বাসাবাড়ি লেন থেকে পিকচার হাউস
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের শৈশব এবং খানিকটা কৈশোর যে পাড়াটিতে কেটেছে, তা তাঁতিবাজারের কাছেই, বাসাবাড়ি লেনে। ১৯২০ থেকে ১৯৩০—পুরো একটি দশক অধ্যাপক বিজয়শঙ্কর সেনগুপ্ত সপরিবার এখানেই থাকতেন। তিনি ভূগোল পড়াতেন, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে শিক্ষক হিসেবে নামডাক ছিল। কলেজটা রমনাতে। ১৯৩০-এ ঢাকায় দাঙ্গা হলে বিজয়শঙ্কর নিরাপত্তার প্রয়োজনে অধিকসংখ্যক হিন্দু- অধ্যুষিত তাঁতিবাজারে পরিবার স্থানান্তরিত করেন। কিরণশঙ্করের স্মৃতির বড় অংশটাই বাসাবাড়ি লেন আর তাঁতিবাজার নিয়ে। গায়ে গায়ে লাগা একতলা বাড়িগুলোর একটার ছাদ থেকে লাফিয়ে অন্যটাতে যাওয়া এবং এই লাফালাফির কারণে দিবানিদ্রা বিলাসীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর অপরাধে বাড়িতে নালিশ আসা, মার খাওয়া এসব ছিল তার নিত্যকার গা-সওয়া ব্যাপার। কিরণশঙ্করের পড়াশোনার শুরুটা ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলে, ১৯২৭ সালে ভর্তি হলেন ক্লাস থ্রিতে, আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট স্কুলে। লণ্ঠনের আলোতে পড়াশোনা ও বাড়ির কাজকর্ম চলত, সন্ধ্যায় রাস্তার গ্যাসপোস্টে আগুন দেওয়া হতো। রাত একটু বাড়তেই পাড়ায় নৈঃশব্দ নেমে আসত।
কিরণশঙ্কর দেখতেন সদরঘাটে অবস্থিত ঢাকার ডাক বিভাগের সদর দপ্তর থেকে অতিকায় অশ্বচালিত গাড়িতে ডাক নিয়ে কর্মচারীরা গন্তব্যে ছুটতেন। ডাকঘরের পাশেই বিভূ গুহঠাকুরতার বাড়ি, এ বাড়ির মেয়ে অরুন্ধতী দেবী (গুহঠাকুরতা) সিনেমায় অভিনয় ও পরিচালনা—দুটোতেই কলকাতা মাত করে ফেলেন। তিনি বিয়ে করেন চিত্র পরিচালক তপন সিনহাকে। লেখালেখির অভ্যাস ছিল বলেই খবর রাখতেন—বিপ্লবী নলিনী কিশোর গুহ বাংলাবাজার থেকে বের করতেন 'সোনার বাংলা' নামে সাপ্তাহিকী, ফরাসগঞ্জ থেকে বেরোতো 'শান্তি', স্বদেশি অনিলচন্দ্র ঘোষের প্রকাশনা সংস্থা প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ছিল বাংলাবাজারেই। তাঁতিবাজারে নতুন বাসায় আসার আগেই, ব্যাপটিস্ট স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই তিনি কালাজ্বরের কবলে পড়েন।
পূর্ববঙ্গকে কালাজ্বরপ্রবণ শুধু নয়, ডিপো মনে করা হতো। ঢাকাতে জ্বরের প্রকোপ ছিল। কিরণশঙ্করকে নিয়মিত মিটফোর্ডে হাসপাতালে নিয়ে রক্ত পরীক্ষা করা হতো, ইনজেকশনও প্রয়োগ করা হতো তার ওপর। তাঁতিবাজারে বাসার কাছেই যে একটি ব্যায়ামাগার ছিল, তিনি সেখানে যেতে কখনো আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু কয়েকজন সদালাপী তরুণ প্রায় জোর করেই তাকে সেখানে নিয়ে যায় এবং তিনি গিয়ে দেখেন আরও কজন তরুণ নিঃশব্দে শরীরচর্চা করে যাচ্ছে। তিনিও শুরু করে ফল পেলেন, জ্বর পালাল; সর্দিকাশি নেই। পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেন। একদিন জানলেন এসব তরুণদের প্রত্যেকেই কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা তাকেও বইপত্র দিলেন, সদস্যপদ লাভের যোগ্য করে তুললেন। নিশ্চয়ই বিপ্লবী দল।
