ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পশ্চিমাদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রভাব কী হতে পারে?
আত্মরক্ষার অজুহাতে গাজা উপত্যকায় চলছে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন ও গণহত্যা। আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটা চলছে এখনো।
বেশ কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানালেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা খুব দ্রুত ও সহজে হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে, তা কিন্তু না। এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, মেলাতে হবে নানা জটিল প্রশ্নের উত্তর।
গাজায় চলমান সংঘাতের মধ্যে সর্বশেষ তিনটি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশ তিনটি হলো আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে। তাদের এ ঘোষণা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর ওপরও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়েছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এখনও এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে।
একজন আরব কূটনীতিক বলেছেন, 'এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা প্রমাণ করে যে ইসরায়েলি সরকার সহিংসতা বন্ধে কারো কথা না শোনায় হতাশ ইউরোপিয়ানরা।'
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নিয়ে একেক রাষ্ট্রের একেক অবস্থান থাকলেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একমত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ প্রতিনিধি সোভেন কোপম্যানস বলেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থাকতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাদের ঐক্যমত রয়েছে।'
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেনের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন ইইউর এ বিশেষ প্রতিনিধি।
তবে ইসরায়েলি মন্ত্রীরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, এটি হামাসকে আরও সন্ত্রাসবাদে উৎসাহিত করবে এবং আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির সম্ভাবনাকে আরও হ্রাস করবে।
এখন পর্যন্ত ১৩৯টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
চলতি মাসে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘে যোগদান বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক ভোটাভুটি হয়। সেই ভোটাভুটিতে ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪২টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
ফিলিস্তিনের বর্তমানে জাতিসংঘের অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা থাকলেও সাধারণ পরিষদে ভোটের ক্ষমতা নেই। তারা আরব লীগ এবং অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত।
ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, সুইডেন, সাইপ্রাস এবং মাল্টা।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইউরোপীয় দেশের মতে মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি ও চলমান সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধানের অংশ হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান অপরিহার্য, যেখানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়ই তাদের নিজস্ব সীমানা সহ স্বাধীনভাবে পাশাপাশি বিদ্যমান থাকবে।
ফিলিস্তিনকে কখন স্বীকৃতি দেওয়া উচিত তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ের মতে, তারা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাতে অন্যান্য দেশগুলোও এগিয়ে আসে। তাদের যুক্তিতে, উভয় পক্ষই রাজনৈতিক সহাবস্থানের দিকে লক্ষ্য রাখতে পারলেই বর্তমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান হবে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এই দেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপও সামাল দিতে হচ্ছে।
অতীতে, অনেক পশ্চিমা দেশ মনে করত একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তির পরেই ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্ব পাওয়া উচিত। তবে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব লর্ড ক্যামেরনসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ তাদের মতামত পরিবর্তন করেছে। তারা এখন বিশ্বাস করে যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দ্রুত স্বীকৃতিই একটি রাজনৈতিক মীমাংসা নিয়ে আসবে।
ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ফ্রান্সের সমস্যা নেই, তবে এখনই এটি করার সময় নয়।
তবে এই মাসের শুরুতে, ফ্রান্স সাধারণ পরিষদের ভোটের সময় জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ সমর্থন করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয় নিয়ে এখনও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই দেশগুলো কবে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে এটিই এখন মূল প্রশ্ন। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে কখন শান্তি চুক্তি হবে, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে কবে ও কীভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হবে, ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রকৃতি, জেরুজালেমের কী হবে এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ভবিষ্যতই বা কী, এরকম নানা বিষয়ের ওপর ফিলিস্তিনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নির্ভর করছে।
অনেক দেশই আছে যারা ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে একটি কূটনৈতিক বিজয়ের শরিক হতে চায়।
একজন পশ্চিমা কর্মকতার মতে, 'এটি একটি ট্রাম্প কার্ড, যেটি সকল পশ্চিমা দেশ খেলতে চায়। আমরাও এটা নষ্ট করতে চাই না।'
তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য কিছু বিষয়ের মীমাংসা অতীব জরুরি। যেমন— স্বাধীন ফিলিস্তিনের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত হবে, রাজধানী কোথায় হওয়া উচিত কিংবা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে উভয় পক্ষ কী পদক্ষেপ নেবে প্রভৃতি। এই প্রশ্নগুলো কয়েক দশক ধরেই অমীমাংসিত।
ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ এখন মনে করে যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হওয়া উচিত। হয়ত ফিলিস্থিনপন্থীরা এই পদক্ষেপগুলো উদযাপন করবে বা বিরোধীরা এর নিন্দা করবে। তবে ফিলিস্তিনিদের এই কঠিন পরিস্থিতি অবিলম্বে পরিবর্তিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন