বিশেষ মর্যাদা হরণের পর সত্য ছাপাই বন্ধ অধিকৃত কাশ্মীরের গণমাধ্যমে
গতবছরের গ্রীষ্মে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের একটি হোটেলের বেজমেন্টে নিজেদের প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। কেন্দ্রীয় সরকার আরোপিত নজিরবিহীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে মাত্র চারটি কম্পিউটারের যেকোনো একটি ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশের জন্য লাইনে অপেক্ষা করেন তারা। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ মিনিট ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ।
সেদিন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ছিল, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য থেকে প্রদেশটিকে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনার দিন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের আশঙ্কাতেই রাজ্যজুরে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বন্ধ রাখা হয় মুঠোফোন অপরেটরদের সেবা আর ইন্টারনেট সংযোগ। বিশেষ মর্যাদা হরণের আগে থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিক উপস্থিতির এ অঞ্চলে নতুন করে মোতায়েন করে লাখো সৈন্য ও আধা-সামরিক বাহিনী।
জোরপূর্বক জনজীবন বন্ধ করে দেওয়ার এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েননি সেখানকার সংবাদ কর্মীরাও। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে বন্ধ থাকে সংবাদপত্র প্রকাশনা। ছাপানো সংস্করণ তো ছিলই না। আর ইন্টারনেট বন্ধের সুবাদে ডিজিটাল সংস্করণের তো প্রশ্নই আসে না। এভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অন্ধকারে রাখা হয় কাশ্মীরি জনগণ ও সাংবাদিকদের।
এই শাটডাউনের পাঁচদিন পর দেওয়া এক সংবাদ বিবৃতিতে সর্বভারতীয় সম্পাদক পর্ষদ (এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া) কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অবরুদ্ধ রাজ্যটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার আহ্বান জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ''সরকার ভালো করেই জানে, বর্তমান যুগে ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া সংবাদ প্রস্তুতি ও তা প্রকাশনার কাজ করা অসম্ভব। সংবাদ প্রকাশনা গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। এটি যেন সুষ্ঠুভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত করা ভারতের সকল জনগণের কাছে সরকারের দায়; এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের সকল জনগণেরও কাছেও তাদের এ দায়বদ্ধতা রয়েছে।''
এ প্রতিবাদের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার 'গণমাধ্যম সহায়তা কেন্দ্র' নামে একটি নামমাত্র যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করে শ্রীনগরের এক হোটেলে। অনলাইনে যাওয়ার জন্য সমগ্র শ্রীনগরের গণমাধ্যম কর্মীদের এ চারটি কম্পিউটারই ছিল সম্বল মাত্র।
'' গণমাধ্যম সহায়তা কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে উপস্থিত প্রায় ৩শ সাংবাদিককে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। সকলেই লাইনে দাঁড়িয়ে যেকোনো একটি ডেস্কটপ কম্পিউটারের মাধ্যমে মাত্র ১৫ মিনিট ইন্টারনেট সংযোগের জন্য অপেক্ষা করছিলেন'' বলছিলেন বিশ্বের অন্যতম সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করা এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক আরাবু আহমদ সুলতান।
সুলতান পৃথিবীর বিপৎজনকতম এ অঞ্চলে বহু বছর ধরে জীবনবাজি ধরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনা চৌকি এড়িয়ে, বন্ধ করে দেওয়া সড়কের মধ্যে দিয়ে চলে, অব্যাহত সহিংসতা, নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বদা আড়িপেতে রাখা টেলিফোন, মোবাইল যোগাযোগের লাইন ব্যবহার করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে। তার কাছেও বিশেষ মর্যাদা হরণের পর আরোপ করা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা নজিরবিহীন মনে হয়েছে।
তিনি জানান, কাশ্মীরে সত্য নিয়ে সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, সরকার ও সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যার বার্তা দিতে চায় বিশ্ববাসীকে। এজন্য সেই কথিত গণমাধ্যম সহায়তা কেন্দ্রে প্রতিদিন অসংখ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। সকল সাংবাদিককে বলতে গেলে তাদের মূল্যবান ইন্টারনেট সংযোগের সময় ব্যয় করে এসব আনুষ্ঠানিক ও আরোপিত বক্তব্য ডাউনলোড করে- তাদের মুদ্রিত বা অনলাইন প্রকাশনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
এই নীতির সঙ্গত প্রভাবই পড়েছে পত্রিকা বিক্রি ও পড়ার সড়ক কেন্দ্রে।
সাজ্জাদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা দিনের শুরুটা করতেন ইংরেজি ভাষার দৈনিক 'গ্রেটার কাশ্মীর' পাঠের মাধ্যমে। সাথে অবশ্য উর্দু ভাষায় প্রকাশিত ডেইলি সান-ও থাকতো।
''গত বছরের আগস্ট থেকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যখন আবার পত্রিকাগুলো প্রকাশনা শুরু হলো,তখন পাতার সংখ্যা কমে গেল রাতারাতি। লেখার ভাষায় পরিবর্তন ছিল স্পষ্ট। সংবাদ নির্বাচনে পরিবর্তন, বিস্তৃত ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদনের অভাব, সম্পাদকীয় কলাম বাদ দেওয়া, মতামত কলাম কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই'' জানান সাজ্জাদ।
তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ''শাটডাউনের পর গ্রেটার কাশ্মীরের যে সংস্করণ আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তাকে কোনোভাবেই সংবাদপত্র বলা যায় না। প্রতিটি প্রতিবেদন ছিল সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এটা ছিল স্রেফ প্রোপাগান্ডার বেসাতি।''
ক্ষুদ্ধ সাজ্জাদ এরপর বাড়িতে পত্রিকা নেওয়াই বন্ধ করে দেন।
পর্বতপ্রমাণ চাপের বোঝা কাশ্মীরি গণমাধ্যমের বুকের উপর:
শাটডাউন চলাকালে যেসব সাংবাদিক এবং সম্পাদক কাজ করেছেন- তারা জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করা একদম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষ মর্যাদা হরণের পর থেকেই তাদের সহকর্মীদের হুমকি-ধামকি এবং মারধোর করা হয়েছে বলেও জানান তারা। এরপরও, যারা সত্য প্রকাশে অনড় থেকেছেন তাদের কুখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এনে সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নজিরবিহীন সে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার একবছর পর বর্তমানে টেলিফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগ সুবিধা অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও, গ্রহণযোগ্যতার অভাবে ও সেকারণে পাঠক সঙ্কটে এখন সরকারি বিজ্ঞাপনী আয়ের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে কাশ্মীরি সংবাদপত্রগুলোর অস্তিত্ব।
নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীর। এসময় জনপদটির মানুষের প্রয়োজন ছিল মুক্ত গণমাধ্যম। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী চাপে সেই স্বচ্ছ, পক্ষপাতহীন গণমাধ্যম বলে কাশ্মীরে আদৌ কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা, সে প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
- সূত্র: সিএনএন