কিন্তু সিনেমা ছেড়ে তো আর বিপ্লব নয়, তার বেলায় তো নয়ই। কুড়ির দশকে কিরণশঙ্কর জানতেন ঢাকা শহরে সিনেমা হল মাত্র তিনটি: আরমানিটোলায় পিকচার হাউস, সদরঘাটে সিনেমা প্যালেস এবং জনসন রোডে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাচারির উল্টো দিকে মুকুল সিনেমা। সবচেয়ে পুরোনো পিকচার হাউস, নারী দর্শকদের জন্য পর্দাঘেরা একটি অংশ ছিল। কিরণশঙ্কর মা ও পিসিমাকে সাথে নিয়ে পিকচার হাউসেই প্রথম বায়স্কোপ দেখেন—নির্বাক যুগে বায়স্কোপ দিয়েই তো শুরু। সে সময় তার দেখা বাংলা নির্বাক সিনেমার মধ্যে ছিল 'পাপের পরিমাপ', 'কৃষ্ণ সুদামা', 'দেবদাস' এবং 'মাতৃস্নেহ'। নির্বাক হলেও একেবারে নিঃশব্দ নয়। তিনি লিখছেন, ঢাকার সিনেমা হলের সামনের দিকে একাধারে পিয়ানো এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজাবার জন্য যন্ত্রীরা উপস্থিত থাকতেন এবং গল্পের সিচুয়েশন অনুযায়ী যন্ত্রসংগীত বেজে চলত, যাতে দর্শক হৃদয় উদ্বেলিত হয়। করুণ দৃশ্যে বেহালা ও পিয়ানোসহযোগে করুণ সুর, যুদ্ধ বা লড়াইয়ের সময় রণদামামার শব্দ সৃষ্টি এবং আনন্দ-কোলাহলের দৃশ্যকে দর্শকের মনে পৌঁছে দেবার জন্য দ্রুতলয়ে যন্ত্রসংগীত চালনা—এসবই আমাদের মতো বহু কিশোরের মনে রেখাপাত করত। ইংরেজি ও বাংলা দুই ধরনের সুরই যন্ত্রীদের নখদর্পণে ছিল। এ পর্যন্ত সিনেমার সাথে যন্ত্রসংগীতের সংগত ভালোই চলেছে কিন্তু সিচুয়েশন যেমন সুর দাবি করে, যন্ত্রীরা তা বাজাতে ব্যর্থ হলে হলের ভেতরের দর্শকেরা চিৎকার করে উঠত, আপত্তি জানাত, ফলে যন্ত্রীদের বেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংবেদনশীল পর্যায় অতিক্রম করতে হতো।
স্কুলের কাছাকাছি সিনেমা হল, স্কুলে আসা-যাওয়া ও টিফিন টাইমে ঈষৎ ভ্রমণের সুযোগ, পোস্টার দেখে ছবির নাম এবং নায়ক-নায়িকাদের নাম অনেক বালকই মুখস্থ রাখত। তবে ঢাকার সামাজিক জীবন সন্ত্রাসবাদ ও স্বদেশি ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল বলে কিশোর ও যুবকদের সিনেমা দেখার ওপর একধরনের নিষেধাজ্ঞাই ছিল। রাজনৈতিক দলের দাদারা তরুণদের ওপর খুব খবরদারি করতেন। একালে সে সুযোগ সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে, কিন্তু কুড়ির দশকের শেষভাগে 'চণ্ডীদাস' দেখে হল থেকে বের হবার খানিকটা দূরেই একজন রাজনৈতিক দাদার নজরে পড়ে যান কিরণশঙ্কর। কোথায় গিয়েছিলেন সে জবাবদিহি করতে হলে সিনেমা এড়িয়ে সদরঘাট ঘুরে আসার একটি গল্প ফাঁদলেন। দাদা তো সহজে রেহাই দেবার মানুষ নন, তিনি জনসমক্ষে তার পরনের কাপড় শুঁকতে শুঁকতে বললেন, সিগারেটের এত গন্ধ কেন?
ঢাকার সিনেমা হলে সে সময় প্রদর্শিত সিনেমাগুলোর মধ্যে ছিল 'ওয়ে ডাউন ইস্ট', 'বো জেস্ট', 'সেভেনথ হেভেন', 'ডরোথি ভার্নন অব হ্যাডন হল', 'দ্য সিটি বিস্ট', 'অ্যাক্রস টু সিঙ্গাপুর', 'স্টুডেন্ট প্রিন্স', 'দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য ডিপ', 'মেট্রোপলিস', 'গার্ডেন অব আল্লাহ', 'ফোর হর্সম্যান অব দ্য অ্যাপোক্লিপস', 'ক্যামেলিয়া', 'ইফ আই ওয়াজ আ কিং', 'লা মিজারেবল'। তার নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, জন ব্যারিমোর, রোমান নোভারো, লিলিয়ান গিস, মেরি পিকফোর্ড, পোল নেগ্রি, গ্রেটা গার্বো, জন গিলবার্ট। তাদের অনেকেই তিরিশের দশকে প্রবল খ্যাতি অর্জন করেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত 'দ্য বিগ প্যারেড ও দ্য সেভেন্থ হেভেন' তার স্মৃতিতে স্মরণীয় হয়ে আছে। 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'—এই নির্বাক ছবি ঢাকার দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। সাধারণত বিদেশি সদ্য নির্মিত সিনেমা একই সঙ্গে কলকাতা ও ঢাকায় প্রদর্শিত হয়েছে। কিরণশঙ্কর মনে করেন, দেশি নিম্নমানের ছবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কারণ, ঢাকায় দর্শক-সমাজের সিনেমা সম্পর্কে রুচি ও বোধগম্যতা তৈরি হয়েছিল অজস্র বিদেশি ছবি দেখেই।
দেশি যেসব ছবি দর্শক টেনেছিল, তার মধ্যে রয়েছে 'জয়দেব', 'নিষিদ্ধ ফল', 'চাষির মেয়ে', 'দুর্গেশনন্দিনী', 'কৃষ্ণকান্তের উইল', 'কণ্ঠহার', 'কপালকুণ্ডলা', 'চরিত্রহীন'। 'জয়দেব' টানা কয়েক মাস ধরে চলেছে। বোম্বাইয়ের (মুম্বাই) ছবি 'নার্স ও আনারকলি' দেখে দর্শক মুগ্ধ হয়েছেন।
দ্রষ্টব্য: কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত (১৯২৮-১৯৯৮) ঢাকা কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। প্রিয় বন্ধু সাম্যবাদী গল্পকার সোমেন চন্দের মাসিমাকে বিয়ে করেন, ১৯৫০ সালে ভারতে অভিবাসিত হন, ঢাকা বরাবরই তার স্মৃতিতে জেগে থাকত। (গলিপথে হাঁক: মুশকিল আসান, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, 'স্মৃতির ঢাকা')
কবীর চৌধুরী (১৯২৩-২০১১) স্মরণ করলেন তার শৈশবের ঢাকার পাঁচটি সিনেমা হলের কথা। তার মধ্যে একটির কথা সবার মনে থাকে না। নতুন-পুরোনো কোনো নামেই সেই সিনেমা হলের আর অস্তিত্ব নেই। সেটা ছিল বিচিত্র একটি হল, পল্টনের বিরান এলাকায় নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা একটা লম্বা প্রেক্ষাগৃহ, ওপরের ছাদ যত দূর মনে পড়ছে টিনের ছিল। চারপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই, খাবারের স্টলও নেই। সে হলে কোনো ম্যাটিনি শো হতো না। ছবি দেখানো হতো শুধু সন্ধ্যা ৬টায় ও রাত ৯টায়। ওই সিনেমা হলের বৈশিষ্ট্য ছিল যে সেখানে শুধু ইংরেজি ফিল্ম দেখানো হতো। ওই হলে আমি এবং আমার ছোট ভাই মুনীর চৌধুরী অনেক ইংরেজি ছবি দেখেছি, বহু প্রসিদ্ধ তারকার অভিনয় দেখে চমৎকৃত হয়েছি। এই সিনেমা হলটির নাম ছিল ব্রিটানিয়া। এই সিনেমা হলে দর্শক বরাবরই কম।
