প্রসঙ্গ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ: প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও জানা
শীতের চোটে নাকমুখ দিয়ে ঠান্ডা ধোঁয়া বের হচ্ছে। রাতে নাকি তাপমাত্রা মাইনাসে নামবে। মেলবোর্নে শহরতলিতে সাধারণত তুষারপাত হয় না। এবারের শীতটা একটু বেশিই বোধ হয়, অথবা আমি বৃদ্ধ হচ্ছি আর হাড়গোড়ে শীতের বাঁশি বাজতে শুরু করেছে। রিমোট হাতে চিন্তিত মুখে টিভির পর্দায় চোখ রেখে ভাবছিলাম এ রকম দিনে সম্পূর্ণ রঙিন, নাচে-গানে ভরপুর, রোমহর্ষক, ধামাকাদার মারমার কাটকাট কিছু দেখা দরকার। এমন সময় আম্মা ঘরে ঢুকল মাত্র চুলা থেকে নামানো চিড়া ভাজি নিয়ে। আদা, কাঁচা মরিচের ঝাঁজালো ধোঁয়ার সাথে শীতার্ত ড্রাগনের মতন আমার বরফিলা নিশ্বাস মিশে গিয়ে খুশি হয়ে উঠতে চাইছে। টিভির পর্দায় তখন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর দেশে প্রত্যাবর্তনের আনন্দমুখর খবরের রিপ্লে চলে।
২৬ জুন বরফ ঠান্ডা ভোর থেকেই ক্যানবেরা এয়ারপোর্টে মানুষের ভিড়। ঘরের ছেলেকে ঘরে নিয়ে যেতে এসেছে সবাই। চরম শীত, কুয়াশা কিছুই বাঁধা হতে পারে নাই। এই মূহূর্ত ইতিহাসের অংশ হবে। টিভির পর্দায় আমরা দেখি প্রাইভেট চার্টার্ড বম্বার্ডিয়ার জেট এর জানালায় মুখ ফেরানো আধশোয়া জুলিয়ান। ভোরের আলো আসছে জানালা দিয়ে, সেই আলো তার চোখে মুখে। প্রায় ১৫ বছর পর ফিরে আসা। কেমন লাগছে তার?
সকাল সাড়ে ৭টায় প্লেন ক্যানবেরার মাটিতে নামল। পরের দৃশ্যে দেখলাম প্লেনের দরজায় অ্যাসাঞ্জ, সিঁড়িতে এক ধাপ নেমে দাঁড়ালেন, মুখে মৃদু হাসি। মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাত উপরে উঠল আর ক্যামেরার বাইরে থেকে সমবেত জনতার উল্লাস 'ওয়েলকাম হোম জুলিয়ান!', 'আমরা আপনাকে ভালোবাসি!'
সাবধানে নামলেন সিঁড়ি বেয়ে। পরনে সাদা শার্ট, কালো জ্যাকেট, বিস্কিট রঙের টাই। তার নৈমিত্তিক আচরণে মনে হয় যেন রোজকার কোনো করপোরেট মিটিং সেরে ফিরছেন। এত বছরের বন্দিজীবনের ধকল খুব একটা বোঝা যায় না চেহারায়, শুধু চলাফেরা হয়তো ধীর হয়েছে কিছুটা। খুব সচেতনভাবে তাকালে শারীরিক দুর্বলতা টের পাওয়া যায়।
তার পেছন পেছন হাঁটছেন আইনজীবী জেনিফার রবিনসন। তিনি প্লেনে অ্যাসাঞ্জের সাথে ছিলেন বাকি লিগ্যাল টিম, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার স্টিফেন স্মিথসহ। অ্যাসাঞ্জ ধীর পদক্ষেপে সামনে একটু ঝুঁকে হাসিমুখে পার হচ্ছেন টারমাক। মাঝে মাঝে হাত নাড়ছেন বাইরে জড়ো হওয়া খুশিতে আটখানা জনগণের উদ্দেশে। স্ত্রী স্টেলা অ্যাসাঞ্জ এর সামনে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কোলে তুলে ফেললেন, তাদের এই আলিঙ্গন আর চুমুর দৃশ্য কত শত মোবাইল ফোনে যে রেকর্ডেড হলো-আল্লাহ জানে। আমার চোখ ছলছল করে দুনিয়াদারি কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হয়ে গেল। আম্মার দিকে চেয়ে দেখি, সে চিড়া ভাজির বাটি হাতে হাসিমুখে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
তাকে বললাম, ইজেলের সম্পাদক তো আমারে বলছে অ্যাসাঞ্জরে নিয়ে লিখতে, কী লিখি বলো তো!
-লিখো যে অ্যাসাঞ্জ সত্যি কথা বলছিল বলে তারে ধরে নিয়ে অনেক মাইরধর করছে, এখন তারে ছেড়ে দিছে, সে ফিরে আসায় আমরা খুশি হইছি। কিন্তু তারে এত অত্যাচার করাতে ব্যাজার হইছি। এর থেকে প্রমাণিত হয়-দুনিয়া খুব খারাপ জায়গা, এইখানে সত্যি কথা বললেই ধরা খাবা!
আম্মার পরামর্শ নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলেও সে খুব ভুল কিছু বলে নাই।
যেদিন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে টেনে বের করে বেলমার্শ এর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে আটক করা হয়, তার ঠিক আগের দিন, ২০১৯ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখে টুইটারে তিনি লিখেছিলেন, 'কে আমি? আমি অধিকারের জন্য লড়েছি এবং সমস্ত অধিকার বঞ্চিত হয়েছি। আমি বাক্ স্বাধীনতার জন্য লড়েছি এবং আমার কথা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি সত্যের জন্য লড়াই করেছি এবং হাজারটা মিথ্যার কবলে পড়েছি।'
২০২১ সালে প্রকাশিত বই 'জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ইন হিজ ঔন ওয়ার্ডস'-এর ভূমিকায় লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশক চার্লস গ্লাসও এ রকমই বলেছেন। তিনি অ্যাসাঞ্জকে তুলনা করেছেন তরুণ কবি উইলফ্রেড ওয়েনের সাথে। ১৯১৭ সালে ওয়েনের বয়স ছিল চব্বিশ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ছিলেন। সে সময় যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তার পরিচয় হয় এডিনবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ফ্রাঙ্ক নিকলসনের সাথে। নিকোলসন তার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে বলেছেন, 'সে ছিল এমন একজন, যাকে মানুষের দুর্দশা অস্থির করে তুলত আর তা উপশম করতে না পারলে কিছুতেই স্বস্তি পেত না।'
উইলফ্রেডের এ সহমর্মিতা প্রসারিত ছিল দুর্দশাগ্রস্ত শত্রুপক্ষের প্রতিও, যারা ছিল একই রকম পাশবিক অভিজ্ঞতার স্বীকার। সে নিকলসনের কাছে জার্মান ভাষায় তালিম নিচ্ছিল, যাতে যুদ্ধের পরে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে। যদিও বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চার দিন আগে জার্মান মেশিনগান নিঃসৃত গুলিতে সে নিহত হওয়ায় বন্ধুত্বের স্বপ্ন আর বাস্তবায়িত হয় নাই। চার্লস গ্লাস বলেছেন, উইলফ্রেড এর বিখ্যাত কবিতা 'সুন্দর ও সজ্জা' অথবা 'সর্বশান্ত তারুণ্যের বন্দনা' যাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বলিদানের কথা এসেছে, তা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি মনে করায় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে।
গোপন ষড়যন্ত্রী ক্ষমতাবানদের বিপরীতে ওয়েনের মতনই অ্যাসাঞ্জ দাঁড়িয়েছেন প্রতারিতদের পক্ষে। তার মতনই মানসিক যন্ত্রণার ভার বহন করতে হয়েছে অ্যাসাঞ্জকে। আর যদি তার উপরে নিপীড়ন আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে তাদের নিয়তিও এক হতো হয়তো। ২০২১ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখে যুক্তরাজ্যের ম্যাজিস্ট্রেট ভেনেসা বারাইতসার রায় দিয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণের বিপক্ষে যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল গুপ্তচরবৃত্তি আইন লংঘনের অপরাধে ১৮টা মামলা এবং সর্বোচ্চ ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড।
বারাইতসারের মতে, অ্যাসাঞ্জ আরও ঘোরতর শাস্তি গ্রহণের মতন মানসিক অবস্থায় তখন ছিলেন না, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তাকে সোপর্দ করলে অ্যাসাঞ্জ আত্মঘাতী হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। তাকে তাই ফেরত পাঠানো হয়েছিল বেলমার্শের কারাগারে।
২০২১ সালে চার্লস গ্লাস যখন বইয়ের ভূমিকা লিখছিলেন, তখন পরবর্তী ধাপ ছিল অজানা, অস্পষ্ট। অ্যাসাঞ্জের তখন অপেক্ষা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। যদি বারাইতসারের রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে, শুধু তাহলেই আশা ছিল তিনি ছাড়া পেয়ে অস্ট্রেলিয়া ফিরবেন; রায় বদলালে তাকে তুলে দেয়া হবে যুক্তরাষ্টের আদালতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে। সেই অপেক্ষার অবসান হলো প্রায় চার বছর পর।
এর থেকে যে বার্তা পাওয়া যায়, তা স্পষ্ট-রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে নাক গলাতে এসো না। কারণ, তার হাত লম্বা এবং ঘুষি শক্ত। তারচেয়ে সাংবাদিক ভাইবোনেরা, তোমাদের জন্য নিরাপদ হবে ফ্যাশন, গাড়িঘোড়া, খাবারদাবার, নায়ক-নায়িকা অথবা অন্য সব বিজ্ঞাপনধর্মী আলাপ করা। বেশি উঁকিঝুঁকি দিও না। হুইসেলব্লোয়ারদের বলো চুপ থাকতে, অপরাধের নথিপত্র লুকিয়ে ফেলতে। জনগণকে অপ্রিয় সত্যর সামনে ফেলে কী হবে? বরং হাসিমুখে ঘোরোফেরো, এতেই শান্তি! কিন্তু অ্যাসাঞ্জের কত বড় সাহস! বহু আগেই তিনি বলেছেন, 'জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নাই, আমাদের ভাবনা মানুষ নিয়ে।'
মানুষ হিসেবে আমি আত্মকেন্দ্রিক। নিজের পারিপার্শ্বিক ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারি না। জন্মের পর থেকেই দুনিয়ায় ছোট-বড় নানা তুলকালাম চলছে, তবু আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, জীবনযাপন অব্যাহত। এর মাঝেও কিছু কিছু নাম, কিছু ঘটনা জানালায় ঝড়ের ঝাপটার মতন বারেবারে নাড়া দিয়ে যায়। অ্যাসাঞ্জ সে রকমই একজন।
তার নাম প্রথম শুনেছিলাম ২০০৬ সালে বেশ কাকতালীয়ভাবে। আমি তখন নিউজিল্যান্ডে থাকি, একটা ব্যাংকে কাজ করি। সেখানে আমার এক সহকর্মী জানাল, উইকিলিকস নামে নতুন এক ওয়েবসাইট হয়েছে, সেখানে দুনিয়ার সব গোপন তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে! আর সে সহকর্মী নাকি মেলবোর্নে এর প্রতিষ্ঠাতার বাড়িতে থেকেছে, বহুদিন তার বসার ঘরের সোফায় ঘুমিয়েছে। জানলাম, ১৬ বছর বয়স থেকেই অ্যাসাঞ্জ বিভিন্ন নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছেন।
এ সম্পর্কে ২০১১ সালে হ্যান্স উলরিখ অব্রিস্তের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'শৈশব থেকেই আমার কৌতূহল ছিল প্রচণ্ড আর কোনো কিছু জানার বিষয়ে যেকোনো বাধা অতিক্রম করতে চাইতাম। ১৫ বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন সফটওয়্যারের এনক্রিপশন ভাঙতে পারতাম আর পরে সরকারি কম্পিউটারে লুকানো তথ্যও বের করতে পারতাম। ইন্টারনেটের আগের যুগে অস্ট্রেলিয়া বেশ প্রাদেশিক দেশ ছিল, আমার জন্য এর বাইরের জগতে বুদ্ধিবৃত্তিক এই ভ্রমণটা আনন্দের ছিল।
পৃথিবীর ছোট এক কোনায় বসে ১৭ বছর বয়সে পেন্টাগনের অষ্টম কমান্ডের ভেতরে ঢুকতে পারা আমাকে মুক্তির আনন্দ দিয়েছিল। আমরা তখন একটা ম্যাগাজিন বের করতাম, সেই কাজের জায়গায় ফেডারেল পুলিশের রেডও হয়েছে। বিশাল অপারেশন ছিল সেটা। কিন্তু আমার মনে হতো, এই যে জ্ঞানের সম্পদ আবিষ্কার করলাম, তা সবার সাথে ভাগ করে নেয়া জরুরি, সেভাবেই প্রথমে শুরু করি।
পরে বুঝতে পারি, ইতিহাস তিন রকমের। প্রথম হলো জ্ঞান; যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা লবির মাধ্যমে সাবসিডাইজ করা হয়-যেমন একটা ওয়াটার পাম্প কীভাবে বানানো হবে, রান্না কী করে করে, খাবার থেকে কীভাবে বিষ সরানো হয় ইত্যাদি। এগুলো প্রাত্যাহিক কাজে লাগে, তাই একটা অর্থব্যবস্থা এসব তথ্য সরবরাহ করতে চায়।
দ্বিতীয় ধরন হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বা ঐতিহাসিক তথ্য; যা আগের থেকেই আছে, এখন তার কোনো ব্যবহার না থাকলেও এমনিতেই রয়ে গেছে। আস্তে আস্তে এরা গায়েব হয়ে যেতে থাকতে পারে। যেভাবে বই আউট অব প্রিন্ট হয়ে যায়। কিন্তু এটা একটা ধীর প্রক্রিয়া যেহেতু কেউ এসব ধ্বংস করতে তৎপর হয়ে উঠছে না।
তার তৃতীয় ধরনের তথ্য নিয়েই আমার আগ্রহ; যা কেউ না কেউ চেষ্টা করছে লুকাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই তথ্যগুলো আমাদের জানতে দেয়া হয় নাই। তাই যদি জগৎ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া গড়ে ওঠে পরিপার্শ্ব, একে অপরকে বুঝে ওঠার মাধ্যমে, তাহলে তাতে বিশাল একটা ফাঁক আছে, যা ভরাট করা একটা ন্যায়সঙ্গত ও সভ্য পৃথিবীর জন্য জরুরি।
২০১০ সালে যখন মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য চেলসি ম্যানিংয়ের থেকে পাওয়া ইরাক আর আফগানিস্তানের ওপর মার্কিন হামলার ভিডিও ফুটেজসহ হাজার হাজার তথ্য ফাঁস করা হলো উইকিলিকসে, অ্যাসাঞ্জ রাতারাতি সারা দুনিয়ার মনোযোগ কাড়লেন এবং ক্ষমতাবানদের রোষানলে পড়লেন। একই বছর সুইডেন কর্তৃপক্ষের আনা ধর্ষণের অভিযোগে যুক্তরাজ্যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ অভিযোগ পরবর্তীতে সুইডেন উঠিয়ে নিয়েছিল।
তার আগেই অ্যাসাঞ্জ ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। স্ত্রী স্টেলার সাথে তার পরিচয়, প্রেম এবং দুই সন্তান গ্যাব্রিয়েল ও ম্যাক্স গর্ভে এসেছে ইকুয়েডরে আশ্রয়ের সময়েই। তারা এই প্রথম তাদের বাবাকে একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে কাছে পাবে।
আচ্ছা সাইপান কোথায় রে? এত জায়গা ফেলে ওইখানে বিচার হইল কেন?
