২০২৪-২৫ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ১৯৬% বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ হাজার কোটি টাকা: সিপিডি
সরকারের 'ভুল নীতির' কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান ১৯৬ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
রোববার (২৩ জুন) রাজধানীর মহাখালীতে ব্রাক ইন সেন্টারে সিপিডি আয়োজিত বিদ্যুত খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলে সংস্থাটি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার পরও এই বিপুল পরিমাণ লোকসান হবে বোর্ডের।'
তিনি বলেন, চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৪৬.৪ শতাংশ বেশি। দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল টাকা যাচ্ছে সরকারের তহবিল থেকে। বিদ্যুৎ ব্যবহার করা না গেলেও কেন উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে—এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ সক্ষমতা থাকার পরও বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। অপরদিকে উদ্বৃত্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এর ফলে পিডিবির লোকসান বাড়ছে। সেইসঙ্গে ভোক্তার বিদ্যুতের দামও বাড়ছে।'
সিপিডির গবেষণা পরিচালক আরও বলেন, সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেটি উচ্চাভিলাষী। ওই সময় ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত রিজার্ভ ধরেও সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হলেই যথেষ্ট হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকার এখন যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, তা ২০৩০ সালেও প্রয়োজন হবে না। আজ থেকে ছয় বছরে চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২৫ শতাংশ রিজার্ভ ধরলে তখন ২৩ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হলেই চলে। সক্ষমতা বাড়লেও এখনও দেশে লোডশেডিং হচ্ছে। গরমে গড়ে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। ময়মনসিংহ, খুলনায় এবং সিলেটে লোডশেডিং করা হয়।
বাজেটে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই এবং সরকার এ খাত নিয়ে কী করবে, তা নিয়েও সবাই অন্ধকারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
'পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং ব্যয়বহুল' হওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির পরামর্শ দেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক।
সরকারের ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানির সমালোচনা করে তিনি দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেন।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়নের পাশাপাশি স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সরকারকে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।
মোয়াজ্জেম বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কার্যক্রমেরও সমালোচনা করে বলেন, 'বিপিসি বছরের শুরুতে লোকসান দেখায়, কিন্তু বছরের শেষে তারা মুনাফা করে। তারা আসলে করছেটা কী? তারা কী প্রক্রিয়ায় তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।'
অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে সংসদ সদস্য এ কে আজাদ বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অঙ্গীকার দিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু লোডশেডিং কমেনি।
'লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা সচল রাখতে উচ্চমূল্যের ডিজেল ব্যবহার বাড়ছে। এতে কারখানার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক কোম্পানি বসে গেছে,' বলেন তিনি।
টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে কারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি সবমিলে ৪৬.৬৮ শতাংশ কমেছে গত বছরের তুলনায়।
তিনি বলেন, 'সামগ্রিকভাবে কমেছে সরকারের রাজস্ব আয়। গতবার এনবিআর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরন করতে পারেনি। এবার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা পূরণ করা সম্ভব না। এনবিআর চেয়ারম্যান নিজে এটা স্বীকার করেছেন।
'এভাবে চললে বিদ্যুৎ খাতে বাজেটে যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেটা আদৌ সরকার দিতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে।'
এ কে আজাদ বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা দেশের উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।
বিপিসি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম অভিযোগ করেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের নামে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সমন্বয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের একক দায়িত্ব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হলেও বিপিসি তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে।'
শামসুল আলম বলেন, বিপিসির দুর্নীতি প্রমাণ হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ, ঘুষের টাকা, কমিশন সবই জনগণের টাকা থেকে মেটানো হচ্ছে। এরপরও জনগণকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের কথা শোনা হচ্ছে না। ফলে এই বাজেট এলেই কী আর গেলেই কী, তাতে কারেও যায়-আসে না। বরং বাজেটে যত বেশি বরাদ্দ বাড়বে, তত বেশি লুণ্ঠন হবে।'
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম, বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের রেক্টর মোহাম্মদ আলাউদ্দি এবং পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন।