মহামারি? কিসের মহামারি? সরকারি চাকুরিজীবীদের দুশ্চিন্তার কী!
মহামারিকালে দেশে বেসরকারিখাতের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে উঠেছে; কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কর্তন। সে তুলনায় প্রায় নির্ভাবনায় দিন কাটছে সরকারি চাকুরিজীবীদের। মহামারির মধ্যেও নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত বেতন-ভাতার জোয়ারে- আনন্দেই যেন দিন কাটছে তাদের।
এমনকি কোভিড-১৯ সঙ্কট সরকারের রাজস্ব আয় কমালেও, তার উত্তাপ থেকে দূরেই আছেন সরকারি কর্মীরা।
বিপরীত চিত্রটাই বরং বেশি দৃশ্যমান। নিয়মিত পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, মাসে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ; সবই মিলছে সাধারণ ছুটির সময় দাপ্তরিক কাজে অংশ না নিয়েই। সাথে কোভিড-১৯ উপলক্ষে দেওয়া বিশেষ ক্ষতিপূরণও পাচ্ছেন। আরও আছে, সরকারের ভর্তুকি দেওয়া বিশেষ ঋণ সুবিধায় ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার সুবর্ণ সুযোগ।
রবি ঠাকুরের স্বর্ণ মৃগের চাইতেও মূল্যবান- মহামারিকালে বাংলাদেশের সরকারি চাকরি।
২০১০ সালে নতুন পে-স্কেল নির্ধারণের পর থেকেই, সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে প্রণীত জাতীয় মজুরি কাঠামো সরকারি কর্মীদের বেতন ও ভাতার পরিমাণ প্রায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। সাথে দেওয়া হয় অন্যান্য আর্থিক সুবিধা।
সবকিছু মিলিয়ে এখন জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশই বরাদ্দ করতে হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও সুবিধার পেছনে। চলতি অর্থবছরের বাজেট পরিধি পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৬৫ হাজার ৮৬০ টাকা দেওয়া হচ্ছে বেতন ও বিভিন্ন ভাতা বাবদ। আরও, ২৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে অবসরভাতা-গ্রাচ্যুইটি ইত্যাদির জন্য।
সরকারি চাকরির প্রতি দেশের যুব সমাজকে আকৃষ্ট করতে; দ্রুত পদোন্নতি, নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি, পেনসন, ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আর্থিক লাভের কলেবর প্রতিবছরই বাড়ছে। যোগ হচ্ছে নিত্য-নতুন সুবিধা। এত সুবিধাসহ কর্মসংস্থানের নিশ্চিত সুযোগের বিবেচনায়- মহামারিকালে বাড়ছে সরকারি চাকরির কদর।
অবশ্য, এত সুবিধা নিয়েও কিন্তু চলমান সঙ্কটের মাঝে জনগণের চাহিদা অনুসারে তাদের সেবা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন সরকারি কর্মীরা। কাগজে-কলমে জনতার সেবক হলেও, কাজেকর্মে তা দৃশ্যমান হয় না, খুব একটা।
প্রমাণ; দেশের ৫০ লাখ কর্মহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর আড়াই হাজার টাকা 'ঈদ উপহার' দেওয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি, ব্যাপক অনিয়মে প্রকৃত অভাবীদের তালিকা তৈরির ব্যর্থতার কারণে। প্রতি জেলায় ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত সচিবেরাও তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করেননি। পাশাপাশি দরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার- এক সপ্তাহ পরই ব্যাপক অব্যবস্থাপনা এবং দূর্নীতির কারণে স্থগিত রাখা হয়।
মহামারি পরিস্থিতিতে সরকারি দপ্তরগুলো যে আগের মতো কাজ করতে পারছে না; তা উঠে আসে- মন্ত্রী পরিষদ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব রওশন আরা লাবনী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে।
সকল সচিব এবং বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে গত ৪ জুলাই পাঠানো চিঠিটিতে বলা হয়, গত ২৬ মার্চের পর থেকে কোভিড-১৯ জনিত কারণে দেশের সরকারি দপ্তরের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে। এরফলে, চাকরির বার্ষিক কর্মতৎপরতা অঙ্গীকারের কিছু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
চিঠিটি আরও জানায়, এ অবস্থায় গত ২৫ মার্চের পর থেকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে, সব মন্ত্রণালয় এবং তাদের কর্মীদের ১০০'এর ভেতরে ৭০ নাম্বার দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ নীতি গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিৎ।
তিনি জানান, বিশ্বজুড়ে সরকারিখাতের কর্মীদের জন্য বেসরকারি খাতের চাইতে কম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কারণ বেসরকারি চাকরিতে বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি। অন্যদিকে, ২০১৫ সালের মজুরি কাঠামোর আওতায় বেতন ও অন্যান্য ভাতা দ্বিগুণ হওয়ার পর থেকেই দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা বেসরকারি খাতের কর্মীদের চাইতে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন।
''মহামারির তাণ্ডবে দেশের সাধারণ মানুষ যখন এক বড় সঙ্কটে নিপতিত, ঠিক তখনই বাড়ানো হচ্ছে সরকারি কর্মচারিদের প্রদত্ত সুবিধা। এরফলে, যেসব করদাতাদের টাকায় এসব কর্মীর বেতন দেওয়া হয়; তাদের কষ্ট বাড়ছে।'' যোগ করেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুরের অভিমত, মহামারির মধ্যে সরকারের ব্যয় সংকোচনের নানা উপায় বিবেচনা করা উচিৎ। পাশাপাশি যারা প্রত্যাশা অনুসারে জনসেবার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এখন তাদের দেওয়া সুযোগ-সুবিবা পুনঃমূল্যায়নের সময় হয়েছে।
সরকারি কর্মী হওয়ার সুবিধা:
দেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্তের পর গত ২৬ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এমনকি মধ্য-এপ্রিলে বাতিল করা হয় বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখ উদযাপন। তারপরও, সরকারি চাকরিজীবীরা কিন্তু ঠিকই বৈশাখী ভাতা পেয়েছেন।
এরপর গত ১ জুলাই একটি (ইনক্রিমেন্ট) ভাতা বৃদ্ধির পর- আসন্ন ঈদুল আযহা'র উৎসব ভাতাও পেতে চলেছেন তারা। ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে স্ফীত মূল বেতনের সঙ্গেই এসব ভাতা যোগ হচ্ছে।
চলমান সঙ্কটের মাঝে গত ৫ জুন ১২৩ জন উপ-সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে, যুগ্ম-সচিব করা হয়। এছাড়াও, ২৭ তম বিসিএসের ক্যাডারদের যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার আরেকটি উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
হরহামেশা পদোন্নতির কল্যাণে অনেক অতিরিক্ত সচিব এখন যুগ্ম-সচিবের দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৩-১৪ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মাত্র একজন অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। সেই সংখ্যা বর্তমানে উন্নীত হয়েছে পাঁচজনে। চারবছর আগে একজন যুগ্ম-সচিব বাণিজ্যিক সংগঠন পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতেন। এখন একজন অতিরিক্ত সচিবও পদোন্নতি পেয়ে একই দায়িত্ব পালন করছেন।
একইভাবে, পাঁচ বছর আগেও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান শাখায় কোনো অতিরিক্ত সচিবের পদ ছিলনা। যদিও, এখন সেই দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন পাঁচজন।
২০১১ সাল থেকে যুগ্ম-সচিবরা মোটরকার কিনতে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। ২০১৭ সাল থেকে ওই একই কারণে জনপ্রশাসন এবং অর্থনৈতিক ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তারা পাচ্ছেন ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ ।
মুদ্রাস্ফীতির হিসাব বাদ দিলে, এসব কর্মকর্তাকে আসলে মাত্র ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এপর্যন্ত তিন হাজার ৯৭১ জন কর্মকর্তা কার ক্রয়ের সুদমুক্ত ঋণ নিয়েছেন এক হাজার ১৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি গাড়ি চালকের বেতন, জ্বালানি খরচ এবং মেরামত বাবদ প্রতিমাসে পাবেন ৫০ হাজার টাকার বাড়তি বরাদ্দ।
এব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সরকারি পর্যায়ে বেতন-ভাতা কমানোর বিষয়ে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। তাছাড়া, সরকারি কর্মচারীরা মহামারির মাঝেও অফিস করছেন, দাবি করেন তিনি।
অর্থনৈতিক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানও বলেন, সরকারি কর্মচারীদের প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা কমানো নিয়ে কোনো আলোচনা এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি।
(সংক্ষেপিত)
মূল লেখা: Pandemic? What pandemic? No tension for govt employees
অনুবাদ: নূর মাজিদ