যেভাবে বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস নথি সংগ্রহ করে ও টিকিয়ে রাখে
দুবছর আগে ইলিয়াছ মিয়া হিসাব করেছিলেন, প্রতি ভলিউমে ৫০টি করে পাতা। সে হিসেবে ছয় কোটি পাতা নথি। সাধারণভাবে নথি হলো সুতলি দিয়ে বাঁধা একতাড়া পাতা। কিন্তু পাতাগুলো যদি এলেবেলে হয়, তবে কি তাকে নথি বলা যাবে? প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভসের গবেষণা কর্মকর্তা ইলিয়াছ মিয়া। 'আমরা তেমন সব বিষয়কেই নথি বলি যেগুলোর প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তবে এটিও মনে রাখা দরকার, আপাত গুরুত্বহীন বিষয় কোনো একদিন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
'আমাদের এখানে আঠারো শতকের শেষদিকের একটা নথি আছে পাবনা কালেক্টরেট থেকে সংগ্রহ করা। এতে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ফোর্ট উইলিয়ামে (তখনকার কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র) জানাচ্ছেন যে, নীলচাষিরা এখানে দলে দলে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ছে।' চিঠিটা তখন অন্য আর দশটা সাধারণ প্রশাসনিক চিঠির চেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখেনি বটে। কিন্তু পরের বছরগুলোতে এটি নীলকরদের অত্যাচারের দলিল, নীলচাষিদের প্রতিরোধের দলিল এবং নীলচাষ বন্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নথির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়,' বলেন ইলিয়াছ মিয়া।
নথি, রেকর্ড ও তাদের শ্রেণিবিভাগ
তবে সব নথি সংরক্ষণযোগ্য নাও হতে পারে। নথির চলমান কার্যক্রম শেষ হলে তা রেকর্ডে পরিণত নয়। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ববিবেচনায় রেকর্ডগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ইলিয়াছ মিয়া জানান, ব্রিটিশ আমলে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হতো রেকর্ডগুলোকে। এখন ২০১৪ সালের সচিবালয় নির্দেশমালা মোতাবেক চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
'ক' শ্রেণির রেকর্ড হলো নীতি, আইন, বিধি বিষয়ে আলোচনা ও আদেশের নথি। রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র যেমন সন্ধিপত্র এবং বিদেশের সঙ্গে চুক্তিপত্রও এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। 'খ' শ্রেণির রেকর্ড অর্ধস্থায়ী, ১০ বছর বা গুরুত্ব বুঝে তার চেয়ে বেশি সময় রেকর্ডরুমে সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কর্মচারীদের সার্ভিস রেকর্ড, উন্নয়ন প্রকল্প, বাজেট, কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন। সাধারণ রেকর্ডগুলো 'গ' শ্রেণিতে পড়ে। এগুলো তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য সংরক্ষিত হয়। এর মধ্যে পড়ে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত নথি, কর্মকর্তাদের বদলি আদেশ, ক্রয়-বিক্রয়ের দরপত্র ইত্যাদি। এক বছর পর্যন্ত যে-সব নথি সংরক্ষণ করা হয় সেগুলো 'ঘ' শ্রেণির রেকর্ড।
বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস আইন, ২০২১ অনুযায়ী, এটি সরকারের কেন্দ্রীয় রেকর্ড সংরক্ষণাগার। এখানে মূলত ২৫ বা তার চেয়ে বেশি বছরের পুরোনো সরকারি রেকর্ড যেমন চিঠি, প্রতিবেদন, বই, ম্যাগাজিন, পরিকল্পনা, মানচিত্র, চিত্র, ছবি, নকশা, তালিকা, গেজেট, পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত হবে। আর্কাইভসের সংরক্ষিত দলিল-দস্তাবেজ ব্যবহার করা যায়।
জিডব্লিউ ফরেস্ট ফার্স্ট আর্কিভিস্ট
১৮৬০ সাল। ভারত সরকারের মহা-হিসাবরক্ষক প্রতিবেদনে লেখেন, কাগজের জ্বালায় বাঁচি না। এগুলোকে না সরালে আমরা বসার জায়গা হারাব। তখন তিনি নথিগুলোকে একটি সংরক্ষণাগারে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এরপর প্রায় তিন দশক কেটে গিয়ে ১৮৮৯ সাল আসে, এলফিনস্টোন কলেজের অধ্যাপক জিডব্লিউ ফরেস্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র খতিয়ে দেখার। তিনি ইতোপূর্বে বম্বে রেকর্ডস অফিসে আর্কিভিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। ভদ্রলোক সরকারের নিকট আবেদন করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনের নথিসমূহ একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগারে স্থান দেওয়ার জন্য। ফলে কলকাতায় ১৮৯১ সালে ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই আমাদের জাতীয় মহাফেজখানার পূর্বসূরী।
করাচি'র ন্যাশনাল আর্কাইভস
দেশভাগের পর ১৯৫১ সালের নভেম্বরে করাচিতে ডাইরেক্টরেট অব আর্কাইভস অ্যান্ড লাইব্রেরিজের অধীনে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রদেশের নথিপত্র যেগুলো করাচি গিয়ে পৌঁছতে পারল না, সেগুলো ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেট অফিস, জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুম বা বিভাগীয় কমিশনারের রেকর্ডরুমে জমা হতে থাকল। যে-সব নগর ততদিনে কর্পোরেশন হয়ে উঠেছে, সেগুলোর রেকর্ডরুমেও ফাইল জমতে থাকল। অনেক নথির স্তূপ জমল সেক্রেটারিয়েট রেকর্ডরুমেও।
ঢাকায় মোহাম্মদপুরে পাকিস্তান আর্কাইভসের একটি বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ডেলিভারি সেন্টার থাকলেও জাতীয় আর্কাইভের কোনো শাখা ছিল না পূর্ব পাকিস্তানে। করাচির আর্কাইভে বাঙালি কর্মচারী কিছু থাকলেও কর্মকর্তা দু-চারজনের বেশি ছিলেন না।
খন্দকার মাহবুবুল করিম ইতিহাস পড়াতেন ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। ঊনসত্তরের শেষে তাকে একরকম জোর করে আর্কাইভের পরিচালক করে পাঠানো হলো করাচিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্পকালের মধ্যে তাকে ওএসডি করা হলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অপশন নিয়ে পাকিস্তানে থাকতে রাজি হলেন না বলে বরখাস্ত হলেন। পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরাও তখন কঠিন হয়ে উঠল। শেষে আফগানিস্তান থেকে ভারত হয়ে যখন দেশে ফিরলেন, ততদিনে বাহাত্তরের নভেম্বর মাস চলে এসেছে।
একদিন গেলেন সচিবালয়ে। ঢাকা কলেজে যখন পড়াতেন তখনকার এক ছাত্র আকবর আলী খান শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। দরজায় নেমপ্লেট দেখে ঢুকে পড়লেন। আকবর আলী খান তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। তিনি করিম সাহেবের পূর্বাপর অবগত ছিলেন। করিম সাহেব তার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যেতে চাইলে আকবর আলী খান বললেন, 'আপনাকে নতুন দেশের আর্কাইভ গড়ে তোলার কাজেই বেশি দরকার।'
পরে সংস্কৃতি সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনিও উৎসাহ দিলেন যেন করিম সাহেব আর্কাইভ গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। খন্দকার মাহবুবুল করিম তার স্মৃতিকথায় লিখছেন: 'ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি স্বাধীন দেশে জাতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও কৃষ্টি ধারক ও বাহক হিসাবে জাতীয় আর্কাইভস থাকা উচিত। সেই লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা অগ্রযাত্রা শুরু করি।'
বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস প্রতিষ্ঠা
মাহবুবুল করিমের তথ্যমতে, মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের ভার সৈয়দ আলী আহসানের ওপর ন্যস্ত করেছিল। সে হিসেবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই আমাদের একটি মহাফেজখানার পত্তন ঘটেছিল বলে ধরা যায়। করিম সাহেব অধ্যাপক আহসানের কাছ থেকে কিছু দলিল সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভসের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন।
কিছুকাল পরে সচিবালয় থেকে একটি ফোন পেলেন মাহবুবুল করিম। তাকে বলা হলো, সেগুনবাগিচার বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের (এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বিপুলসংখ্যক নথি (প্রায় ৫০ হাজার, যার মধ্যে দেড়শ বছরের পুরোনো নথিও ছিল) আর্কাইভে আশু স্থানান্তর প্রয়োজন। করিম সাহেব পড়লেন নতুন বিপাকে।
বাহাত্তরের শুরুতেই বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ডেলিভারি সেন্টারের একজন কর্মী ১০৩ এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দপ্তর স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু ভাড়া বাড়িটায় তাদের ঠিকমতো বসার ব্যবস্থাও নেই, এর মধ্যে নথি রাখার জায়গা কোথায়? মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরে সেখান থেকে এলিফ্যান্ট রোডেরই আরেকটি বাড়ি (৩৭২) বরাদ্দ দেওয়া হলো। সেটি তুলনামূলক বড়, যদিও তার জানালা-দরজা ভাঙা। করিম সাহেব সহকর্মীদের নিয়ে তা মেরামত করে সদলে উঠে গেলেন। তখন আর্কাইভের নামে অর্থ বরাদ্দ এত কম ছিল যে, ট্রাকের বদলে ঠেলাগাড়ি করে নথিগুলো নিয়ে আসতে হয়েছিল। রাজস্ব নথি, বিচারকার্যে নথি, উর্দু ও ফাসির্তে লেখা নথি, মানচিত্র, চার্ট ইত্যাদি ছিল সেগুলোর মধ্যে। এর মারফত আর্কাইভের বলার মতো একটি সংগ্রহ দাঁড়াল।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হলো, আগামী পাঁচবছরে বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভসের জন্য ৮২ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন কর্মসূচিতে মাইক্রোফিল্মিং ও ফটোস্ট্যাটিং ইউনিট এবং নথি সংস্কার ও সংরক্ষণ ইউনিট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে সচিবালয়ের নথি সংরক্ষণ কক্ষকে আর্কাইভের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে স্থায়ী ভবন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও করা হয়েছিল।
মোট ২৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তালিকা পাওয়া যাচ্ছে প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদনে। তাদের মধ্যে খন্দকার মাহবুবুল করিম পরিচালক। আরও ছিলেন উপপরিচালক একজন, সহকারী সংরক্ষক একজন, জুনিয়র মাইক্রোফিল্মিং ও ফটোস্ট্যাটিং অফিসার একজন, একজন গবেষণা কর্মকর্তা, সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট চারজন, জুনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট তিনজন, ডার্ক রুম অ্যাসিস্ট্যান্ট একজন, রেকর্ড সর্টার একজন, পেপারম্যান একজন, ডাস্টিং বিয়ারার একজন।
আরকাইভসের সংগ্রহকার্য
নথি সংগ্রহের প্রাক-পর্বে প্রথমে নির্দিষ্ট জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে তার রেকর্ডরুম পরিদর্শন ও অপ্রচলিত (নন-কারেন্ট, ২৫ বছর বা তার অধিক পুরোনো) নির্বাচিত নথি আরকাইভসে হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হয়। তিনি সম্মতি দিলে আরকাইভসের ৩–৪ জনের একটি পরিদর্শক দল জেলাভ্রমণে যান। তারা পরিদর্শন শেষে নির্বাচিত নথির একটি তালিকা জেলা প্রশাসককে প্রদান করেন। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মতিতে সেগুলো বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস অধিগ্রহণ করে।
নথিগুলো আনার পর সেগুলোকে পাঁচ ইঞ্চি তুলি দিয়ে ধুলোবালি মুক্ত করা হয়। এরপর বছর বা বিষয়ভিত্তিতে আলাদা করা হয়। তারপর ফিউমিগেশন চেম্বারে পাঠানো হয়। ফিউমিগেট বা জীবাণুমুক্ত করা হলে রিপেয়ার করা হয়।
রিপেয়ার প্রক্রিয়াটিরও কয়েকটি ধাপ রয়েছে। তার একটি জাপানি টিস্যু পেপার দিয়ে ওয়াশ করা। এর ফলে নথির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। নথি টেকসই করা আর্কাইভকর্মীদের একটি ধারাবাহিক ও নিয়মিত কাজ। নথির বড় শত্রু স্টেপলার বা ধাতব লক, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল, উইপোকা ইত্যাদি। রিপেয়ার করার পর নথির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে ক্যাটালগ তৈরি করা হয়। তারপরই নথিগুলো গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অন্তত দুই মাস সময় লাগে।
'৯৫ সালে যখন ইলিয়াছ মিয়া যখন জুনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন, তখন যশোর জেলা রেকর্ডরুম থেকে ৪৩২ ভলিউম নথি সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল। আব্দুস সবুর, আব্দুস সামাদ, মীর ফজলে আহমেদ চৌধুরি ছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। জগন্নাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হয়েছিলেন ইলিয়াছ মিয়া। কিন্তু নথি সংরক্ষণ বিষয়ে তার কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন সংগৃহীত নথি গবেষকদের জন্য উপযোগী করার উপায়। তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ মীর ফজলে আহমেদ চৌধুরীর নিকট, যিনি তাকে ইংরেজিতে নথির তালিকা, ক্যাটালগের ভূমিকা লিখতে শিখিয়েছেন।
'আপনি ওখানে কী করেন?'
শুরুর দিকে আরকাইভস সম্পর্কে সরকারি দপ্তরগুলোর বেশি জানাশোনা ছিল না। অনেক সময় জেলা রেকর্ডরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলেছেন, 'কোথাকার কোন আর্কাইভ থেকে কারা এসেছে ডিসির রেকর্ডরুম পরিদর্শন করতে!' অনেকসময় সার্কিট হাউজে থাকার জন্য রুম বরাদ্দও পাওয়া যায়নি। একটি মজার অভিজ্ঞতা খন্দকার মাহবুবুল করিম লিখে গেছেন।
"একবার শামসুল হুদা চৌধুরি যখন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে মন্ত্রী ছিলেন তখন আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি ওখানে (আর্কাইভসে) কী করেন?' উত্তরে বললাম, ঐতিহাসিক গুণসম্পন্ন পুরাতন সরকারি দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ সংরক্ষণ ও তথ্য সরবরাহের কাজ করি। তাছাড়া আছে জাতীয় গ্রন্থাগার পরিচালনার দায়িত্ব। সব শুনে তিনি জানতে চাইলেন, তার আত্মীয় যিনি সিনেমা জার্নাল বের করতেন সেগুলো সংগ্রহ করি কি না? আমি উত্তরে আর্কাইভস সম্বন্ধীয় কিছু তাত্ত্বিক উত্তর দিয়েছিলাম। এভাবে যে মন্ত্রণালয়েই যেতাম সেখানেই আমাদের কার্যাবলি ও এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে হতো।"
১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল আরকাইভস অর্ডন্যান্স জারি করা হলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আইনি ভিত্তি লাভ করে। তারপর স্থায়ী ভবন হওয়ার পর থেকে আরকাইভস আরও গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।
১৯৮১ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে প্রকাশিত ষষ্ঠ থেকে নবম বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সচিবালয়ের রেকর্ডরুম থেকে আরকাইভস ৪২৯টি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, ১৯৬টি জেল রেকর্ড, ২৫৮ট কৃষি বিষয়ক নথি, সমুদ্র বা জলযান সম্পর্কিত ৬০টি নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রখ্যাত গবেষক যারা আরকাইভসের সংগৃহীত নথি ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন তাদের একটি তালিকাও যুক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এদের মধ্যে আছেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নারিকা নাকাজাতু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম, দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ রফিকুল ইসলাম রুমি, মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মি. রফিউদ্দিন, যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিডি ক্রো, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডরিয়েন্স কুপার, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট আব্দুল কাদির প্রমুখ।
আরকাইভস ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত পাঁচটি বার্ষিক প্রতিবেদন একসঙ্গে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় আরকাইভস ৩৭২ নং এলিফ্যান্ট রোড থেকে শেরে বাংলা নগরের ন্যাশনাল লাইব্রেরি ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। খন্দকার মাহবুবুল করিম তার স্মৃতিকথায় বিষয়ে লিখেছেন:
'১৯৭৮ সালের ২১ জানুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনকালে পূর্ত বিভাগ যে ভবন নকশা উপস্থাপন করেছিল সেটি বাতিল করে অধ্যাপক আহসান অভিজ্ঞ ও সৃজনশীল স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে দিয়ে নকশা প্রস্তুত করার জন্য মত দিলেন। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামসহ আরো বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।'
খন্দকার মাহবুবুল করিম সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত, শ্রীলঙ্কার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার বিষয়ে বিশেষ ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা দেওয়া হয়। জনাব করিম ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং প্রোগ্রামে আর্কাইভস বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন।
কিছুদিন পর আমেরিকার জাতীয় আর্কাইভসের নির্বাহী পরিচালক জ্যাক ল্যান্ডার্স বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস উন্নয়নে কারিগরি সহায়তা বিষয়ক একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিলে কর্মরত লাইব্রেরিয়ান রো বোথাম, স্যু বাকওয়েল, নিকল্যাক ও জোয়ান ল্যাংকাস্টারও নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করতেন। সত্তরের দশকের শেষভাগে বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব আর্কাইভস (আইসিএ), সাউথ অ্যান্ড ওয়েস্ট এশিয়ান রিজিওনাল ব্রাঞ্চ অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভসের (এসডব্লিউএআরবিআইসিএ) সদস্যপদ লাভ করে।
শৈলেন ঘোষের লেখা 'আর্কাইভাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' বইটি থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন ইলিয়াছ মিয়া। তিনি বলেন, 'আর্কাইভ কর্মীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞানেরও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের কাজ গবেষণা উপকরণ সংগ্রহ এবং সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও সরবরাহ। উপকরণ সংগ্রহের পর সেগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা।'
ইলিয়াছ মিয়া ২০০৩ সালে প্রথম দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণে যান মালয়েশিয়ায়। সেটা ছিল পূর্ণবৃত্তির আওতায়, আর্কাইভ বিষয়ে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ। পরে ভারতে একটি একবছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সও সম্পন্ন করেছেন তিনি।
স্মৃতি ধরে রাখতেন রাইটারেরা
ভারতীয় উপমহাদেশে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয়ভিত্তিতে দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ছিল লেখনী ও রেকর্ডনির্ভর সরকার। তারা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা সম্বলিত সচিবালয় কাঠামো গঠন করে। এ বিভাগ ও অফিসসমূহে বিভিন্ন রকমের প্রচুর দলিলপত্র জমা হয়। এর সূচনা হয়েছিল ১৭০২ সালে যখন কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭৬ সালে বাংলায় ব্রিটিশদের প্রকৃত শাসন শুরু হলে কোম্পানির রাইটার বা করণিকদের কাজ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যে ভবনে রাইটাররা অবস্থান করতেন তার নাম রাইটার্স বিল্ডিং যা এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয়।
ইলিয়াছ মিয়া বলছিলেন, 'হাতে লেখা নথির প্রচলন ছিল ১৯০০ সাল পর্যন্ত। রাইটাররা আইন, ফরমান, প্রজ্ঞাপন, ইশতেহার, সাময়িকপত্রের একাধিক কপি তৈরি করতেন। এর একটি কপি পাঠানো হতো ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়া অফিসে, একটি ফোর্ট উইলিয়ামের সংরক্ষণাগারে এবং আরেকটি যে জেলা বা বিভাগের জন্য নথিটি প্রযোজ্য সেখানে। তাদের হাতের লেখা খুব সুন্দর হতো।'
ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস কর্মজীবনের শুরুতে একজন রাইটার বা কেরানি ছিলেন।রদীর্ঘ অধ্যবসায়ের পরে তিনি ১৭ টাকা বেতনের রাইটার থেকে গভর্নর পদে নিযুক্তি পান। 'আমরা যারা আর্কিভিস্ট বা সংরক্ষক তাদের অবশ্যই রাইটারদের কথা স্মরণ করতে হবে,' বলেন গবেষক ইলিয়াছ।
বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের সবচেয়ে পুরোনো নথিটি ১৭৬০ সালের। তখনো বাংলার দেওয়ানি পায়নি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্তু চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের অধিকার ভোগ করছিল। ওই নথিতে কোম্পানি নিযুক্ত কালেক্টর ফোর্ট উইলিয়ামকে জানিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। প্রচুর কাঠ পাওয়ার সুযোগ আছে এখান থেকে যা জাহাজ তৈরিতে দারুণ কাজে লাগবে।
রবার্ট মিটফোর্ডের রহস্য
ইলিয়াছ মিয়া যোগ দেওয়ার বছর কয়েকের মধ্যে লক্ষ্মীবাজারের পুরাতন সিটি কর্পোরেশন অফিস থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নথি সংগ্রহ করেছিল জাতীয় আর্কাইভস। এগুলোর মধ্যে দুটি নথি খুব আলোড়ন তুলেছিল। যার একটির বিষয়বস্তু হলো, ঢাকার প্রথম টেলিফোন অফিস ছিল কলতাবাজারে। দ্বিতীয়টি ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কসে গনি মিয়ার ৫০ হাজার টাকা দান বিষয়ক। আরেকটি নথি নিয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন ড. শরীফউদ্দিন আহমেদ। তিনি ১০ বছর আর্কাইভসের পরিচালক ছিলেন।
সে নথিটি মিটফোর্ড হাসপাতাল যার নামে সেই রবার্ট মিটফোর্ড সম্পর্কে। জনশ্রুতি ছিল, মিটফোর্ড সাহেব চিরকুমার ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার সমুদয় সম্পত্তি নেটিভ হাসপাতালের জন্য দান করে যান। প্রাপ্ত নথিটি থেকে জানা গেল, কালেক্টর মিটফোর্ড অবশ্যই কুমার ছিলেন না এবং তার স্ত্রীর সংখ্যা তিনের অধিক। তিনি তার অর্থ ঠিক হাসপাতালের জন্য নয় বরং কোনো একটা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে অসিয়ত করেন। পরে ঢাকার সিভিলিয়ানরা নিজেদের চিকিৎসাও করানো যাবে ভেবে হাসপাতাল স্থাপনে উদ্যোগী হন।
এ তথ্য উদঘাটিত হওয়ার পর শরীফউদ্দিন আহমেদ আর্কাইভসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন।
জাতির স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে
আধুনিক পৃথিবীতে প্রথম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফ্রান্সে, ফরাসি বিপ্লবের অনুষঙ্গ হিসেবে। ১৭৯৪ সালে বিপ্লবপূর্ব সময়ের সরকারি ও ব্যক্তিগত নথি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগারে জমা করার রাষ্ট্রীয় ডিক্রি জারি করা হয়। পরে ১৭৯৬ সালে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আর্কাইভ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় ফ্রান্সে।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলে মহাফেজখানা নামে অভিহিত সংরক্ষণাগারে প্রশাসনিক দলিল-দস্তাবেজ ও নথিপত্র সংরক্ষিত হতো। ইলিয়াছ মিয়া বলেন, 'মুঘলরা বড়-ছোট সব বিষয়ই নথিভুক্ত করত। বাদশাহ কোন বেলায় কী খাবার গ্রহণ করলেন তাও লিখে রাখা হতো। সেজনই আইন-ই-আকবরি ও আকবরনামা লিখা সম্ভবপর হয়েছিল।'
সাধারণত কাগজের স্থায়িত্ব ধরা হয় ৩০০ বছর। তবে এটা ধরে রাখার জন্য সংরক্ষণাগারের তাপমাত্রা হতে হয় নিয়ন্ত্রিত; ২০–২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর্দ্রতা ৫০–৫৫ শতাংশের মধ্যে থাকা দরকার। কাগজকে অ্যাসিড ফ্রি করা গেলেও তার স্থায়িত্ব বেড়ে যায়। আর্কাইভসে নথি রাখার জন্য আছে মেটাল-ফ্রি বাক্স, বিশেষায়িত র্যাক এবং মোবাইল শেলফ। আর্কাইভসের পাঁচতলা স্ট্যাক ব্লক শুধুই নথির জন্য বরাদ্দ। এখানেই নথি সংরক্ষণ (প্রিজারভেশন), কনজারভেশন বা ক্ষয় রোধ এবং রেস্টোরেশন বা নবায়নের কাজ করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভসের সহকারি পরিচালক (সংগ্রহ) আলী আকবর বলেন, 'আর্কাইভ হলো কাগজের হাসপাতাল আর স্ট্যাক ব্লক হলো আইসিইউ। নথিগুলো হলো জাতির মেমরি বা স্মৃতি, এগুলো টিকে না থাকলে জাতি স্মৃতিশূন্য হয়ে যাবে। তাই আর্কাইভ প্রত্যেক জাতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।'