হিটলারকে হত্যা পরিকল্পনার জন্য যখন রবীন্দ্রনাথের ‘নাতিকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল
জার্মানির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। ওই বছরের জানুয়ারির শেষে নাৎসি পার্টির নেতা অ্যাডলফ হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলার পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট পল ফন হিন্ডেনবার্গ। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই জার্মানির পার্লামেন্ট রাইখস্টাগে আগুন দেওয়া হয়। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার খর্ব করার সুযোগ পান হিটলার।
রাইখস্টাগে আগুন দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয় কমিউনিস্টদের। হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহচর ও প্রভাবশালী মন্ত্রী হারম্যান গোয়েরিং দাবি করেন, আগুন দেওয়ার আগে বিমান থেকে রাজধানী বার্লিনের বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্টরা লিফলেট ফেলেছে। এরপর রাষ্ট্রপতির এক ডিক্রির মাধ্যমে, সমাজতন্ত্রীদের ধরপাকড়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এই দুর্দশা নাৎসিদের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাস্তা কাঁটামুক্ত করে।
তারা যেভাবে চেয়েছিল, ঠিক তেমনি করেই এসব ঘটনায় স্থানীয় কমিউনিস্টদের সাথে তাদের সংঘাত শুরু হয়। তবে বৈশ্বিক কমিউনিস্টদের (বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের) পাল্টা প্রতিশোধের ভয়ও পাচ্ছিল নাৎসিরা।
এই অবস্থায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপরতা বাড়ায়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা যানবাহন খুঁজতে থাকে জার্মান পুলিশ। ১৯৩৩ সালের ২২ এপ্রিল সকালে পুলিশ সদস্যরা ইতালির পতাকাবাহী একটি মোটরকার থামায়। অস্ট্রিয়ার টাইরল থেকে গাড়িটি জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশে প্রবেশ করেছিল।
দামি গাড়িটির যাত্রী ছিলেন দীর্ঘাকায় এক পুরুষ। যানটির শোফার বা চালক ছিলেন ভেগাসেক নামের রাষ্ট্র পরিচয়হীন একজন জার্মান-রাশিয়ান।
হিটলারকে হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে দীর্ঘাকৃতির ওই ব্যক্তিকে আটক করে ব্যাভারিয়ার পুলিশ। তৎকালীন জার্মান গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, এই ব্যক্তি হচ্ছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক নাগরিক। নাম তার 'ট্যাগোরি'।
গণমাধ্যমের রিপোর্টগুলো অচিরেই নজরে আসে মিউনিখে ব্রিটিশ কনস্যুলেটের। বিষয়টি জানতে তারাও সচেষ্ট হয়। মিউনিখে ব্রিটিশ কনসাল-জেনারেল ডোনাল্ড গেইনার এবিষয়ে চিঠি দেন জার্মানিতে নিযুক্ত তার দেশের রাষ্ট্রদূত হোরাস রামবোল্ডকে।
চিঠিতে বলা হয়, "গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে আমার ধারণা। জন্মসন ১৯০১ কলকতা। ১৯২৭ সনের ১১ মার্চ কলকাতা থেকে তার জন্য ব্রিটিশ-ভারতীয় পাসপোর্ট নং - ৫১১ জারি করা হয়। সংবাদপত্রে আটককৃত ব্যক্তির দীর্ঘদেহী হওয়ার যে বর্ণনা রয়েছে, তার সাথে কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায় আমার উল্লেখকৃত ব্যক্তিও ৬ ফুট উচ্চতার। ওই লোকটির পরিচয় এবং তাঁকে গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দিতে আমি বাভেরিয়ার (প্রাদেশিক) সরকারকে অনুরোধ করেছি।"
সৌমেন্দ্রনাথ ছিলেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। সেই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরও নাতি। সাম্যবাদী বিপ্লবী, লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত সৌমেন্দ্র ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিলেন। এজন্য ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের মনে তাঁকে নিয়ে সন্দেহ কাজ করতো। সৌমেন্দ্রর নাম যে তথাকথিত "কালো-তালিকাভুক্ত ভারতীয়"-দের মধ্যে রয়েছে সেটি চিঠিতে সবিশেষ উল্লেখ করেন গেইনার।
ইউরোপে বিপ্লবী
ঠাকুর পরিবার বড় হলেও – সবার মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল ঘনিষ্ঠ। এই পরিবারেই জন্ম নেওয়া সৌমেন্দ্র কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই নাম লেখান রাজনীতিতে। শ্রমিক কৃষক দলের একজন সম্ভাবনাময় সদস্য হিসেবে তিনি অবিভক্ত বাংলার পাটকল কর্মীদের নিয়ে সফলভাবে আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। এই তৎপরতার কারণেই তার ওপর নজর পড়ে ব্রিটিশ শাসকদের। সৌমেন্দ্রনাথ জানতেন, অচিরেই ঔপনিবেশিক প্রশাসনের রোষানলের শিকার হতে হবে তাঁকে। এজন্য পাসপোর্ট পাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তিনি ভারতবর্ষ ছেড়ে ইউরোপে পালান।
ইউরোপের নানান দেশে ঘুরে বেড়ান সৌমেন্দ্র। বার্লিন ও প্যারিসে গিয়ে সেখানকার বরেন্য কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগও করেন। ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে মস্কো যান। সেখানে তিনি ভারতবর্ষের কৃষক সংগ্রাম এবং তাদের শোষণে ব্রিটিশদের তাবেদার শহুরে অভিজাত সমাজের ভূমিকা নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
সৌমেন্দ্রনাথ বলেন, "ইতিহাসে কখনোই ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মনোভাব পোষণ করেনি। (ঔপনিবেশিক) সংবিধান/ আইনের সীমা অতিক্রম করার মতো কোনো প্রতিবাদ তারা করেনি, এমনকী আন্দোলন-সংগ্রামের সংকটকালে তারা এমনকি আন্দোলনের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে সম্পর্কে যারা ভালোভাবে জানেন (যেখানে নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতে) – তাদের জানার কথা সামন্তবাদের সাথে ভারতীয় বুর্জোয়াদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। একারণেই তারা জনমানুষের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারে না; এবং কৃষিখাতেরও সংস্কার করতে পারে না, কারণ সেটা তাদের স্বার্থহানি করবে। তাই ভারতে কৃষি বিপ্লব সংঘটিত করতে তারা জনসাধারণকে জাগ্রত করবে এবং নেতৃত্ব দেবে – তাদের থেকে এমন প্রত্যাশা করাও যায় না।"
নাৎসিদের কারাগারে
১৯৩৩ সালের ২৬ এপ্রিল অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক প্রতিবেদনে ভুল করে লেখা হয়, "বিখ্যাত কবি স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেকে" হিটলারকে হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি আরো জানায়, অস্ট্রিয়ার টাইরলের ফ্রন্টিয়ার্ড গার্ড বাহিনী জার্মান পুলিশকে তার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিল। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তার গাড়িতে 'সন্দেহজনক লাগেজ" পেয়েছে।
এপির ওই প্রতিবেদনকে সূত্র ধরে অন্যান্য সংবাদপত্রও খবর ছাপায়। এরমধ্যে অন্যতম ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ইভনিং স্টার পত্রিকা। পরে পত্রিকাটিকে একটি চিঠি দিয়ে ভারতীয় নারীবাদী মায়াদেবী গাঙ্গুলি জানান, সৌমেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ছেলে নন। বিশ্বকবির এই নারী বন্ধু আরো জানান, রবীন্দ্রনাথের ছেলে হলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার বয়স ৪০ বছর। অন্যদিকে, গণমাধ্যমটি গ্রেপ্তারকৃত তরুণের বয়স ২১ বছর বলে জানিয়েছে।
"এহেন অভিযোগ থেকে কবির ছেলের নাম মুক্ত করাকে আমি নিজের দায়িত্বজ্ঞান করছি, এটি সংশোধন না করলে তার নামে অহেতুক কালিমালেপন করা হবে" – লেখেন তিনি।
তবে এপির প্রতিবেদনের সুবাদে গ্রেপ্তারের খবর ভারতেও জানাজানি হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল সৌমেন্দ্রনাথের মা চারুবালা শিমলায় (ব্রিটিশ) ভারত সরকারের পররাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দপ্তরে একটি টেলিগ্রাম করেন।
এতে বলা হয়, "আমার ছেলে সৌমেন্দ্রকে মিউনিখে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এবিষয়ে আপনাদের অবস্থান জানলে বাধিত হব এবং ভারত ও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিনিধিত্ব করা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করার অনুরোধ করছি। আমার ঠিকানা: ৮ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, জোড়াসাঁকো।"
এই মামলার বিস্তারিত খোঁজ রেখেছিলেন ব্রিটিশ কনসাল-জেনারেল। ২৭ এপ্রিলে এক খসড়ায় গেইনার লিখেছেন, "চ্যান্সেলারের প্রাণনাশে কমিউনিস্টদের কথিত তৎপরতার সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহে মিউনিখের পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁকে (সৌমেন্দ্রনাথ) রাখা হয়েছে। তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে আটক থাকতে হবে, তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এখনও গঠন করা হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসেবে তার নাম লিখেছে পুলিশ। বিষয়টির সম্পূর্ণ অগ্রগতি জানাতে আমি বাভারিয়ার সরকারকে অনুরোধ করেছি।"
পরের দিনই সৌমেন্দ্রকে ছেড়ে দেয় বাভারিয়ার পুলিশ। বিন্দুমাত্র দেরী না করে তিনি মিউনিখ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় প্যারিসে চলে যান। ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে তার মুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছিল কিনা– সেটি স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে দুই- বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী ওই সময়ে দুই দেশের (জার্মানি ও যুক্তরাজ্য) মধ্যে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকায় এমন ভূমিকার থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কারণ সৌমেন্দ্রনাথ ছাড়া পাবার পরেই বার্লিনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রামবোল্ড বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টান্টিন ফন নিউরাথের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাঁকে জানান, "মিথ্যা তথ্য প্রচারের দায়ে" ওই ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। গেইনার আরো বিস্তারিত জানতে সৌমেন্দ্রনাথের সাথে কথাও বলতে চেয়েছিলেন, তবে ততক্ষণে প্যারিসে চলে গেছেন সৌমেন্দ্র।
সৌমেন্দ্রর ভাগ্য ভালো ছিল যে, তখনও নাৎসিদের কুখ্যাত গেস্টাপো নামক পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়নি। পরে গোয়েরিং গেস্টাপো গঠন করেন। গেস্টাপোর হাতে পড়লে স্ব-স্বীকৃত এই সাম্যবাদীর অবস্থা সঙ্গিন হতো।
১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ-বিরোধী এক সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে জার্মানিতে তার গ্রেপ্তার ও হয়রানি সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দেন সৌমেন্দ্র। তিনি বলেন, "হিটলারকে হত্যা পরিকল্পনার এক উদ্ভট অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ বার্লিনে আমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছুই জানতো জার্মানির পুলিশ, তাদের জানা ছিল আমার রাজনৈতিক দর্শন ব্যক্তি-সন্ত্রাসবাদের বিরোধী। কিন্তু রাইখস্টাগের অগ্নিকাণ্ড ও বার্লিনের আকাশে বিমানযোগে অভিযানের মতোই (বানোয়াট অভিযোগে) আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের লক্ষ্য ছিল উস্কানি।"
ভারতবর্ষে ফেরা
১৯৩৪ সালে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন সৌমেন্দ্র এবং একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যা পরবর্তীকালে রেভ্যুলেশনারী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (আরসিপিআই)-তে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত বিভিন্ন সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন।
রাজনীতির পাশাপাশি সৌম্যেন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চা ও সংগীতচর্চা করে গেছেন আজীবন। লিখেছেন অনেক বই। এরমধ্যে ভারতীয় রেনেসাঁয় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে লেখা বই অন্যতম।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেন। নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট হলেও তিনি সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অন্যান্য কমিউনিস্টদের অন্ধের মতো অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি ছিলেন, সোভিয়েত নেতা স্টালিনের কট্টর সমালোচক। যেমন কোরীয় যুদ্ধ শুরু হলে তিনি লেখেন, "গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করা যেকোনো দেশের জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের মতই স্টালিনের সম্প্রসারণবাদও এক ভয়াবহ বিপদ।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