আম্মা জানতে চায়।
তাকে জানালাম প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্রের আওতাধীন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের রাজধানী সাইপান। জুলিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে যেতে চান নাই বলেই এখানে বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে।
-সে যদি সব দোষ স্বীকারই করবে, তাইলে এত দিন এত কষ্ট কইরা কী লাভ হইল?
-সে কি আর শোলে সিনেমার বাসন্তী নাকি যে গাব্বার সিং বোতল ভাঙা কাচের টুকরা ছড়ায়ে দিবে আর সে তার উপরে রক্তাক্ত পায়ে নাচতে নাচতে বলবে 'যাব তাক হ্যায় জান জানেজাঁহা ম্যায় নাচুঙ্গি?' এইখানে হইল অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
-কী রকম?
-মাঝে মাঝে বড় কাজের জন্য ছোট ছাড় দিতে হয়। অ্যাসাঞ্জ প্লি ডিল সাইন করছে। তার বিরূদ্ধে তো অনেকগুলা মামলা ছিল, একটাতে দোষ স্বীকার করছে আমেরিকার কথামতো। আসলে বিষয় হইল কিছুই না নিয়া ছাইড়া দিলে আমেরিকার মানসম্মান থাকে? তাই টোকেন স্বীকারক্তি এটা।
-হুম আলবানেজি তো ওই রক্তচোষা ঘাটের মড়া বাইডেনটার সাথে আগেই কথা বলছিল, তখনই নিশ্চয়ই ঠিকঠাক হইছিল, না?
আম্মার এ রকম নাটকীয় শব্দচয়নে হাসি পেলেও একই সাথে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের একটা উক্তি মনে পড়ল। ২০১৭ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প না হিলারি ক্লিনটন কাকে তিনি সমর্থন করেন। উত্তরে তিনি বলেছেন, 'আমাকে আপনি কলেরা আর গনোরিয়ার মধ্যে একটা বেছে নিতে বলছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটাও চাই না।'
বছরের পর বছর বন্দিজীবন যাপন করেও নিজেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেননি তিনি। তার রসবোধ অটুট থেকেছে। বেশ কয়েক বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। সেই সাথে অ্যাসটেরিক্স কমিকসের নতুন সিরিজের একটা চরিত্রও অ্যাসাঞ্জ থেকে অনুপ্রাণিত। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এর মধ্যে কোনটা বেছে নেবেন তিনি। জবাবে অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন, অবশ্যই অ্যাস্টেরিক্স! অন্তত খুনিদের সাথে একদল হওয়ার ভয় থেকে তো রেহাই পাব!
নিজের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে তার স্পষ্ট ধারণা আমরা টের পাই এই উক্তি থেকে-
'আমরা কাজ করি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। তিমিদের বাঁচাতে যাওয়া আমাদের কাজ না। আমাদের কাজ হলো মানুষকে পর্যাপ্ত তথ্য দেয়া, যার উপর ভিত্তি করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে তারা তিমি হত্যা সমর্থন করবে কি করবে না। এটা হলো একটা ন্যায়সঙ্গত ও সুশীল সমাজ তৈরির কাঁচামাল, যা ছাড়া আমরা অন্ধকারে পাল তুলেছি।'
ইকুয়েডরের দূতাবাসে ছয় মাস পার হয়ে গেলে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে এক বিবৃতিতে অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন-
'সমস্ত কিছু সত্যের উদ্ঘাটনকেই অনুসরণ করে। ইঁট যতটা মজবুত হবে, আমাদের দালান ততই উঁচু হতে পারবে। আমাদের আদর্শের সত্যতার উপর নির্ভর করে সভ্যতার শক্তি। যখন আমাদের ইমারত নির্মাণ করে দুর্নীতিবাজেরা, যখন সিমেন্টে বালু মেশানো হয়, যখন নিখুঁত ইস্পাতের বদলে ব্যবহৃত হয় জং ধরা লোহার টুকরা-সেসব দালান তখন বসবাস অযোগ্য। আমাদের সংবাদমাধ্যম যখন দুর্নীতিগ্রস্ত, বুদ্ধিজীবীরা ভীতু, যখন আমাদের ইতিহাস ভর্তি অর্ধ-সত্য আর মিথ্যা দিয়ে-কখনোই আমাদের সভ্যতা ন্যায়পরায়ণ হবে না। আকাশচুম্বী হতে পারবে না। আমাদের সমাজগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক বস্তি। দুনিয়া এবং একে অপরের সম্পর্কে আমাদের ধারণা তৈরি করেছে সেই একই সিস্টেম, যা বারে বারে মিথ্যা বলে আমাদের যুদ্ধে নামিয়েছে আর কোটি কোটি মানুষ মেরেছে।' একে অপরকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে আমাদের। যাঁরা সত্য উদ্ঘাটন করেন, তাদের উদ্যাপন করতে হবে আর যে পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি, তাকে বুঝে ওঠার ক্ষমতা যারা বিষাক্ত করে তোলে, তাদের অভিযুক্ত করতে হবে। আমাদের কথোপকথন এর মানই নির্ধারণ করবে আমাদের সভ্যতার সীমানা...
হোয়াইট হাউসে আসল গণতন্ত্র নেই। ক্যানবেরাতেও নেই। গণতন্ত্র থাকে মিথ্যার বিরূদ্ধে সত্যের বলে বলিয়ান মানুষের প্রতিরোধে, তাহরির থেকে এই লন্ডনে। প্রতিদিন, সাধারণ মানুষেরা আমাদের শেখান গণতন্ত্র মানে কথা বলার অধিকার আর ভিন্নমত। যখন আমরা, সাধারণ মানুষেরা, প্রতিবাদ বন্ধ করি, বিরোধিতা বন্ধ করি যখন আমরা বিক্ষিপ্ত আর চুপ হয়ে যাই, একে অপরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই, আমরা তখন আর স্বাধীন থাকি না। সত্যিকার গণতন্ত্র মানে যোগফল-সমষ্টি-আমাদের সকলের প্রতিরোধের।
২৬ তারিখ রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে স্টেলা অ্যাসাঞ্জ তাদের সমর্থকদের ধন্যবাদ দেয়ার পরে অনুরোধ করেন জুলিয়ান এবং তাদের পরিবারকে কিছুদিন ব্যক্তিগত সময় দেয়ার জন্য, 'জুলিয়ানের কিছু সময় দরকার আবার স্বাধীনতায় অভ্যস্থ হওয়ার জন্য। গতকাল একজন আমাকে বলেছেন স্বাধীনতা খুব ধীরে আসে, আর আমি চাই জুলিয়ান তাকে আবার আবিষ্কার করার মতো পর্যাপ্ত পরিসর পাক, ধীরে এবং দ্রুততায়।'
আমাদের বসার ঘরের জানালায় তখন কুয়াশা জমেছে। আধো অন্ধকার করে টিভির আলো পড়েছে আম্মার চামড়ার ভাঁজে। তার চোখ ঝলমল করছিল। একটা ক্লান্তি মেশানো প্রশান্তি তার চোখেমুখে। আমরা ঘরে ফিরলে যেমন থাকে।