে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো মনেকরছে বিয়ের ভবিষ্যত চেহারা পাল্টে যাবে। হয়তোবা এরকম জাঁকজমক করে বিয়ে হবে খুব অল্প। কারণ অধিকাংশ মানুষের হাতে টাকা কমে গেছে। মানুষ বিয়ের পেছনে আর এত বেশি ইনভেষ্ট করবেনা। ডেসটিনেশন ওয়েডিং বলে যা চালু হয়েছিল, এর সংখ্যাও কমে আসবে। নতুন স্বাভাবিক জীবনে বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। দফায় দফায় অনুষ্ঠান কমে যাবে। ব্যয়বহুল বিয়ে আর হবেনা। সস্তা ও সীমিত পরিসরের বিয়েই সবাই চাইবে। আবার হয়তো কারো কারো বিয়ের অনুষ্ঠান ছোট হবে কিন্তু জাঁকজমক থাকবে। তবে ভবিষ্যতে বিয়ের অনুষ্ঠান কীভাবে হবে আমাদের সরকারেরও একটা গাইডলাইন থাকা উচিৎ।
বিয়ের এই অস্বাভাবিক জাঁকজমক ও লোকসমাগম কমিয়ে দিয়ে অনেক সুন্দর করে এবং অন্যভাবেও বিয়ের আয়োজন করা যায় নদীতে, পার্কে বা কোন খোলা জায়গায়। এমন একটা বিয়েই করতে যাচ্ছে শ্রাবস্তী এবং আবির। তাদের বিয়ে হবে সুন্দরবনের লে অক্টোবরে। ওঠার আগে বিয়ের বাড়ি থেকেই সবার করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিবে বলেও পরিকল্পনা করেছে। বাবা মাসহ কিছু কাছের মানুষ ও কাছের বন্ধুরা থাকবে। এজন্য তারা বেছে নিয়েছে একটি চাঁদনি রাত। এতে যা খরচ হবে, তা তেমন কিছুই না। বাকি বাজেটের একটা অংশ তারা নিজেদের জন্য রেখে, বাকিটা দিয়ে দেবে একটি স্কুলে। আমরাও চাই নতুন স্বাভাবিক জীবনে মানুষ অন্যভাবে বিয়ের আনন্দটা ভাগ করে নিক সমাজের সবার সাথে, শুধু জাঁকজমকে নয়।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন