প্রাণঘাতী ৫ আগস্ট: আশুলিয়ায় হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের মর্মান্তিক সত্য
রাজধানীর নিকটবর্তী বাইপাইল এলাকায় অবস্থিত আশুলিয়া থানার অভ্যন্তরে পরিস্থিতি এখনও বেশ অস্বাভাবিক। ভেতরের ফাঁকা জায়গায় আসবাবপত্রের পরিমাণ খুব কম। চেয়ারগুলো এখনও প্লাস্টিকে মোড়ানো। কর্মদিবস চালু থাকা সত্ত্বেও খুব কম কার্যক্রমই চোখে পড়ছে। দেখে মনে হতে পারে, থানাটি বুঝি সম্প্রতি এ ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
আরেকটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়, থানার ভেতরে কাজ করা মানুষের সংখ্যা খুব অল্প কম পরিমাণে মানুষ থানাটিতে কাজ করছেন। নিম্ন পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মুখে শঙ্কা ও অস্বস্তির এক অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
গত সোমবার থানাটিতে যান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-এর এ তিন প্রতিবেদক। তবে থানার অফিসারেরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে কথা বলতে রাজি ছিলেন না। ৫ আগস্ট সেখানে কী ঘটেছিল তা জানতে চাইলে তাদের চোখমুখে আশঙ্কার ছায়া ভর করে।
থানার চারপাশের জনবহুলপূর্ণ এলাকার বাসিন্দা ও দোকানদারদের মধ্যেও এ ভয় স্পষ্ট ছিল। হাসিনা সরকারের পতনের দিন প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল সে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেই সবাই যেন কেমন অস্থির হয়ে উঠছিলেন।
টিবিএসের পক্ষ থেকে একটি ভিডিওর সূত্র ধরে মূলত এলাকাটি পরিদর্শন করা হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা একটি ভ্যানে গুলিবিদ্ধ কয়েকটি মরদেহ তুলছেন। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পরপরই ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দি করা হয়। জিওলোকেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, এটি থানা ভবনের ঠিক পাশেরই একটি গলির চিত্র।
মূলত সংবাদদাতারা মৃতদের পরিচয় শনাক্ত এবং থানার সঙ্গে এ ভুক্তভোগীদের মধ্যকার যোগসূত্রের বিষয়টি উদঘাটন করতে গিয়েছিলেন। এমনকি সহিংসতার সময় থানা চত্বর কিংবা তার আশেপাশে কিছু মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আমাদের সাভার সংবাদদাতার ধারণা অনুযায়ী, শুধু সাভার-আশুলিয়াতেই গত ৫ আগস্ট ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যদি স্থানীয়রা মনে করেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
সেদিনের ঘটনার সম্পূর্ণ চিত্র বুঝতে স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষার্থী, পুলিশ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ মোট ১৮ জনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে টিবিএস।
তবে প্রথমদিকে ইতস্তত করলেও কিছু স্থানীয় মানুষ সংবাদদাতাদের কাছে ধীরে ধীরে ঘটনার ভয়ংকর বর্ণনা দিতে শুরু করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. হুমায়ূন কবির ৫ আগস্টের ঘটনার অন্যতম সাক্ষী। বন্ধু কসাই লেবু মিয়াকে উদ্ধার করার বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন তিনি।
তিনি বলেন, "৫ আগস্ট সকালটা ছিল ঝড়ের আগে থাকা শান্ত পরিস্থিতির মতো। ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না, আমাদের এলাকা থেকে অনেকেই ঢাকায় শিক্ষার্থীদের লং মার্চে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তারা বাইপাইল-আশুলিয়া সড়কে ছিলেন।"
হুমায়ূন ঘটনা বর্ণনা করার সময় লেবু মিয়ার শোকাতুর স্ত্রী পাশে নির্বিকারচিত্তে বসে ছিলেন। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। যদিও স্বামীকে এভাবে হারানোর পর সেটা খুব একটা সহজ নয়।
