মৃত্যুর মিছিল
১২.
নদী তীর, ভেড়ার খোঁয়াড়, মাইন বসানো সেতু থেকে নদীর পাড় ধরে অনেকখানি দূরে সরে এলো ওরা। উজানে গেলে খামার বাড়ি পাশ কাটাতে হতো, তখন হয়তো খামারীরা ভেড়া চুরি করে এইমাত্র উড়ন্ত ভেড়ার স্ট্যুতে পরিণত হওয়াার জন্যে দায়ী লোকদের তালাশ করতে হারেরে হাঁক ছেড়ে তেড়ে আসত।
অদূরে একটা ক্ষুদে ফুটব্রিজের হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তো আছেই।
নদীর বরার ক্ষিপ্র গতিতে, যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে ছুট লাগিয়েছে ওরা। নতুন করে কোনো শব্দ কানে না এলেও তারিক নিশ্চিত ওদের পিছু ধাওয়া চলছে। এদিককার গ্রামবাসীদের সন্দেহজনক কোনো আনাগোনা দেখলে খবর দেয়ার নির্দেশ দেয়া আছে নিশ্চয়ই। নিজেকে সহজ মানুষ ভাবলেও ওর উঠোনে বিস্ফোরিত ভেড়ার টুকরাটাকরা ছিটকে পড়লে নির্ঘাৎ স্থানীয় মিলিশিয়াকে খবর দিত ও।
অবিরাম এগিয়ে চলল ওরা। অবশেষে তীব্র খর¯্রােতা নদীর কিছুটা প্রশস্ত হয়ে শান্ত হয়ে এলো। আবার পাথরের দেখা মিলল। শেষমেশ হাঁটু পর্যন্ত গভীর পানি ভেঙে আগে বাড়ল ওরা। পাথরের ভাঙাচোড়া ফোকরে গা ঢাকা দেয়ার মতো একটা জায়গা পাওয়া গেল। ওরা থামতেই তারিকের জুতোয় ঢুকে পড়া হিমশীতল পানি কামড় বসাল।
দূর থেকে আর্টিলারির গমগম আওয়াজ শোনা ভেসে আসছে। কিন্তু ওরা একেবারে চোখের আড়ালে থাকায় রাতের মেঘে ঢাকা আকাশে আলোর ঝলকানি চোখে পড়ছে না।
আরো জেট বিমান উড়ে গেল ওদের মাথার উপর দিয়ে। ওদের পেশাদারিত্বের তারিফ না করে পারল না তারিক। পাহাড়পর্বতে ভরা এলাকায় নিচ দিয়ে ধীর গতিতে উড়ছে। রাশিয়ানরা বিরোধের একটা পক্ষকে গোপনে অস্ত্রের যোগান আর ট্রেনিং দিচ্ছে, সেটা ওদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাদে বোধ হয় বাকি দুনিয়ার কারো অজানা নেই। ওই পেশাদার জেট জকিদের মস্কো বা সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আমদানি করার ব্যাপারে ওর মনে কোনো সংশয় নেই।
চট করে উষ্ণ এবং শুকনো থাকার সময় ব্রিফিংয়ের কথা মনে পড়ল ওর, তখন তিনজনের জায়গায় পাঁচজন ছিল ওরা। আজরাতে ¯্রফে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে হবে ওদের।
হয়তো সম্ভব।
ওরা তিনজন বসে জমিন আর পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। ধীরে ধীরে দম ফিরে পাচ্ছে। 'তুমি জানতে,' বলল আলীয়া। 'একটা কিছু গড়বড় থাকার কথা তুমি জানতে, তাই না?'
'ওই ব্রিজটাই।'
'তা বুঝলাম, বস, কিন্তু ব্রিজের কোন জিনিসটা?' জানতে চাইল ও।
'সদ্য কাটা কাঠের গন্ধ পেয়েছি,' বলল ও। 'তার মানে ইদানীং বানানো হয়েছে ওটা। তাছাড়া যেকোনো খামারী বা গ্রামবাসীর পক্ষে ভুল জায়গায় ছিল ওটা। খোলা ট্রেইলের কাছাকাছি কিংবা রাস্তার কাছে, কিংবা আন্য কিছুর কাছাকাছি নয়। ¯্রফে আমাদের জন্যে পাতা ফাঁদ ছিল ওটা।'
'শালা!' বলল বোরোযান।
কথা বলে উঠল খালিদ। 'হঠাৎ আবোলতাবোল বকতে শুরু করলে কেন?'
'কি বলতে চাও?' বলল আলীয়া বোরোযান।
'কি বলেছি, শুনেছ,' বলল খালিদ। 'ফালতু কথা বলছ কেন? আমার তো ধারণা তোমার আত্মীয়স্বজনদের এমনি চালাকি দেখানোয় তোমার মুগ্ধই হওয়ার কথা।'
শরীরের ভর বদল করে আলীয়া বলল, 'কথাটা তোমাকে খোলাসা করতে হবে, খালিদ। নইলে ঠিক এখানে, এখনই তোমাকে নরক যন্ত্রণা দেব।'
হেসে ফেলল খালিদ। 'এখানে লুকোনোর কি আছে? তোমার পদবী বোরোযান। সার্বিয়ান নাম এটা, তাই না? ইউরোপের এদিকটা আবার ক্ল্যান, পরিবার, গোত্র, এসবে ফিরে যাচ্ছে, কবে কখন পাঁচশো বছর আগে একজনের পরিবার আরেকজনের পরিবার নিয়ে মন্দ কথা বলোছিল, সেই কারণে এখন একজন আরেকজনের কল্লা কাটছে। তুমিই বা বাদ থাকবে কেন? এখানে তোমার পরিবারের লোকজন আছে, যাদের সাহায্য করতে চাও, তাই না?'
