ঋণের তৃতীয় কিস্তি দ্বিগুণ করেছে আইএমএফ, জুনভিত্তিক রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় কিস্তিতে পূর্ব নির্ধারিত অর্থের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ ছাড় করার বিষয়ে স্টাফ লেবেল চুক্তিতে পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একইসঙ্গে জুন নাগাদ নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ ফ্লোরের লক্ষ্যমাত্রা ২০.১০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৪.৭৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়েছে।
চলতি মে মাসে তৃতীয় কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশকে ৬৮১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার কথা ছিল আইএমএফের। তবে স্টাফ লেবেল চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন পাবে ১ হাজার ১৫২ মিলিয়ন ডলার, যা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে ৬৯ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান আইএমএফের মিশনের টিম লিডার ক্রিস পাপাজর্জিও।
তিনি বলেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে আইএমএফ এর নির্বাহী বোর্ডের সভায় এই স্টাফ লেবেল এগ্রিমেন্ট অনুমোদনের পর ঋণের তৃতীয় ছাড় করবে সংস্থাটি।
ঋণের তৃতীয় কিস্তির পরিমাণ বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো পূরণ করতে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপে সংস্থাটির কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট হয়েছে।
"তাছাড়া, আইএমএফ টিমের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করার সময় আমরা তাদের বোঝাতে পেরেছি যে, ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার চুক্তি বহাল রেখেও এখন কিস্তির পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের এই মুহূর্তে ডলারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তাই তৃতীয় কিস্তিসহ আগামী দুটি কিস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে পরবর্তী কিস্তিগুলোর সঙ্গে তা সমন্বয় করার ওপর গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশ" - যোগ করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, "শর্ত পূরণে আমাদের সফলতা তুলে ধরার পাশাপাশি আমাদের এই মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তাদের বোঝাতে পারার কারণে তৃতীয় কিস্তিতে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।"
বাংলাদেশ আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাইটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) ব্যবস্থাপনার আওতায় এই ঋণ পাচ্ছে। তবে এই তহবিল থেকে তৃতীয় কিস্তিতে কী পরিমাণ অর্থ ছাড় করা হবে সেটি এই মুহূর্তেই জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার একসঙ্গে তিনটি সার্কুলার জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার আইএমএফ এর সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অনুরোধ ও চাহিদার প্রেক্ষিতে, আইএমএফ তৃতীয় কিস্তির পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিতে সম্মত হয়েছে। তবে এটা আইএমএফ আগেও বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে করেছে।"
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমতে থাকার মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে আইএমএফের সাথে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাতটি কিস্তিতে এই ঋণ ছাড় করা হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের প্রথম কিস্তি ছাড় করে। আর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় করে।
এদিকে নতুন স্টাফ লেবেল চুক্তিতে নেট রিজার্ভের পরিমাণ কমালেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কমায়নি ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতাটি।
সংবাদ সম্মেলনে এক লিখিত বিবৃতিতে আইএমএফ দুর্বল অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে তুলে আনার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে বলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরও অর্থের চাহিদা রয়েছে এবং সরকারের উচিত হবে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যথাযথ কৌশল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা।
এ ছাড়া টেকসই আর্থিক খাত তৈরিকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে চলমান ঝুঁকিভিত্তিক তদারকব্যবস্থার কাজটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। একইসঙ্গে কর্পোরেট সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর উন্নতি করতে আইনি সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চালিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সরবরাহে স্থানীয় পুঁজিবাজার অত্যাবশ্যক ভূমিকা রাখবে, সেজন্য এর উন্নয়ন করতে হবে।
মুদ্রার বিনিময় হারে সামঞ্জস্য আনা এবং একইসাথে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। মুদ্রার বিনিময় হারে আরো নমনীয়তা এনে বৈদেশিক রিজার্ভের স্থিতিস্থাপকতা ফেরানোর লক্ষ্য অন্তর্বর্তীকালীন আরও কিছু পদক্ষেপকেও স্বাগত জানায় সংস্থাটি।
আইএমএফ বলেছে, খুচরা সুদের হার উদারীকরণের পরে – মুদ্রানীতিতে আরো কিছু সংকোচনমূলক পদক্ষেপ বিনিময় হার সংস্কারের ফলে যে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হবে – সেটি কমাতে সহায়তা করবে।
বহুপাক্ষিক ঋণদাতা বিনিময় হার পুনরুদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একই সাথে বাহ্যিক স্থিতিস্থাপকতা পুনরুদ্ধারের জন্য বৃহত্তর বিনিময় হার নমনীয়তার দিকে একটি ক্রান্তিকালীন পদক্ষেপ হিসাবে একটি ব্যান্ড সহ একটি ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। খুচরা সুদের হারের উদারীকরণের পর, মুদ্রানীতির অতিরিক্ত কড়াকড়ি বিনিময় হার সংস্কারের ফলে যে কোনো মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
লিখিত বিবৃতিতে আইএমএফ আরো বলেছে, "রাজস্বভিত্তিক সংহতির মাধ্যমে রাজস্ব নীতির উচিত হবে মুদ্রানীতির সংকোচনমূলক পদক্ষেপগুলোকে সহায়তা দেওয়া। যদি বাহ্যিক ও মূল্যস্ফীতিজনিত চাপগুলো তীব্র হয়, তাহলে নীতি আরো সংকোচনের জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুত থাকতে হবে।"
বিবৃতি পাঠ করার সময় ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, নীতি পদক্ষেপগুলোর প্রভাব পড়া শুরু হলে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। চলমান আমদানি সংকোচন ও নীতি সংকুলানের ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাঝারি ধরনের বা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।
তবে আমদানি বাড়লে ও বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের চাপ কমলে ২০২৪-২৫ সালে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইএমএফ মনে করে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি হার প্রায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ থাকবে, এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে। সংকুলানমূলক নীতি এবং বৈশ্বিক খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের যে প্রক্ষেপণ রয়েছে তার সমন্বয়ে এটি হতে পারে। তারপরেও সার্বিক পূর্বাভাস সম্পর্কে অনিশ্চিয়তাঁর পরিমাণ অনেক বেশি - যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত সম্পর্কে আইএমএফ বলেছে, সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের জন্য টেকসইভাবে রাজস্ব আহরণে অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক। এজন্য বাস্তবসম্মত করনীতি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলোকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে করে জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব বাড়ানো যায়।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, মহামারি-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেশি ছিল। তারপর থেকে দ্রুত কমতে শুরু করে। মূলত বাহ্যিক চাপ, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের সংকোচন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন আইএমএফ টিম লিডার। নতুন নমনীয় বিনিময় হার কার্যকর হলে এই চাপ ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে জানান তিনি।
টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে কি-না, এমন প্রশ্নে আইএমএফ কর্মকর্তারা জানান, কিছু পলিসির কারণে মনে হতে পারে যে, মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। কিন্তু আমরা আরও এমনকিছু পলিসির ওপর জোর দিয়েছি, যাতে দরিদ্রদের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতির নমনীয়তাকে 'ট্রানজিশনাল মেজার্স' হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএমএফ।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। তবে এটা পরবর্তীতে স্থিতিশীল হয়ে যাবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমে ৫.৫ শতাংশে নামতে পারে।
চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রাক্কলন আগের ৫.৭ শতাংশ থেকে ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে আইএমএফ। এর কারণ জানতে চাইলে সংস্থাটি বলেছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।
আইএমএফ কেন বাংলাদেশের অর্থপাচার ও করফাঁকি নিয়ে কথা বলছে না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে টিম লিডার বলেন, যদিও আইএমএফ এর ঋণ কর্মসূচির শর্তে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবুও অর্থপাচার ও কর ফাঁকি রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছেন তারা।
ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় আসে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। গতকাল রাতেই তাঁরা ঢাকা ত্যাগ করেন।
সফরকালে অর্থপ্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বেশকিছু বৈঠক করেছে আইএমএফ মিশন। বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, স্থানীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সাথেও তাঁরা বৈঠক করেছেন।