জাতিবিদ্বেষ আর যুদ্ধের শিকার হয়ে বার্মা ছাড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ
১৯৪১ সালের এক মঙ্গলবার সকালে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ শুরু হয় রেঙ্গুনে। এ হামলার মাধ্যমেই বার্মায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধঘোষণা করে জাপানিরা। এর জবাবে ব্রিটিশরা যে অভিযান চালায় তাতে সামরিক কৌশলের যেমন ঘাটতি ছিল, তেমনি তারা নিতে পারেনি যুক্তিসঙ্গত কোনো পদক্ষেপও। ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসে শত্রুপক্ষ।
এটি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে দীর্ঘতম পশ্চাদপসরণ। পশ্চিমা বার্মার দুর্গম অরণ্যের ভেতর দিয়ে পালাবার সময় তাদেরকে কেবল জাপানিদের সাথেই লড়তে হয়নি—লড়তে হয়েছে ম্যালেরিয়া, আমাশয় ও স্ক্রাব টাইফাসের সাথেও।
এই একই সময়ে জাপানী সৈন্যদের ভয়ে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় বার্মা ছেড়ে পালিয়ে আসে। বার্মা থেকে উদ্বাস্ত্তু হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কিছুকাল আগেও বার্মিজ বাহিনির আক্রমণে, জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
জাপানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে প্রায় ৫ লক্ষ ভারতীয় পায়ে হেঁটে এশিয়ার সবচেয়ে বন্ধুর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল পাড়ি দিয়েছিল। চরম বৈরি আবহাওয়া, বন্ধুর পথ ও ভয়াবহ কায়িক পরিশ্রমের ধকল সয়ে ভারতে পৌঁছেছিল তারা। পথশ্রমের ধকল সইতে না পেরে পথেই মারা যায় বহু মানুষ।
বার্মায় ভারতীয়রা
১৯ শতকের শেষে ও ২০ শতকের গোড়ার দিকে, কর্মসংস্থান ও আর্থিক সচ্ছলতার আশায় অনেক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে বার্মায় পাড়ি জমায়। এই বাংলা অঞ্চল থেকেও অনেকে কর্মসূত্রে রেঙ্গুনবাসী ছিলেন। ১৯৩১ সালের মধ্যে পুরো উপনিবেশিক ভারত থেকে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ঠাঁই নেয় বার্মায়। এদের বেশিরভাগই জড়িত ছিল নানা ধরনের শারীরিক শ্রমের সাথে। তবে প্রশাসনিক কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সামরিক কর্মচারীদের মধ্যেও এই ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। বার্মিজ অর্থনীতি ও সরকারে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ফলে দেশটিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল তারা।
কিন্তু এই প্রভাব ভারতীয়দের বার্মার সমাজে একাত্ম হতে সাহায্য তো করল না-ই, উল্টে তাদের জন্য আরো ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াল। ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে বার্মিজ জাতীয়তাবাদের ধারণা ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। বার্মিজদের দৃষ্টিতে ভারতীয়রা ছিল ব্রিটিশদের আমদানিকৃত ঔপনিবেশিক বিপর্যয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতীয়রা অন্যায্যভাবে তাদের চাকরি ও বার্মার সম্পদ ভোগ করছে। ফলে মহামারির মতো ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।
যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকটি ভারতবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। এর ফলে বার্মিজ সমাজে নিজেদের অবস্থান ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ভারতীয়রা। সংখ্যাধিক্যের কারণে রেঙ্গুনকে বলা হতো 'ভারতীয় শহর'। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাক্ষী হয় শহরটি। ১৯৩০ সালে রেঙ্গুনে ছড়িয়ে পড়া কুখ্যাত 'ডকইয়ার্ড দাঙ্গায়' একশোজন মানুষ মারা যায়; আহত হয় হাজারেরও বেশি। তাদের প্রায় সবাই-ই ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাওয়া মানুষ।
১৯৩৮ সালে আরেকটা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এবার ভয়াবহতার মাত্রা ছিল আগের চেয়েও বেশি। ২০০ জন মারা যায় এ দাঙ্গায়, প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয় ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত লোকজনের সয়-সম্পত্তির। এভাবেই আসলে বার্মিজদের তীব্র জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষেরে শিকার হয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাওয়া মানুষেরা। যুদ্ধ তাদের বার্মায় পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তোলে
জাপানিরা আসছে
১৯৪১-এর শেষ দিকে রেঙ্গুনে বোমাবর্ষণ শুরু হতেই শহর ছাড়তে শুরু করে বিপুল সংখ্যক ভারতীয়। প্রায় ১৫,০০০ মানুষের প্রথম দলটার পরিকল্পনা ছিল শহর থেকে বেরিয়ে উত্তরের শহর তাউঙ্গুপের ছোট উপকূলীয় গ্রামে যাবে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে চলে যাবে চট্টগ্রামে।
কিন্তু ব্রিটিশদের অন্য মতলব ছিল। সব মানুষ চলে গেলে বার্মায় ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে, এই ভয়ে গভর্নর জেনারেল রেজিনাল্ড স্মিথ তাউঙ্গুপ যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিলেন। এটি ছিল ভারতীয় অভিবাসীদের বিষয়ে সরকারের নেওয়া প্রথম অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
সেইসাথে রেঙ্গুন থেকে ছাড়া জাহাজগুলোতে সস্তা ডেক-টিকিট বিক্রি করাও নিষিদ্ধ করা হলো। বেশিরভাগ ভারতীয়েরই এর চেয়ে দামি টিকিট কেনার সামর্থ্য ছিল না। ফলে ধনী ভারতীয় আর ইউরোপিয়ানরাই কেবল জাহাজে চেপে রেঙ্গুন ছাড়তে পারল। বাকিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল শহরে।
১৯৪২ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে জাপানিরা মৌলমাইন দখল করে নেয়। তারা তখন রেঙ্গুন থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। সে সময় ভারতীয় হিসেবে পরিচিত একটা দলকে রেঙ্গুন ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ৭০,০০০ ভারতীয়কে জাহাজে করে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। কিন্তু তখনও ২ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় রয়ে গেছে রেঙ্গুন ও আশপাশের অঞ্চলে।
তাদের শহর ছাড়ার ব্যবস্থা না করেই ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রায় পুরোটাই উত্তরে সরিয়ে নেওয়া হয়। থেকে যান শুধু গভর্নর আর কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রশাসন ছাড়া ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লেন গভর্নর স্মিথ। তিনি ভাবলেন এখন আর দায়িত্ব পালন করে কোনো লাভ নেই। তাই নিজেকে গৃহবন্দি করে বিলিয়ার্ড খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। এদিকে জাপানিরাও প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অগত্যা ভারতীয়রা সিদ্ধান্ত নিল, নিজেদের পথ নিজেরাই দেখে নেবে। জাপানি নৌবাহিনীর ভয়ে রেঙ্গুনে জাহাজ আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই ভারতীয়রা স্থির করল, সেই তাউঙ্গুপেই যাবে পায়ে হেঁটে।
তাউঙ্গুপে যাওয়ার জন্য আদতে কোনো রাস্তাই ছিল না। ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে উপকূলীয় শহরটিতে পৌঁছতে হয়েছিল অভিবাসীদের। দলটির থাকা-খাওয়ার দেখভাল করার জন্য পুরো পথে মাত্র একজন ব্রিটিশ অফিসার ছিলেন। তিনি রবার্ট হাচিংস। অবস্থা আরো সঙিন করে তোলে সঙ্গে আসা কয়েকজন বার্মিজ কর্মকর্তা।
স্থানীয় বার্মিজরা জানত ব্রিটিশদের ধাওয়া দিচ্ছে জাপানিরা, তাদের হাতে এখন বলতে গেলে কোনো ক্ষমতাই নেই। এই সুযোগে তাউঙ্গুপ রুটে প্রবেশাধিকার দেওয়ার বিনিময়ে ভারতীয়দের কাছ থেকে 'ফি' আদায় করতে লাগল স্থানীয় পুলিশ। তার ওপরে ভালো স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় কলেরা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে মারা পড়তে লাগল ডজন ডজন ভারতীয়। রোগের বিস্তার ঠেকাতে তড়িঘড়ি করে গণকবর খুঁড়ে মৃতদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। এদিকে পানযোগ্য পানিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠল। সুপেয় পানির অভাবে মারা পড়ল অনেকে। রেঙ্গুন থেকে দলটির সঙ্গে যে কজন চিকিৎসক এসেছিলেন, তাদের একজন ছিলেন এপিডেমিওলজিস্ট ড. সেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন অসংখ্য লাশ পড়ে রয়েছে পথে। কোথাও কোথাও তো মৃতদেহ না মাড়িয়ে হাঁটাই যাচ্ছিল না।
এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও, দেড় থেকে দুই লাখ অভিবাসী তাউঙ্গুপ হয়ে ভারতে পৌঁছে। বিপজ্জনক এই যাত্রায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তার সঠিক হিসাব আজতক জানা যায়নি।
অবশ্য এটা ছিল আসন্ন প্রাণক্ষয় ও দুর্ভোগের সূচনামাত্র। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ দক্ষিণ বার্মার বেশিরভাগ এলাকা জাপানিদের দখলে চলে যায়। ফলে বাকি ভারতীয়রা—যাদের বেশিরভাগই মান্দালয়ের আশেপাশে থাকত, এদের বড় একটা অংশ ছিল বাঙালি—উত্তর দিক দিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। অভিবাসীরা মূলত দুটো পথ ব্যবহার করত। প্রথমটা ছিল টামু থেকে নাগা পর্বত পেরিয়ে ইম্ফল পর্যন্ত পঞ্চাশ কিলোমিটার দীর্ঘ। দ্বিতীয় পথটা আরো উত্তরে হুকাওয়াং উপত্যকা হয়ে লেদোর দিকে, যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় মৃত্যু-উপত্যকা নামে।
বঞ্চিত-নিপীড়িত
দক্ষিণ বার্মার পতনের পর ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মান্দালয়ের দিকে যেতে থাকে। মার্চের অর্ধেক পেরোনোর আগেই মান্দালয়ের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ১ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় আশ্রয় নেয়। জাপানিরা ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় বার্মার দিকে সরে আসছিল, তীব্র হচ্ছিল তাদের বোমাবর্ষণ। পর্যাপ্ত বোমা আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া বহু শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছিল।
এই অরাজকতার মধ্যে সামরিক বাহিনীর পতন হতেও বেশি দেরি নেই, এ আশঙ্কায় হাজার হাজার অভিবাসী টামু গিরিখাতের দিকে রওনা দেয়। এই পথটি উত্তরে চিন্দউইন উপত্যকা ধরে কালেওয়ার দিকে এগিয়েছে। সেখান থেকে ধুলোয় ঢাকা দীর্ঘ পথটা চলে গেছে টামু গিরিখাত পর্যন্ত, সেখান থেকে ইম্ফল অবধি।
যানবাহনের অভাবে বেশিরভাগ ভারতীয়কে মান্দালয় থেকেই হাঁটা শুরু করতে হয়েছিল। অল্প যে কটা মোটর কনভয় কালেওয়া-পানে যাত্রা করেছিল, ওগুলোতে ওঠার অধিকার ছিল কেবল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ানদের। এদের বেশিরভাগই ছিল বার্মা অয়েল কোম্পানির কর্মচারী। এই বৈষম্য এমনকি 'সাদা' রুট ও 'কালো' নামে দুটো আলাদা পথেরও সৃষ্টি করে। প্রথম পথটি ছিল তুলনামূলক আরামদায়ক। প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থাও ছিল এ পথে। কিন্তু দ্বিতীয় পথটি ছিল অনেক বেশি দুর্গম এবং অনিরাপদ।
'কালো রুট' ধরে আসা হাজার হাজার পরিবারের মধ্যে একটি ছিল ১৩ বছর বয়সি নরসিমহা রামমূর্তির পরিবার। ১৪ দিনের পদযাত্রায় তাদের কপালে খাবার বলতে জুটেছিল কেবল চালের জাউ। তা-ও আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়েছিল তাদের। অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল পরিবারটি। এক মধ্যবয়স্ক, ক্ষীণস্বাস্থ্য পিতাকে তার দুই সন্তানকে ধূলিময় পথের ধারে ফেলে চলে আসতে দেখেছিল রামমূর্তি। বাচ্চা দুটোকে দেবার মতো খাবার বা বইবার মতো শক্তি, কোনোটাই ছিল না তার। অগত্যা ওদেরকে মরার জন্য ফেলে আসা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না লোকটার। এর কয়েকদিন আগেই অনাহারে ও অতি-পরিশ্রমে মারা গিয়েছিল তার স্ত্রী।
সেই ভয়াবহ সফরে বেঁচে যাওয়া আরেক কিশোর ডোনাল্ড মেনেজেস। তার ভাগ্য আরেকটু ভালো, কারণ তার পরিবার ছিল 'হোয়াইট রুটের' যাত্রী। সফরকালে একাধিক জায়গায় সামরিক কর্মীদের সাহায্য পেয়েছিল তারা। তবু সংকটের কারণে বিশেষ সুবিধাভোগীদের মধ্যেও গড়ে ওঠে বৈষম্যের দেয়াল। এক সকালে প্রচণ্ড কম্পনে ঘুম থেকে জেগে ওঠে মেনেজেস। ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। পরে দেখে, একটা হাতির পাল যাচ্ছে ওদের পাশ দিয়ে। হাওদার ওপর বসে থাকা যাত্রীরা ছিল বোম্বে বার্মা ট্রেডিং কর্পোরেশনের ইউরোপীয় কর্মচারীদের স্ত্রী-সন্তান। মেনেজেস পরিবারকে বেশিরভাগ পথই হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত দুর্গম পথ তিন সপ্তাহে পাড়ি দিয়েছিল তারা।
এপ্রিলের শেষে সবাইকে পালাতে বলে দেয় ব্রিটিশরা। এতদিন সামান্য যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল বেসামরিক নাগরিকদের, এবার সেসব দেওয়া হতে লাগল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে। সে সপ্তাহেই বার্মা ছেড়ে পালান গভর্নর জেনারেল স্মিথ। তখন হাজার হাজার অভিবাসী পাড়ি জমাচ্ছিল ভারতে, কিন্তু তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলেনি সশস্ত্র বাহিনী।
গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে সেবার বর্ষা শুরু হলো মে-র গোড়ার দিকে। ফলে ভারতে যাবার রাস্তা আরো বিপজ্জনক ও বন্ধুর হয়ে উঠল। পথের চিহ্ন ধুয়ে গেল বৃষ্টির পানিতে, শুরু হলো বন্যা, আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ম্যালেরিয়া। আগে এই যে যাত্রা কষ্টসাধ্য ছিল, এখন রাতারাতি তা হয়ে উঠল দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহ। দলে দলে মানুষ মরতে লাগল। সারা পথ জুড়ে পড়ে রইল অসংখ্য মৃতদেহ। কেউ অনাহার মারা গেছে তো কেউ মরেছে অত্যধিক পরিশ্রমে, কেউ মরেছে রোগে ভুগে তো কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও টামু গিরিখাত ধরে এগোতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। অস্থায়ী শরণার্থী শিবির স্থাপন করা কংগ্রেস, মাড়োয়ারি এসোসিয়েশন এবং ইন্ডিয়ান টি প্লেন্টারস এসোসিয়েশনের সদস্যরা কয়েকটা পরিবারের দুরবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।
জাপানিদের উত্তর দিকে এগিয়ে আসা অব্যাহত থাকার ফলে টামু গিরিখাতের রাস্তা ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশিষ্ট ভারতীয়রা হুকাওয়াং উপত্যকার রাস্তা ধরতে বাধ্য হয়। ভারত থেকে বার্মায় প্রবেশের সর্বউত্তরের পথ হলো হুকাওয়াং উপত্যকা। এই ৪৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া অভিযাত্রীদের একজন বার্মা রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার আলফ্রেড ফার্নান্দেস। জাপানি হামলার ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবারকে স্টিমারে করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারলেও, তাঁকে বার্মা ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এক বন্ধুর সঙ্গে বার্মা ছাড়ছিলেন তিনি। তাঁদের আগে মাত্র পাঁচজন ইউরোপীয় অভিযাত্রীর পা পড়েছিল হুকাওয়াং উপত্যকায়। কিন্তু তাঁদের কেউই বর্ষার সময় এ উপত্যকা পাড়ি দেয়নি।
খাড়া, বিপজ্জনক পাহাড় বাওয়া এবং পিছল ঢাল বেয়ে নামার সময় ফার্নান্দেস আর তাঁর সহযাত্রীদের কাছে পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নদী পার হওয়ার সময় স্রোতে ভেসে গিয়েছিল বহু মানুষ। বাকিরা আক্রান্ত হয় মারাত্মক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগে। আর্দ্র জলবায়ুর কারণে সেসব রোগ হয়ে ওঠে আরো ভয়াবহ। সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের মল-মূত্র আর পচা লাশের গন্ধে শ্বাস নেওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়ত।
এসব অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও কখনও-সখনও ঝলসে উঠত মানবতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ফার্নান্দেসসহ আর তাঁর সহযাত্রীরা পুরো পথে একবারও কোনো মৃতদেহর কাছ থেকে কাউকে কিছু লুটপাট করতে দেখেননি। পা থেকে জুতো খুলে নেওয়া ছাড়া কোনো মৃতের কাছ থেকে আর কিছুই নিত না কেউ। এমনকি বিস্তর টাকাপয়সা নিয়ে যেসব মৃতদেহ পড়ে থাকত, সেগুলোকেও স্পর্শ করে দেখত না কেউ। বিপজ্জনক, ক্লান্তিকর যাত্রা শুরুর ২২ দিন পর আসাম রেলওয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছেন ফার্নান্দেস।
বিস্মৃতরা
১৯৪২ সালের গ্রীষ্মে অনেকেই আটকা পড়েছিল বার্মার দুর্গম অরণ্যে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেও অসমিয়া সমভূমির জঙ্গল পাড়ি দিচ্ছিল অনেক অভিবাসী। সর্বশেষ দলটি যখন নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছায়, ততদিনে কমপক্ষে ৪০,০০০ ভারতীয় মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। যাত্রা শুরু করার পর পশ্চিম বার্মায় পৌঁছে উধাও হয়ে যায় অনেকগুলো দল। তাই মারা যাওয়া ভারতীয়ের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর পরও বহু মৃতদেহ পাওয়া যেতে থাকে। বেসামরিক জানমালের অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতি হলেও, তুলনায় যুদ্ধে ১০,০০০-এরও কম সৈন্য হারায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।
জানমালের এত বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের নির্দয় উদাসীনতা এবং প্রস্তুতির ঘাটতি। তারপরও একজন প্রশাসক বা সরকারি কর্মকর্তাকেও এর জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি। ব্রিটিশ প্রশাসন ১৯৪৩ সালে 'জাতীয় সুরক্ষার' স্বার্থে স্রেফ ভারতীয় আইনসভার সদস্যদের প্রস্তুত করা একটা প্রতিবেদন পাঠায় লন্ডনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সবচেয়ে সহজ কাজটাই করলেন সবাই। বেমালুম ভুলে গেলেন এই মানবিক সংকটকে। ভারতে পৌঁছানোর পর আবার নতুন করে জীবনযুদ্ধের কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েতে হয়েছিল অভিবাসীদের। তাদের ভারতে আসার নির্মম ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় নথিবদ্ধ করার দিকে কারোরই নজর ছিল না। বার্মা থেক আসা এই অভিবাসনের ইতিহাস সবসময়ই উপেক্ষিত থেকে গেছে।
ব্রিটিশদের পরাজয় কিংবা যুদ্ধরত সৈনিকরা নীচু জাতের দক্ষিণ এশীয় ছিল বলেই বিস্মৃত হয়ে গেছে যুদ্ধের এই অধ্যায়। এমনকি এ অধ্যায়ের কথা বিস্মৃত হয়েছে এ যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সাধারণ মানুষরাও।
তথ্যসূত্র: New Songs of the Survivors: The Exodus of Indians from Burma by Yvonne Vaz Ezdani.