'কথাটা এখুনি তুলে নাও, খালিদ,' নিচু ফিসফিস কণ্ঠে বলল আলীয়া। 'অন্তত কয়েক দশক আগে আমার পরিবার এখান থেকে পাড়ি জমিয়েছে।'
'তাতে কি, তোমার পরিবারের লোকজন এখনো এখানে আছে, ঠিক? যাদের সাহায্য করতে চাইতেই পারো। ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে চাইতে পারো? লোকে কি বলে জানো না? রক্ত নাকি জলের চেয়ে ঘন।'
'দাঁড়াও, দেখাচ্ছি রক্ত কি জিনিস, হারামজাদা,' বলল বোরোযান।
কিন্তু আলীয়াকাছাকাছি থাকায় ও নড়ে উঠতেই ওর মাথায় একটা চাটি মেওে দিল তারিক।
আর্তনাদ করে একটা পাথরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও।
পরক্ষণে বাম হাত ক্ষিপ্রবেগে ঘুরিয়ে খালিদে গালে একটা চড় কষাল ও।
শ্রেফ ওর মাঝে বৈষম্য নেই প্রমাণ করতেই।
১৩.
পাথরের ফোকরে বসে রইল ওর দুই সঙ্গী। হতভম্ব, নীরব।
ভালো।
উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
ওদের মনোযোগ পেয়ে গেছে তারিক।
'কিভাবে কাজটা হবে, শোনো। আমার কথা শেষ হলে ¯্রফে হ্যাঁ কিংবা না বলবে। আর কোনো কথা নয়,' বলল ও। 'আগামী নব্বই সেকেন্ডের মধ্যে এজায়গা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমরা তোমাদের ভেতর কার অভিবাসনের কাহিনী বেশি পুরোনো আর নিষ্পাপ সেটা নিয়ে মারপিট করতে চাইলে যতক্ষণ ইচ্ছা চালিয়ে যেতে পার। অথবা মুখ বন্ধ করে আমার সাথে কাজটা শেষ করতে যেতে পার। এই অপারেশনে এটাই তোমাদের শেষ সুযোগ। আমার সাথে যাচ্ছ? হ্যাঁ অথবা না?'
'হ্যাঁ, ওস্তাদ।'
'ইয়েস, বস।'
'চমৎকার,' বলল তারিক। 'তোমাদের গিয়ার পরখ করে হাঁটতে শুরু কর।'
কিন্তু পঁচাশি সেকেন্ড পেরুনোর মুহূর্তে কথা বলে উঠল খালিদ। 'বস, এটা কথা বলতে পারি?'
'ঝটপট করে ফেল।'
'আমি অজুহাত দেখাব না। দোষটা আমারই,' বলল সে। 'আ...আমার মাথার ঠিক ছিল না। এমন আর হবে না। মানে, আমরা এখানে আসার পর থেকে যা কিছু ঘটেছে আর-'
বাধা দিল তারিক। 'আমরা এখানে আসার ঢের আগেই গ্যাঞ্জাম শুরু হয়েছে।'
'বস?' বলল আলীয়া বোরোযান।
হেলমেটের স্ট্র্যাপ ঠিকমতো বেঁধে নিল তারিক। শীতল, ভেজা রাতে দলের জীবিত বাকি অবশিষ্ট দুই সদস্যের ভৌতিক চেহারাগুলো জরিপ করল। 'ইতালিতেই শুরু হয়েছে এটা। আমাদের ব্যাকআপ চপারটা শেষ হয়ে গেছে। নাইটস্টকাররা কোন চপারটা প্রাইমারি আর কোনটা সেকেন্ডারি তার সিদ্ধান্ত কিভবে নেয় জানো তো? কয়েন টস করে। ওটা আদৌ যান্ত্রিক ত্রুটি বা পাইলটের দোষ ছিল না। স্যাবটাজ ছিল। তো চপারের যে বারোটা বাজিয়েছে তার এই অপারেশন শুরুর আগেই শেষ করে দেয়ার চেষ্টা চালানোর পঞ্চাশ ভাগ আশঙ্কা আছে।'
আরবিতে ফিসফিস করে কিছু বলল খালিদ। বোরোযান কবলল, 'তারমানে ক্লেটনের প্যারাশ্যূটটা বিগড়ে যাওয়ার জন্যে কারিগরি ফলানো হয়েছিল। আমাদেরগুলো বিকল করতে পারত, কিন্তু সবগুলো প্যারাশ্যূট বিকল হলে সেটা বেশি সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়াত।'
'ঠিক বলেছ,' বলল তারিক। 'তারপর দেখ, জমিনে নামার পর থেকেই হয়রানির মুখে পড়েছি আমরা, পিছু ধাওয়া করা হচ্ছে। পথে একের পর এক দারুণ সব ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। আসলে আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল ওরা।'
চুপ করে রইল ওর দুই সঙ্গী।
'কিন্তু এখন আমাদের একটা সুবিধা রয়েছে,' বলল ও।
'কেমন?' জানতে চাইল বোরোযান।
'আমাদের সর্বনাশ করা হয়েছে জেনেও এই মিশন শেষ করতে যাচ্ছি আমরা। চলো, আগে বাড়ি।'
সময় নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছে না ও। মরুভূমির বুকে হাতের মুঠোর বরফের টুকরো মতোই দ্রুত পিছলে যাচ্ছে সেটা। এক বিরতির সময় আস্তে করে বোরোযানকে ও বলল, 'তোমার মুখের কি অবস্থা?'
'ফিরে যাওয়ার আগে বলতে পারছি না,' বলল ও। 'তবে তোমার কাছ থেকে এমনি স্নেহের পরশ আশা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।'
'দলের স্বার্থেই করতে হয়েছে কাজটা,' বলল ও।
দলের কপালে খুব বাজে এবং বেআইনি কিছু ঘটতে পারার আভাস দিল ও। আগে বাড়ল ওরা। খালিদের খোঁজ নেয়াও দরকার ছিল হয়তো, কিন্তু পরবর্তী কয়েক মিনিটের উত্তেজনায় কথাটা বেমালুম ভুলে গেল ও।
বনভূমি শেষ হয়ে বিশাল একটা ময়দানের শুরু হলো। ময়দানটা এত বিশাল যে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দূরত্ব আন্দাজ করতে পারল না তারিক। পাতলা হয়ে আসা বনের কিনারে থামল ওরা, মাঠের কিনারে ঝোপঝাড় জন্মেছে এখানে। অতি প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে থামল ওরা।
রাতের দেবতার মতো মাথার চারপাশে লাগানো চোখে ময়দানের চারদিক জরিপ করল ও। ওর দলের দুই সদস্যও তাই করল। বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে, তবে তুষারপাত শ্লথ হয়ে আসতে শুরু করেছে। ওদের সামনে তিনটা বিরাট আকারের খড়ের গাদা, একটা ট্র্যাক্টর, একটা ওয়্যাগন আর খড় কাটার যন্ত্রের মতো গোলাকার কিছু লাগানো আরেকটা বাহন দেখা যাচ্ছে। আলো, শব্দ বা কোনো ঘরবাড়ি নেই।
তারিকের হাতে ম্যাপ বেরিয়ে এসেছে। ওটার বুকে আঁকা খামারের বিশাল ময়দানটা দেখা গেল। জবুথুবু হয়ে দেখছে খালিদ এবং আলীয়াও। ওই ময়দান টপকে যেতে পারলে ভোরের আগেই লক্ষ্যে পৌছানোর মতো সুবিধাজনক একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে ওরা।
ম্যাপ সরিয়ে রাখল ও।
'আমরা মাঠটা পেরুতে পারলে কিছুটা সময় বাঁচানো যাবে,' বলল ও।
ওদের হেলমেটে টুপুরটাপুর বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমবারের মতো চুপ থাকল ওর সঙ্গীরা।
'আমার পছন্দ হচ্ছে না,' বলল বোরোযান।
'গুড,' বলল তারিক। 'কেমন বেখাপ্পা।
'বস?' জানতে চাইল বোরোযান। 'আমাদের বলা যায়?'
'খড়ের গাদাগুলো,' বলল ও। 'মৌসুমের বিচারে অনেক দেরিতে করা হয়েছে। শীত আসছে যখন, কৃষকরা ওদের যন্ত্রপাতি ওভাবে বাইরে খোলা জায়গায় ফেলে রাখতে যাবে না। খামারীরাও হয়তো লড়াইতে জড়িয়ে পড়ে থাকতে পারেৃকে জানে। কিন্তু ময়দানের উপর দিয়ে যাচ্ছি না আমরা।'
ওর বামে ইশারা করল তারিক। 'এইদিক দিয়ে যাব। ওদিকে ছোট একটা গ্রাম আছে। কিন্তু নাম মুখে উচ্চারণ করতে বলো না। আমরা হয়তো একটা গাড়ি বা ট্রাক হাতিয়ে রাস্তা অবধি যেতে পারব, তাতে কিছুটা সময় উদ্ধার করা যবে।'
'বিরাট গাড়ি চোর,' বলল খালিদ। 'লেবানন থেকে এসে তোমাদের সাথে যোগ দেয়ার সময় ওসব ছেড়ে দিয়েছি ভেবেছিলাম।'
ওরা আগে বাড়তে যেতেই বোরোযান বলল, 'আমাদের সবারই পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাই না?'
খালিদের গালে বসানো চড়টা ওর কি অবস্থা করেছে দেখতে যাচ্ছিল তারিক, তখনই ঘটল ব্যাপারটা। ক্ষীণ, ধাতব একটা শব্দ। ক্লিক।
জায়গায় জমে গেল ওরা।
'খালিদ?'
'আমি না, ওস্তাদ।'
খিস্তি করল বোরোযান। 'আমি, বস। মনে হয় একটা কিছুর উপর পা দিয়ে ফেলেছি। ধাতব মনে হচ্ছে। সুইচ অফ করে দিয়েছি বোধ হয়।'
খালিদও খিস্তি ঝাড়ল। 'ল্যান্ড মাইন?'
'কি জানি,' পাল্টা ধমকে উঠল আলীয়া বোরোযান। 'আমি পা সরালে নিলে কি ঘটে দেখতে চাও?'
'চুপ,' বলে জিনিসটা কি দেখতে নিচু হলো তারিক, তখনই আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারপাশ।
গাছপালার সীমানা এবং ঝোপ বরাবর একগুচ্ছ ফ্লেয়ার জ্বলে উঠল। তারমানে আদৌ ল্যান্ডমাইন মাড়িয়ে দেয়নি আলীয়া, কিন্তু ভালো কিছুও বলা যাবে না একে: এক সেট ফ্লেয়ার ময়দানসহ ওদের আলোকিত করে তুলেছে।
বলা নেই কওয়া নেই, কাছের একটা খড়ের গাদা থেকে আচমকা মেশিনগানের গুলি বর্ষণ শুরু হতেই ঝুপ করে বসে পড়ল ওরা। ট্রেসার ফায়ার ছড়িয়ে পড়ছে মাথার উপর।
একসাথে পাল্টা গালি চালাল ওরাও। একের পর এক ম্যাগাজিন খালি করছে। দরকার হলেই 'রিলোডিং' বলে উঠছে। ওদের গুলির চাপা শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে ধেয়ে আসা গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। তবে সমান তালেই পাল্লা দিচ্ছে ওরা। প্যারাশ্যূটে গোলমাল পাকানো বা সেতুতে মাইন পুতে রাখা অদৃশ্য কারও বদলে দৃশ্যমান শত্রুকে নিশানা করে গুলি করতে পারছে বলে একদিক থেকে স্বস্তি বোধ করছে ও।
ওদের তিনজনের ম্যাগাজিনেই ট্রেসার রাউন্ড ছিল। ওদের প্রতি ভাগ্য সম্ভবত সুপ্রসন্ন কিংবা বৃষ্টির পানি খড়ের গাদার বেশি ভেতরে ঢুকতে পারেনি, তো অচিরেই অগ্নিশিখা দেখা দিল। ঘন ধোঁয়ায় ভরে উঠছে ওদিকটা। লোকজন চিৎকার শুরু করল। তলে তলে আমোদ পেল ও, যদিও অন্যের দুর্ভোগে পুলকিত হওয়া ঠিক না।
খালিদের মাথায় একটা চাপড় কষাল ও। আবার নিচু হতে শুরু করল সে। ওর সাথে যোগ দিল তারিক। বোরোযানও তাই করল। বনের ভেতর পিছিয়ে আসার সময় ওদের দিকে আরও কয়েক রাউন্ড 'শুভেচ্ছা'র বুলেট পাঠাল ওরা। চকিতে ভীষণ যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল ওর পায়ে। টেরই পায়নি কখন যেন ডান পাটা একটা কিছুর সাথে হোঁচট খেয়েছে। আপাতত বর্তমান বধ্যভূমি থেকে দ্রুত সরে পড়ার তাগাদায় থাকায় পাত্তা দিল না ও।
কিছুক্ষণ বাদে দম ফিরে পাওয়ার পর পায়ের নিচের অংশ পরখ করল ও। রক্তে ভিজে গেছ।
ওর নিজের রক্ত।
গুলি খেয়েছে ও।
১৪.
ওদের গন্তব্য গ্রাম উপেক্ষা করে হাছড়েপাছড়ে পাথুরে প্রাচীর পেরিয়ে আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট, ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে পশ্চিমে পা চালাল ওরা। তাল মেলাতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে তারিক। ডান পায়ের নিচের দিকের অসহ্য যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করতে যুঝছে। প্যান্টের পায়ায় ভেজা ভেজা ভাবকে পাত্তা না দেওয়ার জানপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনটা লড়াইতেই গো-হারা হারতে বসেছে।
এক পর্যায়ে একটা মেঠো পথের ধারে ধসে পড়া একটা ছাপরার কাছে হাজির হলো ওরা। ভেতরটা পরখ করে আলীয়া বোরোযান ফিসফিস করে জানাল, 'ক্লিয়ার।' ওরা অল্প কজন পরিশ্রান্ত, তাই আশ্রয় নিল ওখানে। তারপুলিন আর কাঠের চালে ক্রমাগত আঘাত হানছে বরফ শীতল বৃষ্টির ফোটা। জায়গাটায় ধূলি আর শস্যে গন্ধ।
বসার সময় ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেল ওর। পায়ের কাজ শুরু করতে পিঠের উপর থেকে ব্যাটল প্যাকটা নামিয়ে মেডকিট বের করল। 'তুমি ঠিক আছো, বস?' জানতে চাইল আলীয়া।
'অবশ্য আগেই বেশি ভালো ছিলাম, তবে সামলে উঠতে পারব।'
'সাহায্য লাগবে?'
'লাগলে তোমাকেই বলব।'
যতদূর সম্ভব পরিষ্কার করে রক্ত ধুয়ে নিল ও। যেমন মনে হয়েছিল বুলেটের গর্তটা তারচেয়ে বেশ ছোট দেখে রোমাঞ্চিত বোধ করল। গোলাকার একটা টুকরো ডানপায়ের থোড়ের মাংস ভেদ করে চলে যাওয়ার সময় ভয়ঙ্কও দশা কওে গেছে। ক্ষত মুছে খানিকটা অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগানোর সময় যন্ত্রণায় চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর।
দুই টুকরো গজ কাপড় বসিয়ে আঁটোসাটো করে ব্যান্ডেজ বাঁধল। পুরোটা সময় বোরোযান আর খালিদ ছাপরার দেয়ালের ফোক দিয়ে বাইরে নজর রাখল।
ওকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, সমস্ত মনোযোগ পাহারায়। এমনই হওয়ার কথা।
তারিক জিনিসপত্র সরিয়ে রাখার সময় আলীয়া বোরোযান বলল, 'বেশ?'
'এগোনোর জন্যে রেডি,' বলল ও। 'তোমরা?'
বসে পড়ল আলীয়া। 'আমি ছোট থাকতে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ভাটিতে একটা দোকান ছিল। পুরোনো দিনের পিনবল মেশিন পছন্দ করত ওই দোকানদার- জানো তো, ফ্লিপার আর একটা ধাতব বল চক্কর খেয়ে ক্রমাগত বাড়ি খেয়ে চলে? স্কুল ছুটির পর আমি আর আমার বন্ধুরা হাজির হতাম ওখানে, আমাদের স্কোর বেড়ে উঠত আর আলোর ঝলকের সাথে সংখ্যাগুলো ফুটে উঠতে দেখতাম।'
'আমরা যেখানে বড় হয়েছি,' বলল খালিদ, 'খেলার জন্যে কার্ডবোর্ডের বাক্স পেলেই বর্তে যেতাম।'
এ কথায় হেসে ফেলল তারিক। বোরোযানও হাসল। আবার খেই ধরল ও। 'হ্যাঁ, এটা খারাপ ছিল না। কিন্তু খোদা, নিজেই যে আরেকজনের পিন বল হয়ে যাব বলে জীবনেও ভাবিনি, বস। এমন গ্রাম্য এলাকায় ফাঁদ আর চমকে দেয়ার নানা ফন্দিফিকির করতে গিয়ে ভীষণ ধকল পুইয়েছে কেউ একজন।'
'হ্যাঁ।'
'এতে দার্কো কি পরিমাণ ক্ষমতাধর সেই চিন্তাই জাগায় তোমার মনে...কি ধরনের বন্ধু আছে তার।'
'প্রচুর টাকা আর সম্পদসহ ক্ষমতাশালী লোকজন,' বলল তারিক। 'বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পুরোনো ক্ষত আর তর্ক উস্কে দিতে বলছি না, তবে এদিকটায় ক্ল্যান আর পরিবারগুলো সত্যিই পরস্পরের দিকে খেয়াল রাখে।'
আহত পা সামনে মেলে দিল ও, তীক্ষ্ণ, জোরালো যন্ত্রণা জানান দিতেই চোখ মুখ কোঁচকাল। নিজের ম্যাপ জরিপ করছে খালিদ। তো আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল ওরা, অস্ত্রশস্ত্র পরখ করল, প্রয়োজনীয় রিলোডিং সেরে নিল, তারপর খালিদ বলল, 'ওস্তাদ, সামনেই একটা রাস্তা আছে।'
'রাস্তা আমার পছন্দ না।'
'কারই বা পছন্দ,' বলল সে। 'কথা হচ্ছে, তোমার আগের কথাটা আমার মনে ধরেছে। ওই গ্রাম থেকে একটা গাড়ি চুরি করবে বলেছিলে। ওখানে ফিরে যাওয়াটা বড্ড বিপজ্জনক হবে, কিন্তু এখানে-' সামনে ঝুঁকে দস্তানা পরা আঙুলে টপো ম্যাপের একটা জায়গার দিকে ইশারা করল সে-'এখানে একটা রাস্তা আছে, মাত্র শ দুয়েক মিটার দূরে। ওখানে গিয়ে দারুণ একটা রিসিপশন কমিটি বানিয়ে অপেক্ষা করব।'
'কেউ গাড়িতে করে যাওয়ার সময় গাড়িটা আমাদেও হাতে তুলে দেয়ার অপেক্ষা করার জন্যে?' জানতে চাইল আলীয়া।
'নাহ, আমরা অপেক্ষায় থাকব, তারপর জেরুজালেমে আমরা কিভাবে কাজ করতাম দেখিয়ে দেব।'
ঝাড়া দশটা সেকেন্ড সময় নিয়ে কথাটা উল্টেপাল্টে দেখল তারিক। 'ঝুঁকি আছে।'
'হ্যাঁ, সেজন্যেই আমার পছন্দ হয়েছে,' বলল সে। 'গোটা এলাকাটা বিমান হামলা, যুদ্ধ এবং গোলাগুলিতে খুরনাক অবস্থায় পড়েছে। জোরসে চলা কোনও গাড়ি হয়তো কারো নজর নাও কাড়তে পারে। একটা গাড়ি হাইজ্যাক করতে পারলে হয়তো কিছুটা সময় পুষিয়ে নেয়া যেত। দার্কোর চৌহদ্দীর ঠিক বাইরে হাজির হয়ে কাজটা সময়মতো শেষ করার জন্যে পৌঁছে যেতাম।'
'আমার কাছেও পাগলামি মনে হচ্ছে, বস,' বলল আলীয়া বোরোযান। 'তবে পছন্দ হয়েছে।'
'হ্যাঁ। বেশ, আমরা তিনজন আছি,' বলল তারিক। কোনোমতে উঠে দাঁড়াল ও। 'খালিদ, বুদ্ধিটা তোমার, তো তুমিই পথ দেখাও।'
দাঁত বের করে হাসল ও। 'ঠিক আছে, ওস্তাদ।'
ডান পায়ের নিচের দিকে যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যে দাঁতে দাঁত চেপে এগোচ্ছে ও; দম বেরিয়ে যাওয়া দশা হচ্ছে। নানা কিসিমের ব্যথার ওষুধ আছে ওর মেডি কিটে। তবে কাজ শেষ করে মোটামুটি একটা নিরাপদ ও নিশ্চিত এলাকায় না পৌঁছানো পর্যন্ত ওসবে হাত দিতে পারবে না, নিশ্চিত জানে। নিচু ঝোপঝাড় আর পাথুরে দেয়ালে বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট কাদায় ভরা মাঠের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। বেশ দূরে ছোটখাটো একটা খামারবাড়ি দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ একটা কুকুর খেঁকিয়ে উঠতেই জমে গেল ওরা। তবে আর কিছুই হলো না, আবার আগে বাড়ল ওরা।
একটা ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেল তারিক। ওর দিকে ফিরে বিজয়ীর ঢঙে হাত নাচাল খালিদ। উত্তরে হাত নাচাল তারিক। সহসা ভীষণ তেষ্টা বোধ করছে ও, যন্ত্রণা। এসব অনায়াসে সামাল দিতে পারে ও, পিঠে ঝোলানো ওয়াটার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসা পাইপে চুমুক দিল। চট করে আভিয়ানোয় ওদের মিশনের প্রমাণ নষ্ট করে ফেলার কথা মনে পড়ে গেল। বুঝতে পারছে, সার্বিয়ার গ্রামে কি ঘটছে তার কোনো অফিসিয়াল রেকর্ডের অস্তিত্ব থাকবে না।
শ্রেফ আত্মীয়স্বজনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি যাবে: প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার সময় মারা গেছে ওরা। ব্যস, আর কিছুই না।
পানি খাওয়ায় কাজ হলো। কিছুটা ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলল ও। খোদার কসম, রাস্তায় উঠে এসেছে ওরা।
অনেকসময় রাস্তা ভালোই লাগে।
একসাথে জড়ো হলো ওরা। 'বোরোযান,' বলল তারিক, 'রাস্তা ধরে পঞ্চাশ মিটারের মতো সামনে বেড়ে কাভার নাও। খালিদ, তুমি এখানে থাকো। অন্যদিকে যাচ্ছি আমি। পঁচিশ মিটার। আমাদের দিকে কোনো গাড়ি বা ছোট আকারের ট্রাক এলেই দখল করে নেব।'
ওর কাঁধ স্পর্শ করল খালিদ। 'ওস্তাদ, এভাবে হবে না।'
'একশো বার হবে।'
'তোমার সম্মান রেখেই বলছি, স্যার'-খোদা, এই প্রথম ওকে স্যার সম্মোধন করছে সে-'তুমি আহত। কোনো কিছু হাইজ্যাক করতে একশো ভাগ ফিট থাকা চাই। আহত, রক্তাক্ত অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নয়।'
'ওর কথায় যুক্তি আছে, বস।' বলল বোরোযান।
অবশ্যই ওর কথায় যুক্তি আছে, সেটাই ভালো লাগছে না ওর। দম নিল ও। 'ঠিক আছে। পরিকল্পনা বদল। আমি থাকছি এখানে। খালিদ, তুমি সামনে থাকো। বোরোযান আর আমি তোমার পেছনে খেয়াল রাখব।'
'শুনে ভালো লাগল,' বলল সে। 'ওহ, আর ওস্তাদ? এরপর কিন্তু আমাকে আমার সৌভাগ্যের তজবীহ আনার সুযোগ দিয়ো, ঠিকাছে?'
ওর শেষ অপারেশন এটা।
পরের বার।
'তাই হবে, খালিদ,' বলল ও। 'এখন আগে বাড়ো, মাতৃভূমির সম্মান বাড়াও।'
একথায় চকিত হাসি দেখা দিল ওর মুখে। রাস্তা পেরুল খালিদ। বোরোযানের সাথে একা ফেলে গেল ওকে। এমনকি ওর এনভিজির ভৌতিক সবুজ আলোতেও বোরোযানের চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ দেখতে পাচ্ছে ও।
'তোমার কেমন লাগছে?' জানতে চাইল সে।
'বিশ্রী,' বলল ও। 'কিন্তু তুমি পজিশন নিলে ভালো লাগবে।'
'বেশ কয়েকরকম পজিশনই জানি আমি, কিন্তু আপাতত এতেই কাজ হবে,' বলল ও। তারপর ওর গাল স্পর্শ করে রাস্তার কিনার ধরে আগে বাড়ল।
অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
তারপরই দেখা দিল আলো।
১৫.
এঞ্জিনের তীক্ষ্ণ জোরালো আওয়াজ ওর কানে মধু বর্ষণ করছে যেন, কেননা এর মানে ওটা মিলিটারি ভেহিকল বা ভারী ট্রাক নয়। বাঁক ঘুরে রাস্তা আলোকিত করে তুলল ওটা। তারিকের এনভিজি-র একটা কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যাডজাস্ট করে নিল। একটা ছোট গাড়ি, লক্ষ করল ও। পুরোনো চার দরজার ফিয়াট।
বোরোযানকে পেছনে ফেলে রাস্তা ধরে এগিয়ে এলো ওটা। এদিকে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে খালিদ, আর্মার আর গিয়ারের কারণে বিশাল দেখাচ্ছে ওকে। এইচকে ৪১৬ বাগিয়ে ধরে আছে ও। চিৎকার করে একটা কিছু বলে এক দফা গুলি বর্ষণ করল ও, তারপর আবার।
অন্ধকারে আচমকা জোরালো ঝলক খেলল মাযল। ব্রেক কষে থেমে দাঁড়াল ফিয়াট, পিছলে দুটো সংকীর্ণ রাস্তাই অবরুদ্ধ করে ফেলল। আগে বাড়ল খালিদ। সোজা হয়ে দাঁড়াল তারিক। ড্রাইভারের পাশের জানালার কাঁচ নেমে গেল। চেঁচামেচি জুড়ে দিল এক বয়স্কা মহিলা। পাল্টা চিৎকার করছে খালিদ। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দুইহাত মাথার উপর তুলল মহিলা, কাঁদছে।
আরো খানিকটা সামনে বাড়ল খালিদ জাহাঙ্গীর। চোখের কোণ দিয়ে বোরোযানকেও ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল তারিক। গাড়িটা হাত করতে বয়স্কা মহিলাকে কায়দা করার কথা ভাবছে যখন, হঠাৎ ফিয়াটের পেছনের দরজাগুলো ঝট করে খুলে গেল। নিমেষে বেরিয়ে এলো দুজন লোক, ওদের হাতে একে ৪৭। বিনা বাক্যব্যয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করল ওরা।
সিনেমায় দেখা যায় এমন অবস্থায় অবিরাম গোলাগুলি চলছে।
নিরেট গাজা।
এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই চুকে গেল সব।
খালিদকে নিশানা করে গুলি করল দুই বন্দুকধারী। পাল্টা গুলি চালাল খালিদ। এবার তারিক আর বোরোযানওগুলি ছুঁড়তে শুরু করল। ক্রসফায়ারে দুই আগন্তুকের একজন অক্কা পেল। দ্বিতীয় শূটার গুলি হজম করার আগপর্যন্ত অবস্থা ওদের অনুকূলেই ছিল। কিন্তু ব্যাটা লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল। গড়াতে গড়াতে খালিদের পায়ের নিচে এসে থামল ওটা।
উজ্জ্বল জোরালো বিস্ফোরণ সোজা রাস্তার পাশের নালায় ছুঁড়ে দিল ওকে।
নিকুচি করেছে!
দ্রুত সামনে বাড়ল তারিক। কোটের নিচে হাত গলিয়েছে মহিলা। পিস্তল বের করে আনল সে। দেরি না করে ওর বুকে আর মাথায় একটা করে বুলেট ঠেসে দিল তারিক। ফিয়াটের ফেন্ডারের উপর দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে। তারপর গড়ান দিয়ে মাটিতে।
দূরের শূটারের উপর চড়ায় হয়েছিল বোরোযান। 'ক্লিয়ার,' বলল ও। নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই আরেকটা গুলি করল তার শরীরে। দ্বিতীয় শূটারের বেলায়ও একই কাজ করল তারিক। এই ব্যাটাই গ্রেনেড মেরেছে। রাস্তার কিনারে ছুটে গেল বোরোযান। ফিয়াটের দিকে গেল তারিক, আটকে গেলেও দেখেশুনে বহাল তাবিয়তে আছে বলেই মনে হলো। পাশের জানালা আর উইন্ডশীল্ড গুলি লেগে গুড়িয়ে গেছে, তবে টায়ারগুলো অক্ষত। এঞ্জিনে গুলি লেগেছে বলে মনে হলো না।
কিন্তু খালিদ...
ঘুরে দাঁড়াল ও। রাস্তার পাশ থেকে ছুটে এলো বোরোযান। 'বস, চলো যাওয়া যাক।'
'খালিদ?'
'দুটো পাই উড়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।'
মন থেকে জোর করে খালিদের চিন্তা বিদায় করে ফের ফিয়াটের কাছে এলো ও। মহিলার লাশটা টেনে রাস্তার ধারে নিয়ে এলো। অন্য শূটারেরও একই ব্যবস্থা করল বোরোযান। ররফের মতো কঠিন হয়ে গেছে তারিক। যেন অটোপাইলটে আছে, কাজ করছে সেভাবেই। ওর সমস্ত গিয়ার এবং এইচকে৪১৬ নিয়ে যন্ত্রের মতো ড্রাইভারের আসনে উঠে বসল বোরোযান।
ইগনিশনেই আছে চাবি।
কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে ভেতরে ঢুকল তারিক, জানে থামতে বাধ্য হলে বা চ্যালেঞ্জ করা হলে গুবরে পোকার মতোই ধীর গতিতে এগোতে হবে। দস্তানা পরা হাতে দড়াম করে স্টিয়ারিংয়ে বাড়ি মারল বোরোযান। কাঁদছে। 'ধেৎ, ধেৎ, ধেৎ।'
'ওসব পরের জন্যে তুলে রাখ। এখন চলো!'
'আমি পারব না।'
'কেন পারবে না?'
ওর দিকে তাকাল বোরোযান। 'এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড গাড়ি। আমি শালার স্ট্যান্ডার্ড গাড়ি চালাতে পারি না!'
অন্য কোনো সময় হলে হাসিতে ফেটে পড়ত ও, কিন্তু এখন সেই সময় নয়। তাই বলল, 'সরো!'
বেরিয়ে এসে সিট অদলবদল করল ওরা। ক্লাচে চাপ দিয়ে ইগনিশন ঘোরাল তারিক। ডান হাতে আলগোছে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে ধীরে ধীরে ক্লাচের উপর থেকে চাপ কমাল। বোরোযান দরজা আটকানোর আগেই চলতে শুরু করল ওরা।
ভেতরে তামাক, ঘাম, আর কোনো ধরনের মদের গন্ধ। রাস্তা বরাবর জোরসে গাড়ি ছোটাল ও। রিয়ারভিউ মিররের দিকে চোখ ফেরাল।
বাতি।
'পেছনে ট্রাফিক আসছে,' বলল ও।
পেছনে তাকাল বোরোযান। 'অবশ্যই, একটা রাত বটে আজ।'
'তোমার ম্যাপটা বের করো,' বলল ও। 'সামনে কি আছে একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করো।'
'বের করছি, বস।'
তুষার আর বরফে পিচ্ছিল সংকীর্ণ সর্পিল রাস্তায় চাকাগুলো ঠিকমতো কামড় বসাতে পারছে না তবু সাহসে যতটা কুলোয় সবেগে গাড়ি ছোটাল তারিক। একটা সেকেন্ড হাতড়াল বোরোযান। রাতের অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাওয়ার সময় অখ- মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আরও বার দুই নজর ফেরাল ও। পেছনের হেডলাইটগুলো গতি বাড়াচ্ছে।
'বোরোযান?'
টপো ম্যাপ দেখছিল ও। 'এটা ভালো,' বলল, 'একটা ব্রিজের দিকে যাচ্ছি আমরা। ওই ব্রিজের পরেই আধ কিলোমিটারেরও কম দূরে দার্কোর বাসা।'
'দুর্দান্ত,' বলল তারিক। 'ব্রিজটা কিসের উপর দিয়ে গেছে? রেভাইন? গালশ?'
'নদী, মনে হচ্ছে,' বলল ও।
'এবারও দারুণ।
এঞ্জিনের গুঞ্জন অব্যাহত রইল। অস্ত্র রিলোডে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বোরোযান। ওরও তাই করা উচিত, কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় সেটা সম্ভব না।
ফের রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাল ও।
কোনো আলো নেই।
তারপরই আবার দেখা দিল।
আরও দুই দফা বাঁক নিল ওরা। এবার বোরোযান বলল, 'সামনেই ব্রিজ!'
ওদের বামে গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের একটা দঙ্গল। ডানদিকে নিচু জমিন। কড়া ব্রেক কষল ও। ডানে বাঁক নিয়ে থেমে গেল।
'বেরোও!'
এঞ্জিন আর বাতি বন্ধ করে সামনে নজর চালাল ও।
দারুণ।
জমিন এখানে তীক্ষ্ণভাবে ঢালু হয়ে গেছে, দ্রুত চলন্ত গাড়ির জন্যে ঠিক আছে।
'হাত লাগাও,' বলল ও। 'আমাদের গাড়ি ডাম্প করছি আমরা।'
ঠিকমতো অবস্থান নিয়ে গাড়ির দরজার কবাটে হাত রাখল ওরা, গিয়ার নিউট্রালে বদল করে ঠেলতে ঠেলতে কয়েক মিটার সামনে এগিয়ে দিল ফিয়াটটাকে, এরপর মাধ্যাকর্ষণকে বাকি কাজ করার সুযোগ করে দিল।
'ডাউন!'
ওর সাথে একই সময়ে মাটির সাথে মিশে গেল বোরোযান। দুটো মার্সিডিস-বেঞ্জ ফোর হুইল ড্রাইভ মিলিটারি ভেহিকল ঝড়ের বেগে ওদের অতিক্রম করে সেতুর দিকে ছুটে গেল। ওগুলোর গায়ে সার্বিয়ান ক্যামোফ্লাজ প্যাটার্ন।
আরও একটা মিনিট জমিনে শুয়ে রইল ওরা।
ঘড়ি দেখল তারিক।
বোরোযানের হেলমেটে চাপড় কষল এবার। 'চলো, কাজটা সেরে ফেলি।'
'ঠিক হ্যায়, বস।'
- (চলবে)