কফির কাপের ধোঁয়া কিংবা কাফকা
কাফকার লেখা কিন্তু আমি কিছুই বুঝি না! সে কারণেই একটা গল্প পড়া শেষ হলে আবার শুরু থেকে পড়তে আরম্ভ করি। দ্বিতীয় দফা শেষ করার পরে দেখা যায় আগে যেটুকু বুঝছি বলে ভাবছিলাম, এখন সেটাও বুঝতেছি না। অগত্যা আবার পড়া লাগে এবং হেমন্তে মেপলের গায়ে লেগে থাকা শেষ কয়েকটা পাতার মতন আমার বোধগম্যতার পলেস্তারা ঝুরঝুর ঝরে পড়ে আর আমি গোল চোখ আরো গোল্লা করে ভাবতে থাকি এইটা কি পড়লাম! "যত গেছি তত ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে পথৃ" জয় গোস্বামীর কবিতার পংক্তির মতন প্রতিবার কাফকা পাঠের সাথে সাথে আমার বিভ্রান্তির বৃত্তের পরিধি বাড়তে থাকে।
অথচ মানুষ হিসাবে আমি চরম অলস ধরণের। দাঁতে ব্যথা লাগে বলে চালের নাড়ু পর্যন্ত খাই না! সেই মানুষ দুনিয়ায় এত পড়ার বিষয় থাকতে কেন কাফকার একেকটা লেখা নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি? প্রতিটা শব্দ আলাদা করে বোঝা যায়, বাক্যগুলিও আপাতদৃষ্টিতে সরল। কিন্তু সব মিলেমিশে যা হচ্ছে, তা নাগালের বাইরেই রয়ে যায়। আবার খুব বেশি দূরে না, যেন আরেকটু হাতটা বাড়ালেই ধরে ফেলা যাবে - যায় না। এটাই কাফকা।
২০২০ সালে প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় যশুয়া কোহেন এর একটা লেখা ছাপা হয়েছিল "ফ্রানৎস কাফকা পাঠের স্বস্তি ও শাস্তি" নামে। যশুয়া একজন মার্কিন লেখক। তাঁর উপন্যাস "দ্যা নেতানিয়াহুস' এর জন্য পুলিতজার পুরস্কার পেয়েছেন ২০২২ সালে। লেখার শুরুতেই বলেছেন "কাফকা পাঠ আনন্দের, আর তার শাস্তি হলো সে সম্পর্কে লেখা। কাফকায় দুর্ভোগ ছাড়া যেমন কোন গৌরব হাসিল হয় না, তেমনই কোন ভোগান্তিও অপ্রশংসিত থাকে না"।
যশুয়া লিখেছেন কাফকার চরিত্রদের উপায় নাই তার ভার বহন করা ছাড়া। কিন্তু আমরা পাঠকেরাও কেন সাগ্রহে তাঁর কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করে যাচ্ছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে? আমাদের এ আরাধনার প্রমাণ পাওয়া যায় কাফকার শতাধিক প্রকাশিত জীবনীতে, কয়েক ডজন সিনেমা আর টিভি অনুষ্ঠানে, আর কাফকা ব্রান্ডের ইন্ড্রাস্ট্রি তো আছেই - কাফকার হাতের লেখার মতন কম্পিউটার ফন্ট, বড় হাতের কে অক্ষরে তাঁর দস্তখত, টি-শার্ট, টুপি, চাবির রিং, তার চেহারার ছবিওয়ালা স্মার্ট ফোনের কভার আরো কত কি!
তাঁর মতে আমাদের এই কাফকা-আসক্তির মূলে রয়েছে প্রত্যাখাত হওয়ার অনুভূতি। যখনই কোনো কাফকা-বণিকের মনে হয়েছে হয়তো তাঁর কোন একটা দিক সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পারা গেল, কোনো একটা নির্দিষ্ট ছকে তাঁকে ফেলা গেল - জার্মান ভাষাভাষী চেক, ইহুদী, জায়নবাদী, জায়নবাদ-বিরোধী, মার্ক্সবাদী, নারীবাদী, মার্কিনপ্রেমী, শাকাহারী, বায়ুগ্রস্ত, উকিল, ভাই অথবা সন্তান - কাফকা তা তিনি যা বা যে-ই হন না কেন তখনই ভেসে গেছেন আমাদের নাগালের বাইরে। হয়তো এই প্রতিদানহীন ভালোবাসায় নিজেদের আমরা বারেবারে অপমানিত হতে দেই কারণ কাফকাই সর্বশেষ মহান লেখক যাঁকে আমরা পেয়েছি - আমরা বলতে হাজার রকম মত, পথ, দেশ কিংবা ভাষার কাফকাগ্রস্ত প্রত্যেকেই।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার কাফকা বলেছিলেন "ইহুদিদের সাথে আমার কি আর মিল আছে? আমার তো নিজের সাথেই মিল নাই কোনো, আমার উচিত চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকা যে আমি শ্বাস নিতে পারি।"
যশুয়ার মতে বর্তমান সময় যখন নিজেই নিজের মান ঠিক করতে পারছে না - যে সময় সমস্ত পরিচয় মাপে ব্যাপ্তি দিয়ে অথচ বিচারের বেলায় বাইনারি ('লাইক' বা 'ডিসলাইক'); যে সময় অন্য দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে পড়তে জোর দেয়, কিন্তু ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব নিষেধ করে, যে সময় স্বাক্ষরতাকে বদলে দেয় সংখ্যা দিয়ে আবার বিলাপ করে আমাদের একমাত্র যোগাযোগের জায়গা হলো রাজনীতি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কাফকার প্রাসঙ্গিকতা জোরালো হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত মাসরুর আরেফিন এর একটা লেখাতেও একই অনুভূতির অনুরণন আছে—
"আপাতদৃষ্টে খোদার দয়ালু হাতের ছোঁয়া থেকে বিঞ্চত, নিষ্ঠুর এই আধুনিক বিশ্বে কাফকার লেখা আপনি না পড়তে পারেন, কিন্তু 'কাফকায়েস্ক' দৃশ্যমালা এড়াবেন কী করে? সাড়ে তিন মাস আগে জেলে মারা গেলেন (আসলে খুন হলেন) রাশিয়ার বিদ্রোহী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন আমরা দেখলাম যে অনেক ফুলের মাঝখানে মাটিতে রাখা আছে ফ্রানৎস কাফকার দ্য ট্রায়াল উপন্যাসের তিন প্রচ্ছদে তিনটি সংস্করণ। আর তিন রুশ পুলিশ বইগুলো এখানে রাখা যুবকদের ঘাড়ে হাত রেখে যেন বলছে, 'জলদি করো।' এই দৃশ্য কাফকায়েস্ক নয়। যেটা কাফকায়েস্ক তা হলো, মাঝখানের সুদর্শন পুলিশটার চোখে আমরা দেখতে পাচ্ছি এক স্পষ্ট ধমক, 'শোনো বিরোধী দলের ছেলেপেলেরা, তোমরা আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আছ।"
এর মাঝে 'শেয়াল ও আরব' গল্পটা কয়েকবার পড়া হলো। তাঁর অন্য গল্পের মতোই আপাত সাদামাটা শুরু "মরুদ্যানে তাঁবু গেড়েছিলাম আমরা। আমার সঙ্গীরা তখন ঘুমিয়ে"। তারপর বর্ণিত হলো কিভাবে এক পাল শেয়াল এসে ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে থাকা কথককে ঘিরে ধরলো তাদের 'আর্জি' নিয়ে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ শেয়াল জানালো তার মা, তার মায়ের মা এবং পূর্বসূরী যত মা আছে শেয়াল প্রজাতির সব মায়েরা অপেক্ষায় ছিল কবে কথক এর দেখা মিলবে আর তাদের দাবী জানাতে পারবে।
কথক খেয়াল করলো আর্জি জানাতে হাজির হলেও তারা তাদের থাবার পেছনে চোখগুলো এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছে যেন বিতৃষ্ণা আড়াল করতে চাইছে। দেখে তার ইচ্ছা হলো এক লাফে এই ঘেরাওয়ের বাইরে চলে যেতে। অথচ তারও উপায় ছিল না কারণ তরুণ দুই শিয়াল পিছন থেকে তার জ্যাকেট আর শার্ট কামড়ে ধরে ছিল।
ভয় পেয়ে কথক যখন চিতকার করে বললো, ওদের বলো আমাকে ছেড়ে দিতে। বৃদ্ধ শেয়াল জানালো "অবশ্যই ছেড়ে দেবে, ওদের দাঁত বসে গেছে, তা আস্তে আস্তে ছাড়ানো লাগবে, ততক্ষণে আমাদের আর্জি শোনেন"। সে বললো "আমাদের কৌশলহীনতার জন্য আমাদের দায়ী করবেন না, আমরা গরীব পশু, দাঁতই আমাদের সব, ভালো-খারাপ যেকোনো কিছুতেই দাঁতের ব্যবহার করি আমরা।" জানা গেল তারা নোংরা আরবদের থেকে মুক্তি চায়, তারা চায় পরিচ্ছন্নতা।
এই গল্পের প্রতিটা শব্দে, এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের দূরত্বের ভেতর কত রকম স্তর যে আছে, তা বুঝতে চেষ্টা করলে খেই হারিয়ে ফেলি। আজকের দুনিয়ায় এই লেখা পড়ে প্রথমেই আমার মনে এসেছে ইস্রাইল আর ফিলিস্তিন। অন্য আরেক সময়ে, আরেক রকম মনে হবে হয়তো। কাফকার গল্পগুলিকে আমার মনে হয় তরল - ধারকের আকারে সাকার।
যশুয়া লিখেছেন, কাফকা সম্পর্কে এত এত গবেষণায় যা বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত তা হলো তাঁর লেখার কৌশল বিষয়ক আলাপ– যা সাধারণত শুরু হয় নিটোল প্রাঞ্জল একটা ধারণা দিয়ে তারপর যতো সামনে এগোয় তত প্রথম ধারণা থেকে বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বের হয়ে একই সাথে বিভিন্ন দিকে চলতে চলতে অনেক অনেক কমা'র অস্পষ্টতায় বিজড়িত হতে থাকে। এই যে মাথার ভিতরে জলস্রোতের মত বইতে থাকা সমস্ত ভাবনাটুকু এবং তার পরিণাম একই বাক্যে বলে ফেলার যে একটা তাগিদ যা তাঁর গদ্যে এক ধরণের তীব্রতা সৃষ্টি করে যা আবার ব্যকরণগত বিলম্ব দিয়ে খণ্ডিত হয়। এ বিষয়টা মূল জার্মান ভাষায় বেশি চোখে পড়ে, ইংরেজির চেয়ে। ইংরেজিতে সাধারণত বাক্য গঠিত হয় বিষয়-ক্রিয়া-বস্তু এইভাবে (কে-কি করছে-কাকে), আর জার্মান বাক্য হয় বিষয়-বস্তু-ক্রিয়া (কে-কাকে-কি করছে)। তাই ইংরেজি ভাষাভাষির মানুষেরা নিশ্চয়তায় অভ্যস্ত আর জার্মান ভাষায় অনিশ্চয়তা চলতে থাকে বাক্যের শেষ পর্যন্ত। বাক্য গঠনের কারণে একই বাক্য বিভিন্ন ভাবে অনুবাদ সম্ভব এবং তাতে মূল অর্থ পাল্টে যায়।
কিছুদিন আগে নাইজেরিয়ান-বৃটিশ লেখক স্যার বেন ওকরির একটা আলাপ শুনছিলাম নিউইয়র্কার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ডেবোরাহ ত্রিসম্যান এর সাথে। ওকরি ১৯৯১ সালে তাঁর উপন্যাস 'দ্যা ফেমিশড রোড' এর জন্য বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন। ২০২৩ সালে নাইটহুড পেয়েছেন সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য।
তাঁর লেখালেখিতে কাফকার প্রভাব স্বীকার করেন ওকরি। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো কাফকার কাজ কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তিনি উত্তর দিলেন "খুবই কঠিন বলা, কাফকা যত পড়ি, তত বিভ্রান্তি বাড়ে, তিনি এমন একজন যিনি পরিচিতির সাথে সাথে আরো রহস্যময় হতে থাকেন, খুবই অদ্ভুত বিষয়টা"। শুনে আমার খুব আনন্দ হলো, শুধু আমি না, বেন ওকরির মতন লেখকও কাফকাকে নিয়ে একই রকম উৎকণ্ঠায় আছেন!
২০২০ সালের জুনে নিউইয়র্কারে কাফকার চারটা অনুগল্পের ইংরাজি অনুবাদ ছাপা হয়েছিল "সময় হলেই পরিত্রান শুরু হবে" শিরোনামে। এই গল্পগুলো নিয়েই আলাপ হচ্ছিল ওকরি আর ত্রিসম্যানের। চারটা অনুগল্প ছিল চার রকমের। প্রথমটা প্রমিথিউসকে নিয়ে চারটা আলাদা আলাদা মিথ এর বর্ণনা দিতে গিয়ে শেষে বলা হলো "এক সময় তার ক্ষতরাও ক্লান্ত হয়ে যাবে"।
আরেকটা গল্প ছিল এক কৃষক আর এক পথিকের মধ্যে কথোপকথন। যেখানে কৃষক পথিকের সাহায্য চাইছিল তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া মেটানোর বিষয়ে, তৃতীয় গল্প শুরু হয়েছে কাঠের টেবিলে রাখা লম্বা একটা পাউরুটি নিয়ে। খুব সাধারণ ঘরোয়া দৃশ্য, এক শিশু দেখছে তার লম্বা কোট পরিহিত বলিষ্ঠ বাবা একটা ধারালো চকচকে ছুরি দিয়ে রুটিটা কাটার চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। সারারাত ধরে সেই শিশু আর তার ভাইবোনেরা অবাক চোখে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো বাবার রুটি কাটার চেষ্টা। বাবা তাদের ডেকে বললো "এতো অবাক হবার কি আছে? জীবনে ব্যররথতাই স্বাভাবিক, সাফল্যতেই অবাক হতে হয়"। আরেকটা অদ্ভুত বাক্য ছিল গল্পটায় "রুটিরও অধিকার আছে প্রতিরোধ করার"। এই গল্পে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই রুটিটা কাটা যায় না, সে ছোট হয়ে কুঁচকে যায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কারো মুখের মতো।
শেষ গল্পের নামেই অনুবাদের নামকরণ হয়েছে - সময় হলেই পরিত্রাণ শুরু হবে, এখানে পরিত্রাণ যে পাওয়া যাবে এক সময় সেটা জানা কথা, প্রশ্ন হলো সেটা চাওয়াটা উচিত হবে কিনা। ছোট ছোট চারটা গল্প নিয়ে অনন্তকাল ভাবা যায়। প্রতিবার নতুন কিছু না কিছু চোখে পড়ে। ওকরিও বলেছেন কাফকার গল্পের একটা বড় বিষয় হলো গল্প পড়ার সময় বা শেষ করার পরেও মনে হয় যে কি যেন বুঝি নাই, তখন আবার শুরু থেকে পড়তে হয়!
চল্লিশ বছর এগারো মাসের তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনে কাফকার লেখাগুলির বেশির ভাগই ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। তিনি বেঁচে থাকতে প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র ৯টা ছোট গল্প। বাকি সব সম্পূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ লেখা তিনি তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বলেছিলেন পুড়িয়ে ফেলতা। ম্যাক্স বন্ধুর সে কথা শোনেন নাই, সব লেখাই প্রকাশ করেছেন। আমি মাঝেমাঝে ভাবি কে জানে কাফকা আসলে কি চেয়েছিলেন। তাঁর তো ঠিক ঠিকানা কিছু ছিল না!
তাঁর তিনটা উপন্যাসের একটাও তিনি শেষ করে যান নাই। অথচ তাঁর সময়ের এবং বর্তমান সময়ের অসংখ্যা লেখককে প্রভাবিত করেছেন তিনি। গার্সিয়া মার্কেস বলেছেন তিনি লিখতে শুরু করেছেন কাফকার মেটামরফসিস পড়ে। ডব্লিউ.এইচ. অডেন বলেছিলেন (মাসরুর আরেফিনের অনুবাদে) "যদি কোনো একজন লেখকের নাম করতে হয় যিনি আমাদের সময়ের সঙ্গে বহন করেন সেই সম্পর্ক যেমনটি দান্তে, শেক্সপিয়ার ও গ্যেয়টের ছিল তাঁদেরগুলোর সঙ্গে, তাহলে সবার আগে মাথায় আসবে কাফকার নাম"।
এ সময়ের নাম করা লেখক হারুকী মুরাকামির একটা বইয়ের নামই আছে "কাফকা অন দ্যা সোর"। তাঁর একটা গল্প আছে "সামসা ইন লাভ" নামে, যেখানে গল্পের প্রোটাগনিস্ট আবিষার করে সে রূপান্তরিত হয়ে গ্রেগর সামসা হয়ে গেছে। যারা একটু আধটু সাহিত্যে আগ্রহী তাঁদের মধ্যে কাফকার লেখা না পড়লেও মেটামরফসিস বা রূপান্তরের নাম শোনেন নি এমন লোক কমই আছে। পরবর্তী কত রকম লেখা হয়েছে এই গল্পের আদলে। সর্বশেষ পড়লাম মহসিন হামিদের উপন্যাস "দ্যা লাস্ট হোয়াইট ম্যান", যেখানে নায়ক ঘুম ভেঙে আবিষ্কার করে সে সাদা চামড়া থেকে বাদামী চামড়ার হয়ে গেছে।
মেলবোর্নের লেখক মারিজা পেরিসিক এর উপন্যাস "দ্যা লস্ট পেজেজ' লেখা হয়েছে কাফকা ও ম্যাক্স ব্রড এর সম্পর্ক নিয়ে। এই বইয়ে কাফকাকে হাজির করা হয়েছে একদম অন্যরকম আলোয়। সাধারণত তাঁর কথা ভাবলে আমার মনে হতে থাকে অন্ধকারের মধ্যে পরতে পরতে কুয়াশা জমে জমে মূর্তিময় বেদনার কথা... 'তুমি যে আঁধার তাই বড় ভালোবাসি...'।
অথচ এই বইয়ের শুরুতে ম্যাক্স এর সাথে কাফকার প্রথম দেখায় তাঁর একটা হাসিখুশি রূপ দেখি আমরা। ম্যাক্স একটা বকৃতা করছিলেন শোপেনহাওয়ারকে নিয়ে, যেখানে তিনি বলছিলেন - এখনকার দুনিয়ার চেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না। সে কথার জবাবে কাফকা বলে উঠেছিলেন "কি গাধার মতন কথা!" তারপর বলেছিলেন, যা কিছু যেমন আছে তারচেয়ে সবসময়েই আরো খারাপ হতে পারে। সেই প্রথম পরিচয়ে যে তরুণকে বিরক্তিকর মনে হয়েছিল তাঁর সাথে পরবর্তীতে ম্যাক্স এর গভীর বন্ধুত্ব নিয়েই এই উপন্যাস।
বেন ওকরি আর ডেবোরাহ ত্রিসম্যানের আলাপেও এই হাস্যরস এর দিকটা উঠে এসেছিল। কৃষক ও পথিকের গল্পটা নিয়ে ডেবোরাহ বলছিলেন এই গল্পে কথোপকথনটা খুব মজার। ওকরি বললেন আরো বেশি বোঝা যাচ্ছে গল্পটা জোরে পড়ার কারণে। একই গল্প বইয়ের পাতায় পড়া আর কারো মুখে শোনায় পার্থক্য আছে। কাফকা তাঁর গল্প সবসময় উচ্চারণ করে পড়তেন। মেটামরফসিস কাফকার কণ্ঠে শুনে নাকি তার বন্ধুরা হেসে কুটিপাটি হতো!
ঈদের পরপর একদিন সন্ধ্যার আগে আগে বাসার ডেক এ বসে কফি খাচ্ছিলাম। শীতকালে ঝুপ করে রাত নামে। আমি ভাবছিলাম সামসার মতন হঠাত করে না হলেও রূপান্তর কত রকম হয়। গতকালেও যার কাছে আমি নিঃশ্বাসের মতন অপরিহার্য ছিলাম, আজকে হয়তো তার কাছেই আমার অস্তিত্ব অপ্রাসঙ্গিক! চেয়ে দেখলাম কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে প্রায়ান্ধকার কুয়াশায়।