কাঁথার টুকরো গল্প
কাঁথা শব্দটির বিশেষ কোন ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নেই, তবুও ধারণা করা হয় যে এটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। সংস্কৃতে অনুরুপ শব্দটির মানে হচ্ছে "ছেড়া কাপড়ের টুকরো"। কাঁথা সম্পর্কে প্রাচীনতম নথিটি পাওয়া যায় ৫০০ বছর আগে, কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা "শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত" গ্রন্থে। সেখানে উল্লিখিত আছে কিভাবে চৈতন্যের মাতা তাকে একটি ঘরে বানানো কাঁথা পাঠিয়েছিলেন পুরীগামী তীর্থযাত্রীদের হাত দিয়ে। সেই কাঁথাটি পুরীর গম্ভিরায় প্রদর্শিত হচ্ছে আজও।
কাঁথা হচ্ছে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া জিনিসকে পুনরায় জুড়ে দেয়ার পদ্ধতি
১.
পুরনো, ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো জোড়াতালি দিয়ে কাঁথা সেলাই করা একটি শতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্য যার বিবর্তন ঘটেছে উপমহাদেশের বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলের (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্য এবং বাংলাদেশ) গ্রাম্য মহিলাদের মিতব্যয়ীতার অভ্যেস থেকে। প্রাক-বেদিক যুগ (খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ সালেরও আগে) থেকেই সেলাইর এই পদ্ধতিটি ভারতে প্রচলিত, যা গোটা বিশ্বের প্রাচীনতম সেলাই পদ্ধতিগুলোর মাঝে অন্যতম।
কাঁথা এম্ব্রয়ডারির ভাষার সহজতম ফোঁড়ের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়—চলমান ফোঁড়। কাঁথার জটিল শব্দকোষ তৈরি হয় চলমান ফোঁড়ের ভিন্নমুখী ব্যবহারের ফলাফল হিসেবেই।
২.
কাঁথা সেলাই ভারতের প্রাচীনতম সুচিকর্মের প্রক্রিয়া, যা আজও দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ মহিলা অনুসরণ করছেন। এই শিল্পের উৎপত্তি হয়েছিল খুবই সহজ ও সরল ভাবে। গ্রামবাংলায় জন্ম নেয়া এই শিল্পটি উনিশ শতকের শুরুর দিকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল, পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর কাঁথা শিল্প একটি মূল্যবান ও চাহিদাসম্পন্ন শিল্প মাধ্যম হিসেবে নবজন্ম লাভ করে।
যদিও কাঁথা শব্দটির বিশেষ কোন ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নেই, তবুও ধারণা করা হয় যে এটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। সংস্কৃতে অনুরুপ শব্দটির মানে হচ্ছে "ছেড়া কাপড়ের টুকরো"। কাঁথা সম্পর্কে প্রাচীনতম নথিটি পাওয়া যায় ৫০০ বছর আগে, কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা "শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত" গ্রন্থে। সেখানে উল্লিখিত আছে কিভাবে চৈতন্যের মাতা তাকে একটি ঘরে বানানো কাঁথা পাঠিয়েছিলেন পুরীগামী তীর্থযাত্রীদের হাত দিয়ে। সেই কাঁথাটি পুরীর গম্ভিরায় প্রদর্শিত হচ্ছে আজও।
অন্য সকল ঐতিহ্যবাহী বুনন সামগ্রীর মত, কাঁথাও বিভিন্ন বাহ্যিক ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হোত, যেমন কাঁচামালের প্রাপ্তি, দৈনিক চাহিদার পরিমাণ, জলবায়ু পরিস্থিতি এবং ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক নিয়ামকসমূহ। ঐতিহাসিকভাবে বস্ত্র উৎপাদন সর্বাধিক পরিমাণ মানবশ্রম-নির্ভর শিল্পের তালিকার উপরের দিকেই রয়েছে, আর এ কারণেই, তৈরি বস্ত্রের মুল্যও অনেক বেশি ছিল। তাই উচ্চ মানের, কিন্তু বহুল ব্যবহৃত, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কাপড়কে পুনঃব্যবহার করে কাঁথা সেলাই করা খুবই প্রকৃতিবান্ধব একটি ব্যাপার। মূলত ঘরে বসেই মহিলারা এই কাজটি করে আসছেন।
ঐতিহ্যগতভাবে কাঁথা তৈরিতে পুরনো সুতীকাপড়ের শাড়ি, লুংগী ব্যবহার করা হোত, যেগুলো বহুল ব্যবহারে নরম হয়ে গিয়েছে। সেসব পুরনো হয়ে যাওয়া পরিধেয় বস্ত্র থেকে টুকরো টুকরো কাপড় আলাদা করে এনে কাঁথা সেলাই করা হোত, যার মাধ্যমে তাদের পুনঃব্যবহার নিশ্চিত হতো।
পাঁচ থেকে সাতটি ভিন্ন ধরণের কাপড়কে স্তরে স্তরে সাজিয়ে একত্রে সেলাই করা হোত। হালকা রঙের কাপড়গুলো বাইরের দিকে থাকতো, যাতে ফোঁড় আর ছাঁচ আলাদা করে বোঝা যায়। ফোঁড়টি পুরো কাপড় জুড়েই দেয়া হোত, যাতে কাঁথার গাঁথুনি শক্ত হয়।
উনিশ শতকে বলা যায়, প্রতিটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একেকজন মহিলা ছিলেন কাঁথা বিশেষজ্ঞ। তারা গৃহস্থালী কাজকর্ম শেষ করার পর বেঁচে যাওয়া সময় এবং বর্ষাকালের দীর্ঘ ও অলস দিনগুলোতে নিজস্ব, নীরব সময়ের পুরোটাই ঢেলে দিতেন কাঁথা সেলাইয়ের কাজে। একটি কাঁথা সেলাই করতেই মাসের পর মাস, এমনকি পুরো বছরও লেগে যেত। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে একই কাঁথা, তিন প্রজন্মের প্রতিনিধি; নানী, মা ও মেয়ে মিলে সেলাই করে শেষ করেছে।
একটি কাঁথা অনেক স্মৃতির আধার। এর সাথে জড়িয়ে আছে যে সেলাই করেছে, যাকে উপহার দেয়া হয়েছে, যে পেয়েছে, এবং পরিশেষে, কাথাটির মালিকের অনেক স্মৃতি।
৩.
পুরনো এবং প্রারম্ভিক পর্বের কাঁথা হত সহজ, সরল, যা চলমান ফোঁড়ে বানানো হত। কালের আবর্তে কাঁথার ফোঁড় বা সেলাইয়ে নানা বৈচিত্র যোগ হয়েছে। সাধারণ কাঁথায় অন্তপূরবাসীনী নারী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে শিল্পে রূপ দিয়েছে। তার ঘর, তার বাইরে জগৎ, চিন্তা ফুল, পাখি, লতাপাতা নকশা হয়ে স্থান পেয়েছে কাঁথা, যার নাম হয়েছে নকশী কাঁথা। কারো কারো মতে নকশা থেকে নকশী কাঁথা নাম হয়েছে। নকশী কাঁথা শুধু চিত্রিত কাঁথা নয়, নকশী কাঁথার নকশা একইসঙ্গে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং কাঁথাশিল্পী নারীর জীবনের নানা ঘটনার উপাখ্যান।
কাঁথার মধ্যেই অন্তপুরের নারীরা শুনিয়েছে তাদের রুপকথার গল্প, ধর্মের উপাখ্যান, পৌরাণিক কাহিনী কিংবা নিজের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের কথকতা; তাদের স্বপ্ন, আশা এবং প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবন ফুটিয়ে তোলা হত এক একটা সেলাইয়ের ফোঁড়ে।
বর্তমান সময়ে কাঁথাকে ফোঁড়ের ধরণ অনুযায়ী শ্রেবীবিভাজন করা যায়ঃ
চলমান ফোঁড়ের মাধ্যমে সেলাই করা কাঁথা। এই ফোঁড়েই প্রথম দিককার কাঁথা বানানো হত। চলমান কাঁথাকে নকশী ও পার তোলা কাঁথা হিসেবেও আলাদা করা যায়।
এরপর রয়েছে আনারসী কাঁথা, যা বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর জেলা থেকে এসেছে। এই কাঁথারও বেশ কিছু ধরণ রয়েছে।
এরপর লহরী কাঁথা কিংবা "ঢেউ" কাঁথা। এটি বাংলাদেশের রাজশাহীতে জনপ্রিয়, এবং একে ক) সোজা (সরল/সহজ), খ) কৈতর খুপী ("কবুতরের বাসা" কিংবা ত্রিভুজ) এবং গ) বরফী (হীরে) –এই তিন ধরণে বিভক্ত করা যায়।
সুজনী কাঁথা শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহীতেই পাওয়া যায়। এই কাঁথার একটি জনপ্রিয় উপাদান হচ্ছে ঢেউ খেলানো ফুল এবং পাতার ছাঁচ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ভারতের বিহারেও সুজনী কাঁথা বানানোর প্রচলন রয়েছে।
ইংরেজদের হাত ধরে ব্রিটিশ শাসনামলে কাঁটাফোড় কিংবা কার্পেট কাঁথা প্রবর্তিত হয় ভারতবর্ষে।
৪.
কাঁথার কাপড় বানানোর জন্য প্রথমে টুকরো টুকরো কাপড়গুলোকে মাপমত কেটে নিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো হয় মনমত মাপ এবং ঘনত্ব পাওয়ার জন্য। কাপড়ের স্তরগুলোকে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে ভাল করে ইস্ত্রি করা হয়। তারপর কাঁথা শিল্প প্রথমে কিছু বড়, ঢিলে ধরণের সেলাই দিয়ে কাপড়ের কোণা গুলো সেলাই করে ফেলা হয়, কাপড়ের স্তরগুলোকে একত্রে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে। তবে সব জায়গায় এ পদ্ধতি মানা হয় তা নয়। পুরনো কাপড় কয়েক পরতে বিছিয়ে নিয়েও কাঁথা সেলাই করা হয়।
ঐতিহ্যগতভাবে, কাঁথা খুবই ব্যক্তিগত এবং নিত্যব্যবহার্য্য জিনিস, যা অনেক সময় নিয়ে বানানো হোত এবং অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সবার আলাদা আলাদা কাঁথা থাকতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাঁথা ব্যবহার হোত স্বল্প পরিমাণ ঠান্ডা পড়া শীতকালে এবং মৃদুমন্দ বায়ুপূর্ণ বর্ষাকালে; হালকা আচ্ছাদন হিসেবে।
প্রাচীণযুগে, ছোট শিশুদের পেচিয়ে রাখার কাজেও কাঁথার উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ছিল। শীঘ্রই মা হতে যাওয়া মহিলারা তাদের গর্ভাবস্থার শেষ কয়েকমাস কাপড় সেলাই করে পার করতেন, এই বিশ্বাসে এর ফলে তাদের পরিবারের উপর সৌভাগ্য নেমে আসবে, এবং আসন্ন শিশুটি সব ধরনের রোগশোকের হাত থেকে রক্ষা পাবে। বস্তা কিংবা টাকার থলি হিসেবেও কাঁথা বানানো হোত, আর কখনো কখনো অতিথি আগমন উপলক্ষে কাঁথা দিয়ে মেঝে ঢাকা হোত। এছাড়াও ব্যক্তিগত জিনিস লুকিয়ে রাখা, পবিত্র কুরআন শরীফকে আচ্ছাদিত করে রাখা, কিংবা জায়নামাজ ও বালিশের কভার হিসেবেও নানামুখী ব্যবহার ছিল কাঁথার।
ঐতিহ্যগত সুতিকাপড়ে তৈরি কাঁথা বানানো অনেক সহজতর ছিল্, আজকালের শিল্পীদের তৈরি রেশমী কাপড়ের জাঁকজমকপূর্ণ কাঁথার চেয়ে। তুলার স্তরগুলো সহজেই একটা আরেকটার সাথে লেগে থাকে, কিন্তু রেশমী কাপড়ের ক্ষেত্রে তা অনেকসময়ই পিছলে যায় অথবা স্থানচ্যুত হয়ে যায়, যার কারণে সেলাই করতে অনেক বেশি সময় লাগে।
পাড় তোলা জ্যামিতিক কাঁথা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে কাঁথা শিল্পীরা ফোঁড়ের সংখ্যা মনে রাখেন; এই নক্সাগুলো কোথাও এঁকে রাখা হয় না। নকশী কাঁথার ক্ষেত্রে, ছাঁচটি ঐতিহ্যগতভাবে সুঁই এবং সুতার প্রান্তরেখার মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকে। আজকাল, ছাঁচগুলোকে প্রথমে পেন্সিলে আঁকা হয়, আর তারপর কাপড়ের ওপর ট্রেসিং পেপারের মাধ্যমে কপি করে দেয়া হয়। কিছু কাঁথায় (যেমন কার্পেট, লিক এবং সুজনী, ইত্যাদি) প্রান্তরেখা আঁকার জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হয়।
৫.
আপনি যদি আজকে বাংলাদেশে গ্রামে বেড়াতে যান, আপনি এই ঐতিহ্যবাহী জোড়াতালি দেয়া কাঁথা-কম্বল খুঁজে পাবেন রোদে শুকাতে দেওয়া অবস্থায়, কোথাও সড়কের পাশে খড়ের ওপর, বাড়ির বারান্দায় কিংবা ধান ক্ষেতে বিছিয়ে রাখা অবস্থায়। কিন্তু নকশী কাঁথার বেশির ভাগ এখন ভারত ও বাংলাদেশে উৎপাদন হয় বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার উভয়ের জন্যেই। গ্রামের বুনকারীদের দিয়ে কাঁথা বানিয়ে এনে কাঁথা এখন বাণিজ্যিক ভাবেই ক্রয়বিক্রয় হয়।
তবে বেশিরভাগ কাঁথা শিল্পী মহিলাকেই তাদের প্রাপ্য টাকা দেয়া হয় না, এবং তারা নিয়মিতভাবে বিলম্বিত কিংবা অনিয়মিত মূল্য পরিশোধের শিকার হয়।