গ্যাসের জন্য হাহাকার
গেল দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাসের সংকট তীব্র হওয়ায় দেশজুড়ে বাসাবাড়ি, শিল্প কারখানা, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের কার্যক্রমে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে বলে জানা গেছে।
ভুক্তোভোগীদের মতে, গত ২৭ মে সারাদেশে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার দুয়েক দিন পর থেকেই শুরু হয়েছে এ সংকট।
বর্তমানে বাসাবাড়িতে দৈনিক মাত্র কয়েক ঘণ্টা গ্যাস থাকছে, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের অপেক্ষায় দীর্ঘ হচ্ছে লাইন; অন্যদিকে, শিল্প কারখানাগুলো সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে– পুরোদমে চালানোর মতো চাপ নেই গ্যাসের সরবরাহ লাইনে।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার আগে থেকেই দেশে গ্যাসের সংকট চলছিল। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর তথ্যমতে, গ্যাসের সংকটে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। বিটিএমের বেশকিছু সদস্য মিলের সরবরাহ লাইনে একেবারেই নেই গ্যাসের চাপ। ফলে যন্ত্রপাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে মালিকপক্ষ।
বিটিএমএ ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে শিল্প মালিকদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে কাজ করছে।
চিঠিতে আরও জানানো হয়েছে— নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, মাওনা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত বিটিএমএ'র সদস্য মিলগুলোতে গত এক একমাস ধরে গড় গ্যাসের চাপ বর্গ ইঞ্চিপ্রতি (পিএসআই) শূন্য থেকে ২ পাউন্ডের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্সের এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গ্যাসের ঘাটতির কারণে নিট মিলগুলো প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশের টেক্সটাইল শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।"
গ্যাস সংকটের কারণে গত ১ জুন থেকে সম্পূর্ণভাবে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে সাভারের উলাইলে অবস্থিত মধুমতী টাইলস লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠনটির মহাব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স) কে. এম সেলিম বলেন, "কারখানার অপারেশন (কার্যক্রম) অব্যাহত রাখতে আমাদের ন্যূনতম ৮ থেকে ৯ পিএসআই গ্যাসের প্রয়োজন হয়, সেখানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর থেকে এই চাপ নেমে ০.৫ পিএসআই হয়েছে। বাধ্য হয়ে আমরা আমাদের কারখানা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছি।"
তিনি বলেন, "কারখানায় বর্তমানে মোট ৪০০ শ্রমিক রয়েছেন। বন্ধ থাকার কারণে দৈনিক কারখানা কর্তৃপক্ষকে অন্তত ৬ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।"
গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত আর কারখানার উৎপাদন চালু করা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
গ্যাসের অভাবে বাসাবাড়িতে রান্নায় ভোগান্তি
গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিদিনের রান্নাবান্নায়ও বিঘ্নিত হচ্ছে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায়।
ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রেশমা আক্তার টিবিএসকে বলেন, ''আমাদের বাসার চুলায় দিনের বেলা গ্যাস পাওয়া যায় না।''
সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকার বাসিন্দা নাবিল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ''গ্যাস না থাকায় এলপিজি সিলিন্ডার কিনে আনতে হয়েছে। একদিকে তিতাসের বিল দেই, অন্যদিকে সিলিন্ডারের বাড়তি খরচ বহন করি। গ্যাসের দাম বাড়ে, কিন্তু গ্যাস পাই না আমরা। গতকাল তো আমাদের এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেছে। এরপরেও কোন সুরাহা নেই।''
এছাড়া রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কাঁঠালবাগান, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় একই অবস্থার কথা জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
গ্যাস সংকট সিএনজি ফিলিং স্টেশনেও
ঢাকাসহ সারাদেশের ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের জন্য দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।
ফতুল্লার পঞ্চবটি এলাকার পেট্রোল পাম্পের মালিক দেলোয়ার হোসেন প্রধান টিবিএসকে বলেন, "আমি বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এলসি করে এনেছি সিএনজি ফিলিং স্টেশন করার জন্য। কিন্তু আমি লাইন পাচ্ছি না। আশেপাশে যাদের পাম্প আছে, সেখানেও গ্যাসের চাপ নেই।"
তিনি বলেন, "প্রতিটি স্টেশনে লম্বা লাইন। কোনো কোনো গ্যাসের লাইনে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো লাইনে একেবারেই গ্যাস নেই।"
দুলাল নামে একজন সিএনজি চালক জানান, দিন বা রাত— যখনই হোক না কেন সিএনজিতে জ্বালানি নিতে হলে অন্তত ৩-৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
"এরপরেও গ্যাস পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হতাশ হয়ে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ছুটতে হচ্ছে, কিন্তু সবগুলোরই একই অবস্থা," যোগ করেন তিনি।
পাওয়ার গ্রিডে গ্যাস সংকট
গত সপ্তাহে গ্যাসের সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মাইন) ইঞ্জিনিয়ার মো. কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালগুলোর একটিতে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, এটি মেরামত করতে তিন সপ্তাহ থেকে একমাস সময় লাগবে। গ্যাস সরবরাহ আগের মতোই থাকবে, আমরা ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে কাজ করছি।"
প্রেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পরদিন থেকে তা ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটেরও নিচে নেমে এসেছে। টার্মিনালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, বিদ্যুৎ খাতে (গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরবরাহ হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনহীন হয়ে পড়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গত এক সপ্তাহে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট কমতেও দেখা গেছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ৯ জুন রাত ১টায় বিদ্যুতের ১৫ হাজার ৯১ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৫৮২ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ঘাটতি রাজধানীতে বড় আকারে না পড়লেও দেশের মফস্বল এলাকাগুলোয় তীব্রতর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাটসহ পল্লী বিদ্যুতের বেশির ভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন আমাদের সাভার প্রতিনিধি নোমান মাহমুদ ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সাবিত আল হাসান।