১৩৫ কোটি টাকার আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর অব্যবহৃত পড়ে আছে গুদামঘরে
পরিচিত সেই দৃশ্য, আবারো ফিরে ফিরে আসে। দেশের জনস্বাস্থ্য খাতে অবহেলায় এ চক্র দীর্ঘদিনের।
দেশজুড়ে মহামারি যখন দৈনিক বাস্তবতা তখন আমরা দেখি- সম্মুখসারির কর্মীদের দুর্বল মানের সুরক্ষা নিয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য লড়তে। আমরা দেখি, তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ভর্তি কোভিড রোগীরা মারা যাচ্ছে- হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বা ভেন্টিলেটর ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে।
এসব দৃশ্য আমাদের চারপাশে। আমাদের জন-জীবনের প্রতিদিনকার হালচিত্র।
তবে না স্বাস্থ্য কর্মী, না মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলা কোভিড রোগী- কেউই জানেন না; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুদামে ১৩৫ কোটি টাকা দামের এমন কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে- যা মহামারি পরিস্থিতিতে আরো কিছু চিকিৎসক, নার্স ও রোগীর জীবন বাঁচাতে পারত।
গুদামে থেকে থেকেই কর্মক্ষমতার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে দামি চিকিৎসা সরঞ্জামগুলোর। এর মূল কারণ; বিদ্যমান মজুদ ব্যবহার না করেই এসব সরঞ্জামের নতুন চালান কিনেছিল কেন্দ্রীয় ওষুধ সংরক্ষণ ডিপো (সিএমএসডি)। মহামারির মধ্যে সরকার ব্যয় সংকোচন এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার অঙ্গীকার করলেও, ঠিক তার পরিপন্থী ছিল এ পদক্ষেপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) সূত্রে জানা যায়, পড়ে থাকা চিকিৎসা উপকরণের মধ্যে রয়েছে; নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বিশেষ শয্যা, থ্রি-ফাংশন/ ৫ ফাংশন শয্যা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), এন-৯৫ মাস্ক, গ্লাভস এবং ৭০ হাজার পলিমারেস চেইন রি-অ্যাকশন (পিসিআর) কিট।
এগুলি বিশ্বব্যাংকের চলমান অর্থায়নে "কোভিড -১৯ জরুরি প্রতিক্রিয়া এবং মহামারি প্রস্তুতি" প্রকল্পের আওতায় কেনা হয়েছিল।
এদিকে, দেশে মহামারি পরিস্থিতির শুরুর দিকে নেওয়া অত্যন্ত সংক্রামক কোভিড -১৯ প্রতিরোধের কার্যক্রমকগুলোও সরকার শিথিল করছে।
গুদামের মজুদ থেকে কিছু পিপিই বিতরণ করা হলেও- আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর, থ্রি-ফাংশন/ ৫ ফাংশন শয্যা ইত্যাদি- এখনও পড়ে আছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন মহাখালি মার্কেট ভবনের গুদামঘরে।
এমনকি ডিজিএইচএস নিজেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ যদি স্বল্পতম সময়ে ব্যবহার না করা হয়- তবে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে এসব কিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে চলমান দুটি প্রকল্প পর্যালোচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল।
ডিজিএইচএসের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সভায় বলেন, আইসিইউ বেডসহ চিকিৎসা সরঞ্জামগুলি নিয়মিত ব্যবহারের জন্য দ্রুত বরাদ্দ না দিলে অকেজো হয়ে উঠতে পারে।
সিএমএসডি-র পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামান বলেন, ইতিমধ্যেই বিদ্যমান স্টক সম্পর্কে জানা থাকলে- তারা একই ধরনের সরঞ্জাম কিনতেন না।
এব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব মো: আবদুল মান্নান- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে,পূর্ব চাহিদাপত্র ব্যতীত কোনো কিছুই কেনার কথা নয়।
''কেন এবং কীভাবে এই সরঞ্জামগুলি কেনা হয়েছে এবং কেন তা ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে- সেই ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই ভালো দিতে পারবে। কারণ তারাই এ ক্রয় প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল । তবে আমরা সিএমএসডিকে নির্দেশ দিয়েছি যে, কোনও নির্দিষ্ট চাহিদাপত্র ছাড়া তারা যেন কোনও জিনিস না কেনে।''
তবে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অ্যাডমিন) ডাঃ নাসিমা সুলতানা বলেছেন, '' এসব সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা উপকরণের চাহিদাপত্র ছিল কিনা- সেটা সিএমএসডি কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে। কারণ সাধারণত তারাই এ সমস্ত জিনিস কিনে থাকে।''
এব্যাপারে তিনি বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্চ মাসে কোভিড -১৯ সংক্রমণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর এপ্রিল মাসে ডিজিএইচএস এবং সিএমএসডি কর্মকর্তারা এই উপকরণগুলি কিনেছিলেন। এসময় সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সরকার সংস্থা দুটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বদলি করে। কিন্তু, তারপরে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়- তারাও ওই একই উপকরণ আবার কেনেন।
এ অবস্থায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ডিজিএইচএস এর কাছে চিকিৎসা উপকরণগুলি দ্রুত বিতরণের করা যায়, এমন হাসপাতালের তালিকা চেয়েছে।
এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর- করোনার মহামারি মোকাবিলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে সংযোগ পরিচালক এবং সিএমএসডি'র প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া জানান, ডিজিএইচএসের ক্রয়-প্রক্রিয়ায় সরবরাহ চক্রের অদক্ষতার কারণে অনেক সরঞ্জাম ও আসবাব দীর্ঘকাল ধরে সিএমএসডি গুদামে পড়ে থাকে।
''চাহিদাপত্র প্রস্তুতের সময় পণ্যগুলির সঙ্গে গন্তব্যের তালিকা যুক্ত করা হলে এ জাতীয় পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে'' বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর মুজাহেরুল হক- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের ক্রয় প্রক্রিয়া দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলে, দুর্নীতির মাধ্যমে বেশি দামে উপকরণ কিনে তা ফেলে রেখে, পরবর্তীতে ওই একই সরঞ্জাম কেনার চর্চা দীর্ঘদিনের। এভাবে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপব্যবহার হয়। মহামারির মধ্যে সেই পুরনো চিত্র নতুন করে সামনে এসেছে- এঘটনার মধ্য দিয়ে।
''এমন অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাছাড়া, কঠিন নজরদারিও থাকতে হবে ক্রয়ের ক্ষেত্রে। কেবলমাত্র, তাহলেই জনগণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুফল ভোগ করতে পারবে'' তিনি যোগ করেন।
(সংক্ষেপিত)
মূল লেখা: Tk135cr ICU beds, ventilators lie unused in warehouse
অনুবাদ: নূর মাজিদ