হুমায়ূন বলেন, "সাড়ে ১২টার দিকে আমি লেবু মিয়ার ফোন পেলাম। আশুলিয়া থানাসংলগ্ন একটি পোশাক কারখানার সামনে তিনি কিছুক্ষণ আগে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি জানান, তার পায়ে ও শরীরের নীচের অংশে গুলি লেগেছে। আমি তাকে পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলি। রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করতেও বলেছিলাম।"
সেদিন আশুলিয়া থানার পার্শ্ববর্তী অলিগলি কিংবা রাস্তা ছিল অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ তাদের বাড়ির ভেতরে ছিলেন। কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তার অভাব ছিল। পুলিশের ছোড়া গুলির গর্জনে চারদিক ছেয়ে গেছে, গুলি কখন কার জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সে আতঙ্কে ছিলেন মানুষ।
হুমায়ূন এজন্য লেবুকে বরং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। "আমরা দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বিকেল ৫টার দিকে পুলিশের চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পাই।"
হুমায়ূন বলেন, "গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়ার পর সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। পরদিন স্থানীয় একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে লেবু মিয়া ও ৬টি পোড়া লাশের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শত-শত মানুষ সেখানে যোগ দিয়েছিলেন।"
স্থানীয়রা জানায়, ৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর পুলিশের পিক-আপ ভ্যানে পোড়ানো লাশগুলো পাওয়া গেছে। লাশেরগুলোর মধ্যে ৪টি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। আর অজ্ঞাত দুজনকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
কিন্তু কীভাবে এ লাশগুলো পুড়ল?
এর উত্তর জানতে টিবিএস আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঢাকার ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। থানার অভ্যন্তরের একজন নিশ্চিত করেছেন, আতঙ্কিত অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই একটি প্যাডেল ভ্যান থেকে মৃতদেহগুলোকে পুলিশ ভ্যানে বোঝাই করে।
তাদের দাবি, উত্তেজিত জনতা প্যাডেল ভ্যানে করে মরদেহ থানায় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মরদেহগুলো কে পুড়িয়েছে এই সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
টিবিএস একজন প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ পায় যিনি সেখানকার একটি দোকানে কাজ করেন। কাছাকাছি একটি ভবনের বারান্দা থেকে তিনি ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখেছিলেন। ভিডিও রেকর্ডও করেন তিনি।
"দুপুর ২:৪০ থেকে ২:৫০-এর দিকে পুলিশ ভ্যানে আগুন লাগানো হয়েছিল। আমি নিজে সেটা দেখেছি। আতঙ্কিত অবস্থায় সমস্ত মরদেহ, সেগুলোর পরিচয়পত্র, কার্ডসহ গাড়ির পেছনের প্রান্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের গাড়িটি থানা থেকে বের হওয়ার দিকে পার্ক করা হয়েছিল। থানায় মামুন নামের এক পুলিশ সদস্য আরেকটি পুলিশের গাড়ি থেকে একটি খবরের কাগজ নিয়ে লাশ বোঝাই পুলিশ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়।" তাড়াহুড়ো করে ঘটনাটি বর্ণনা করে চলে যান ঐ তরুণ। যেতে যেতে বলেন, "আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে।"
টিবিএস আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তবে পুলিশের প্রতিশোধের ভয়ে তারা কথা বলতে রাজি হননি। কারণ, পুলিশ সদস্যরা থানায় ফিরে এসেছেন। এছাড়া 'হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতের অভিযুক্ত বেশিরভাগ পুলিশ এখনও একই থানায় কর্মরত রয়েছেন।"
টিবিএস একটি ভিডিও পেয়েছে যেটিতে দেখতে পাওয়া দৃশ্য ভ্যানটিতে আগুন দেওয়ার শুরুর সময়ের বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঐ সময় কিছু পুলিশ সদস্যকে ঘটনাস্থলের ২০ ফুটের মধ্যে দেখা গেছে। একইসাথে একজন পুলিশ সদস্যকে ভ্যান থেকে ফিরে আসতে দেখা যায় যখন ভ্যানের ভেতরে আগুন জ্বলছিল।
ঘটনাটি যে সেখানকার দৃশ্য সেটি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। মেটাডেটা থেকে আরও দেখা গেছে, এটি ৫ আগস্ট ধারণ করা হয়েছিল।
সে সময় পুলিশের দখলে থাকা ওই এলাকায় কোনো সাধারণ মানুষকে দেখা যায়নি। পুলিশকে আপাত-শান্ত অবস্থায় দেখা যায় ভিডিওতে। তবে হামলার কবলে পড়ার একটা শঙ্কাও তাদের মধ্যে ছিল বলে ভিডিও থেকে ধারণা করা যায়।
'আত্মসমর্পণের ঘোষণা' এবং এরপরেও গুলি
জুলাইয়ের মাঝামাঝি আন্দোলনে যোগ দেওয়া দশম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে টিবিএস কথা বলে। তার বাবাও পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হয়েছিলেন। তিনি টিবিএসকে জানান, দিনটা বেশ ভয়ঙ্কর ছিল। ৪ আগস্ট পর্যন্ত রাস্তায় নামলেও পরদিন সকাল থেকে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ থাকায় তাকে বাসা থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, "কিন্তু আমার বাড়ি থানা ভবনসংলগ্ন হওয়ায় থানার সামনে সেদিন কী ঘটেছিল তা আমরা নিবিড়ভাবে দেখতে পেরেছিলাম। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এমন খবর আসার পরও পুলিশের বুলেটে মানুষ নিহত হয়েছিল। থানার মূল ফটক থেকে ৫০ ফুট দূরে বালির বস্তা দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী চৌকি ছিল। বালির বস্তার পাশে কয়েক ফুট দূরে পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছিল।"
ছেলেটি আরও বলেন, "আপনি পাশের দেয়ালে এমনকি কাছাকাছি দোকানের মেঝেতেও বুলেটের চিহ্ন খুঁজে পাবেন।"
সেদিন স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, পুলিশ জনগণের সাথে রয়েছে এবং তারা আত্মসমর্পণ করেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এর পরেও গুলিবর্ষণ চালু ছিল। মাইকের ঘোষণা শুনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন।
কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি কথা বলতে রাজি ছিলেন না। তবে পুলিশ সূত্র জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে স্থানীয় মসজিদ থেকে পুলিশ স্টেশনে হামলা না করার জন্য জনতার কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বাইপাইল মসজিদের পাশে একটি দোকানের মালিক খালেদ হোসেন জানিয়েছেন, তিনি এমন ঘোষণা শুনেছিলেন।
মসজিদের মাইক থেকে বলা হয়, "পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে চায়। আপনারা (জনগণ) যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। দয়া করে আমাদের আক্রমণ করবেন না।"
"কিন্তু তারপরেও আমরা গুলির শব্দ শুনেছি। আমি থানার কাছে আমার বাড়িতে ছিলাম", আরও বলেন খালেদ।
টিবিএস থানার সামনে থেকে পুলিশের গুলি ছোড়ার বেশ কয়েকটি ভিডিও পেয়েছে৷ একটি ভিডিও ও বেশ কয়েকটি ছবিতে একজন যুবককে বালির ব্যাগের পাশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যা থেকে ধারণা করা যায়, তাকে কয়েক মিনিট আগে গুলি করা হয়েছিল।
আরেক ব্যক্তিকে একটি ভবনের দেয়ালের সাথে ঢলে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার পা মাটিতে ছড়ানো ছিল; আহত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেঁচে ছিলেন বলে মনে হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হেলমেট ও আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় আহত ব্যক্তিদের পাশে অবস্থান করছেন।
টিবিএস-কে ভিডিওগুলো সরবরাহকারী এক স্থানীয় যুবকের মতে, "পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালিয়েছিল। ছবি ও ভিডিও থেকে সেটা স্পষ্ট।"
সহিংসতা এড়ানো সম্ভব ছিল?
পশ্চিম বাইপাইল এলাকার নারীসহ অন্তত ১০ জন স্থানীয় বাসিন্দা টিবিএসকে জানান, ছাত্র-জনতা যখন প্রধান সড়কে বিজয় মিছিল করছিল তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম সকাল থেকে গুলি ও স্থানীয় অস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারীদের দমন করার চেষ্টা করেন।
৫৫ বছর বয়সী রওশন আলী ৫ আগস্ট গণহত্যার জন্য সাইফুল ইসলামের উপর স্পষ্টভাবে সমস্ত দায় চাপনা।
তিনি বলেন, "স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুল চেয়ারম্যান (তিনি পূর্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন) এবং তার লোকজন হাসিনার পদত্যাগের খবরের পরও ৪ ও ৫ আগস্ট মানুষকে গুলি না করলে এই এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতো না। ৫ আগস্ট তারা ও পুলিশ জনতাকে গুলি করে। এর ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা সাইফুল এমপির মালিকানাধীন পাশের একটি মার্কেটে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।"
পরে এমপির খোঁজে লোকজন তার বাড়িতে তাণ্ডব চালালেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। রওশন আলী বলেন, "তিনি থানার ভেতরে লুকিয়ে আছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে।"
সংসদ সদস্য আসলে যা করেছেন
অভিযোগ রয়েছে যে, আন্দোলনকারীদের আক্রমণ ও উত্তেজিত করে ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার মতো পরিস্থিতি তৈরিতে পুলিশের পাশাপাশি সমান ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকা-১৯ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও তার দল।
বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় বাসিন্দা, বিক্ষোভকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৪ ও ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় বিক্ষোভকারীদের ওপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের সশস্ত্র হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাইফুল।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুলের নেতৃত্বে হামলায় অনেক লোক গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের মরদেহ নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বিভিন্ন স্থানে পড়ে ছিল।
বাইপাইলের বসুন্ধরা এলাকার বাসিন্দা আনারুল ইসলাম জীবন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তিনি দিনটির কথা স্মরণ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কাছে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন
সাইফুল শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী নিয়ে সকাল ১০টার পর পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা থেকে শুরু করে বাইপাইলে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান।
আনারুল বলেন, "আমি দুপুর ১টার পর সেখানে ছিলাম এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে দেখেছি। মিনিটে মিনিটে মানুষ একের পর এক রাস্তায় ঢলে পড়েছে।"
আনারুল আরও বলেন, "আমি এত লোককে গুলি করতে দেখেছি যে কখন আমার ভাইকে গুলি করা হয়েছে তা খেয়ালও করতে পারিনি। যদিও আমি তার পাশে ছিলাম। তখন একে একে মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ছিল। অন্যরা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এমনকি আশেপাশের ভবনের ছাদ থেকেও গুলি চালানো হয়েছে। পরে খবর পাই আমার ভাই মারা গেছে।"
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে তার ভাই সেলুন কর্মী জাহিদুল ইসলাম সাগরকে হত্যার ঘটনায় আদালতে মামলা করেছেন আনারুল।
শুধু আনারুল নয়, ৫ আগস্টের ঘটনার বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ এবং প্রত্যক্ষদর্শীও সাইফুল ও তার বাহিনীর ভয়াবহ বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, ৪ আগস্ট ও বিশেষ করে ৫ আগস্ট সকাল ১০টার পর সাইফুল ইসলাম ও তার অনুসারীদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বিক্ষুব্ধ জনতা সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল।
স্থানীয়রা ও পুলিশ সূত্র জানায়, এর ফলে আশুলিয়া থানায় ভয়াবহ হামলা, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একইসাথে থানার কাছে ওভারব্রিজ থেকে দুই পুলিশ সদস্যের মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং পুলিশের আরেকটি মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
৫ আগস্ট আশুলিয়া থানায় দায়িত্বরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও সাইফুলের খুনি উন্মাদের মতো আচরণের কথা স্বীকার করেছেন।
সরকার পতনের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অন্তত বেলা ৩টা পর্যন্ত তারা বাইপাইল ও আশুলিয়া থানার সামনে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক ও এর আশপাশের পয়েন্টে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই নৃশংসতায় সাইফুল ও তার লোকজনকে সহযোগিতা করার অভিযোগে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে অভিযুক্ত করেছে।
শেষ মুহূর্তে পুলিশ সাইফুলকে থানায় আশ্রয় দিয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যার ফলে আশুলিয়া থানায় হামলা চালানো হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ওই দিন বেশ কয়েকজন ডিবি সদস্যকে আশুলিয়া থানায় পাঠানো হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "অতিরিক্ত এসপি মোবাশ্বিরা জাহান এবং অতিরিক্ত এসপি আবদুল্লাহিল কাফী আশুলিয়া থানায় কাজ করার জন্য আমাদের সেখানে (আশুলিয়া) যেতে বলেছিলেন। ৪ আগস্ট আদেশের পরেও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ায় আমরা কেউ কেউ সেখানে যেতে চাইনি। কিন্তু আমাদের হাতে অন্য কোনো উপায় ছিল না।"
ঐ কর্মকর্তা আরও দাবি করেন, ৪ ও ৫ তারিখে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা জনগণকে লক্ষ্য করে গুলি না করলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করত না।
তিনি বলেন, "আমরা (ডিবি সদস্যরা) আশুলিয়া থানায় অবস্থান করছিলাম। আমরা কয়েকজন থানার ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু স্টেশনের ভেতরে থাকাটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ বিক্ষুব্ধ জনতা যেকোনো সময় আমাদের ওপর হামলা করতে পারত। এছাড়াও খবরও ছড়িয়ে পড়ে, এমপি সাইফুল ইসলামও থানায় লুকিয়ে আছেন। সেদিন আমরা অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাই। আমি ও অধিকাংশ পুলিশ সদস্য পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষ কথা হতে পারে এমনটা মনে করে তাদের বিদায় জানাই। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী আসে। আমরা ফাঁকা গুলি করি এবং তারপর সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করি। তবে পরিস্থিতি একদম সহজ ছিল না। সেনাবাহিনী তাদের এপিসি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা সেগুলোর ওপরেই চড়ে বসে।"
এ ডিবি কর্মকর্তা ওই সময় থানার ভেতরে থাকার দাবি করলেও কারা পুলিশ ভ্যানে আগুন দিয়েছে ও লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে সে প্রশ্ন করলে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
কিন্তু বেশ কয়েকটি পুলিশ সূত্রের মতে, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় লোকজন ঐ জায়গাটিতে প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ পুলিশ সদস্যরা তখনও গুলি চালাচ্ছিলেন এবং সাধারণ মানুষের পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ এতে গুলির আঘাতে নিহত হওয়ার বেশ জোরালো সম্ভাবনা ছিল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টার খবরে ২ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে কাফীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার রবিউল ইসলাম জানান, ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় মানুষ হত্যা ও পুড়িয়ে মারার সঙ্গে কাফীর সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
ডিবির একটি সূত্র অবশ্য টিবিএসকে জানিয়েছে, আবদুল্লাহিল কাফীর বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। "তাকে এখনও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি। যার কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।"
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সারাদেশে সহিংসতা শুরু হলে ঐ ৫ আগস্ট ছাত্র বিক্ষোভ দমনে কাফী পুলিশ সদস্যদের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সূত্র অনুসারে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছেলে কাফীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। সূত্র জানায়, "আমরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি সরকারী সফরে বিদেশেও গিয়েছিলাম। সেখানে মন্ত্রী ও তার ছেলের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাফীর শত শত ছবি ছিল।"
এই সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে মোবাশ্বিরা জাহান জানান, ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ডিবি টিম ডিউটিতে ছিল। তিনি বলেন, "কাফী বা আমি কেউই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। আমরা কেবল বাহিনী মোতায়েন করতে পারি। কিন্তু মাঠে যা ঘটেছিল তার দায় তো আমাদের না।"
এদিকে পুলিশ স্টেশনটির কার্যক্রম এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। ভয়াবহ সেই আক্রমণের ক্ষত সারিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার চেষ্টা করেছে মাত্র। এই থানাকে ঘিরে এখনো স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।
অনেকেই বলছেন, তারা জানেন না মারাত্মক সব দিনের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে তাদের আরও কতদিন লাগবে। কেননা গা শিউরে ওঠার মতো একের পর এক ঘটনার তথ্য ক্রমশ জনসমক্ষে উঠে আসছে।
এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে যে, সাভার-আশুলিয়ায় সহিংসতায় অন্তত ৫৭ জন নিহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।