কবীর ও মুনীর দুই ভাই একবার সিনেমা দেখতে গেলেন। এ দুজনকে নিয়ে সেদিনকার মোট দর্শক পাঁচজন। কবীর চৌধুরী লিখেছেন, 'ছবি শুরু হবার নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে মালিকের প্রতিনিধি আমাদের সামনে হাজির হয়ে করজোড়ে বললেন, আজ শো হবে না, আমরা যেন তাদের ক্ষমা করে দিই, পাঁচজন দর্শক খুবই কমসংখ্যক, এই টিকেট দিয়ে আমরা পরবর্তী যেকোনো দিন যেকোনো শো দেখতে পারব। কী আর করা, আমরা হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিলাম।'
ব্রিটানিয়া ছাড়া চারটি সিনেমা হল হচ্ছে পিকচার প্যালেস, মুকুল, রূপমহল এবং লায়ন। আরমানিটোলা মাঠের পাশে স্কুলের কাছের সেই পিকচার হাউসই পরবর্তীকালের শাবিস্তান সিনেমা হল। এটিই ঢাকার প্রথম সিনেমা হল। তিনবার মালিকানা বদলের পর ১৯৫৬ সালে পিকচার প্যালেস শাবিস্তান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয়টি সদরঘাটের সিনেমা প্যালেস, প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৪; এটিও কয়েক দফা মালিকানা বদল হয়ে প্রথমে মোতিমহল এবং পরে রূপমহল নাম ধারণ করে। ১৯২৭-এ প্রতিষ্ঠিত লায়ন সিনেমার প্রতিষ্ঠাতা কাদের সরদার; এটিই তার আগে ছিল ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার। ঢাকায় লায়ন সিনেমার মাধ্যমেই প্রথম একজন বাঙালি মুসলমানের মালিকানায় একটি সিনেমা হল আসে। ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের উল্টো দিকে কুড়ির দশকের শেষার্ধে প্রতিষ্ঠিত মুকুল সিনেমা হল ঢাকার চতুর্থ—নাম বদল করে আজাদ।
ঢাকার ধনাঢ্য চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী পরিবার দোসানীদের দুজন ফজল দোসানী এবং করিম দোসানী ঢাকার প্রথম শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে আগা খানের হাতে উদ্বোধন করা সেই সিনেমা হলের নাম গুলিস্তান। ফকরুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন, প্রথম ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল রাজকাপুর নার্গিস অভিনীত 'অম্বর'। আমরা সকলে মিলে ভিড় করে সিনেমা দেখতে গেলাম। দরজা খুললে ঠান্ডা বাতাস বের হয় এটা তখন অন্য রকম বিস্ময়ের ব্যাপার আমাদের কাছে। এতটুকু আনন্দ তখন রোমাঞ্চের সূচনা করেছে নগরবাসীর মধ্যে। এর পাশেই কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রিয় আড্ডাখানা 'রেক্স' রেস্তোরাঁ।
আমার স্মৃতি
১৯৬৮, ক্লাস সিক্সে পড়ি, তেজগাঁও ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে। স্কুলজীবনে কলেজে পড়ছি, এ এক বড় ধরনের অহংকার। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে, লিখিতগুলো হয়ে গেছে। ইসলামিয়াত ও আরবি যৌথভাবে মৌখিক পরীক্ষা। নজরুল ইসলাম স্যার ফাঁকিবাজ ধরনের মাস্টার, এটা আমাদের বুঝতে সময় লাগেনি। শহিদ বলল, পরীক্ষা দিব না, নতুন সিনেমা হল বিউটিতে সিনেমা দেখতে যাব, তুইও চল। টিকিটের দাম আমি দেব। আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড আছে। ফ্রন্ট স্টলে সে সুবাদে ছয় আনায় সিনেমা দেখা যায়। ফ্রি, মানে নিজের পয়সা লাগছে না। একটা সিনেমা দেখার এই সুবর্ণ সুযোগ কেন হাতছাড়া করব? তা ছাড়া এটা তো ফাইনাল পরীক্ষা নয়। স্কুল থেকে বেরিয়ে হেঁটে ফার্মগেট, বাসে গাবতলী। সিনেমার নাম 'কৌন কিসি কা'। বেশ কটা সুরেলা গান ছিল। মালা, মাসুদ রানা, নাসিম বেগম গানগুলো গেয়েছেন। বহু বছর পর জেনেছি, এই গানগুলো লিখেছেন বিখ্যাত উর্দু কবি হাবিব জালিব। আহমেদ রুশদিও একটা গান গেয়েছিলেন 'ইয়ে হুসন', 'ইয়ে সাহাব', 'হামে বকশ দিজিয়ে'। পরীক্ষা যে দিইনি, ধরা পড়িনি, শহীদ ধরা পড়ে যায়। কিন্তু জোর দিয়ে বলে ভাইভা দিয়েছে—আমার পরপরই নাকি সে ছিল। নজরুল স্যার অনুমান করে দুজনকে নম্বর দিয়ে দিলেন।
ঠিক পরের বছর ঢাকার সেরা স্কুল গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরিতে পড়ছি। ক্লাস সেভেন। দশটায় স্কুল, ছুটি সাড়ে চারটায়, পৌনে পাঁচ কি পাঁচের মধ্যে বাসায় ফিরব, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ক্লাসের নায়কসুলভ চেহারার গাজী আবিদুল মোক্তাদির বলল, 'অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেন্ড প্রফেসর' ফাটাফাটি সিনেমা, নাজ হলে চলছে, চল যাই, খাওয়াবি তুই, টিকিট আমার। গুলিস্তান আর নাজ দুটোই এক ভবনে। বেখেয়ালি অধ্যাপক তার জুতোর নিচে একটুখানি ফ্লেভার লাগিয়ে কী যে কাণ্ড করলেন—এমন সিনেমা জীবনেও দেখিনি। শো শুরু ছটায়, ফিরতে সাড়ে নটা। ততক্ষণে যা যা হবার হয়ে গেছে—বাবা স্কুলে গিয়ে শুনলেন, ক্লাস করেছি। ভাগ্যিস ছুটির পরে স্কুলে কাউকে পেয়েছেন, তেজগাঁও থানায় গেলেন জিডি করতে। ডিউটি অফিসার বললেন, অস্থির হচ্ছেন কেন? রাতটা পার হোক।
মিথ্যা বলার সুযোগ ছিল না। টাইমিং ভুল করে ফেলেছি। ঠিক করলাম, রাতের সিনেমা আর নয়। তারপরও বাবা হুকুম দিলেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা!
ছেলেরা বেহায়া হয়েই থাকে। সিনেমা আরও দেখিছি, তবে বাবাকে আর থানায় যেতে হয়নি। তত দিনে যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছি।