পোকরভস্ক দখলের দ্বারপ্রান্তে রুশ বাহিনী, ইউক্রেনের কুরস্ক আক্রমণ গতি হারিয়েছে
রুশ বাহিনী বর্তমানে ইউক্রেনের পোকরভস্ক শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে । এই শহরটি ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ ও রসদ কেন্দ্র। পোকরভস্কে একটি প্রধান রেলওয়ে স্টেশন এবং বড় রাস্তা থাকায় তা পূর্ব ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়া এমন এক সময়ে এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ লাভ করে চলেছে যখন ইউক্রেনীয় সেনারা সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে কিয়েভের সমালোচকরা বলছেন, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী একটি বড় ভুল করেছে। পূর্ব ফ্রন্টলাইনে শক্তি বাড়ানোর পরিবর্তে কুরস্কে সৈন্য পাঠিয়ে, তারা পোকরভস্কসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে বিপদে ফেলেছে।
ফ্রন্টলাইন পরিদর্শনকালে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কি বলেন, রাশিয়া তাদের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে।
"পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন," বুধবার স্বীকার করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
সামরিক বিশেষজ্ঞ মিখাইলো ঝিরোকোভ সতর্ক করে বলেন, "যদি আমরা পোকরভস্ক হারাই, তাহলে পুরো ফ্রন্টলাইন ভেঙে পড়বে।"
উল্লেখ্য, গত ৬ আগস্ট সীমান্তবর্তী রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইউক্রেন। কিয়েভের দাবি, তারা এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ১ হাজার ২৯৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল ও ১০০ বসতি দখলে নিয়েছে। যদিও বিবিসির পক্ষ থেকে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
কেন পোকরভস্ক গুরুত্বপূর্ণ
পোকরভস্ক শহরের পাশেই মিরনোহ্রাদ নামের আরেকটি শহর রয়েছে। যুদ্ধের আগে এই দুটি শহরে ১ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করলেও এখন বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত। ডোনেৎস্ক অঞ্চলের এই অংশের শেষ বড় শহরগুলোর মধ্যে পোকরভস্ক এবং মিরনোহ্রাদ এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে।
অ্যাভডিয়িভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর থেকে পোকরভস্কের জন্য প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ফেব্রুয়ারিতে মাসের পর মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ইউক্রেন অ্যাভডিয়িভকা শহরটি হারায়। পোকরভস্ক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার (২৫ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত অ্যাভডিয়িভকা শহরটি একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল।
অ্যাভডিয়িভকা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় পশ্চিম দিকে অবস্থিত শহরগুলো এবং সড়কগুলোকে সুরক্ষা দিয়েছিল, যা পুরো ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিল। কয়েক মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ফেব্রুয়ারিতে অ্যাভডিয়িভকা পতিত হয় এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, যা ছিল ইউক্রেনের জন্য একটি বড় ক্ষতি।
অ্যাডভিয়িকার পর পোকরভস্ক এখন রাশিয়ার নতুন আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু। এই শহরও রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে, ইউক্রেনের সামরিক অবস্থানকে আরও দুর্বল হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে পোকরভস্ক থেকে ব্যাপকভাবে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছেন।
জেনারেল সিরস্কি জানান, তিনি ফ্রন্টের সবচেয়ে কঠিন এলাকায় আমাদের সেনাদের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে এবং ব্রিগেডগুলোকে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করতে কাজ করছেন।
রাশিয়ার অগ্রগতির কারণ
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে পোকরভস্ককে তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে রেখেছে। মাসের পর মাস ধরে তারা ধীরে ধীরে শহরটির দিকে এগোচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মস্কো তাদের কেন্দ্রীয় সেনাদলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য এবং সবচেয়ে যুদ্ধপ্রস্তুত রিজার্ভ বাহিনী এই আক্রমণে মোতায়েন করেছে।
এই সপ্তাহে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের নভোহ্রোদিভকা শহরটি দখল করেছে, যা ইউক্রেনের অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে। তারা মনে করেন, শহরটির আরও ভালোভাবে প্রতিরক্ষা করা উচিত ছিল। ইউক্রেনীয় এমপি মারিয়ানা বেজুগলা ফেসবুকে লিখেছেন, "নভোহ্রোদিভকার সামনে খাতগুলো খালি ছিল। একসময়ের ২০,০০০ জনসংখ্যার এই শহরে কার্যত কোনো ইউক্রেনীয় সেনা ছিল না।"
রাশিয়ার তুলনায় সৈন্যসামন্ত কম থাকায় ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী নভোহ্রোদিভকা থেকে সরে এসে পোকরভস্কের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে— এমনটাই ধারণা করছেন অনেকে।
এছাড়াও, রাশিয়ান বাহিনী নভোহ্রোদিভকার দক্ষিণে সেলিদোভ শহর এবং অন্যান্য এলাকায় আক্রমণ শুরু করেছে। রাশিয়ার আক্রমণ কৌশলও পরিবর্তিত হয়েছে, যা অনেকটা ওয়াগনার ভাড়াটে বাহিনীর ব্যবহৃত কৌশলের মতোই।
ইউক্রেনীয় সেনারা একের পর এক রুশ বাহিনীর সম্মুখীন হচ্ছে, যাদের লক্ষ্য ইউক্রেনের অবস্থান দখল করা। অনেকেই রাশিয়ার এই কৌশলকে 'মিট এসাল্ট' বলে উল্লেখ করেছেন। এই কৌশলের ফলে নিয়মিত আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে ইউক্রেনীয় বাহিনীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
এই কৌশলটির মূল লক্ষ্য হলো শত্রুর পক্ষে যাতে প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে ওঠে। কারণ এতে শত্রুপক্ষকে একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়, যা তাদের রসদ এবং মানসিক শক্তি দ্রুত শেষ করে দিতে পারে। যদিও এই ধরনের আক্রমণ খুবই ব্যয়বহুল এবং অনেক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটায়, তবুও তা সাময়িকভাবে সফলতা এনে দিতে পারে যদি প্রতিপক্ষ ক্লান্ত বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন