শেভরনের গ্যাস নগদে কেনার সিদ্ধান্ত
মার্কিন কোম্পানি শেভরন থেকে গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে নতুন সরবরাহ করা গ্যাসের দাম নিয়মিত পরিশোধ করার পাশাপাশি ২২৫ মিলিয়ন ডলার বকেয়াও ধাপে ধাপে পরিশোধ করার পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মাধ্যমে আগামী এক বছরের মধ্যে কোম্পানিটির পুরো বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
বর্তমানে শেভরন সরকারকে প্রতি মাসে গড়ে ৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস সরবরাহ করে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, প্রতি মাসে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য বাবদ ৪০ মিলিয়ন ডলারের সঙ্গে বকেয়ার অংশ থেকে ১০-১৫ মিলিয়ন ডলার করে শেভরনকে দেওয়া হবে।
'এভাবে সর্বোচ্চ আগামী এক বছরের মধ্যে শেভরনের সমস্ত বকেয়া পরিশোধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে,' বলেন তিনি।
শেভরন মৌলভীবাজারের বিবিয়ানা ও সিলেটের জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন করে সরকারকে সরবরাহ করে। এর মধ্যে বিবিয়ানা থেকেই সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ করে কোম্পানিটি। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৪৫ শতাংশ শতাংশ আসে শেভরনের সরবরাহ করা গ্যাস থেকে।
দেশের ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির মতো শেভরনও পাওনা আদায়ে সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে।
শেভরনের একটি প্রতিনিধিদল অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাদের বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। গত মাসে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়ার পরিমাণ খুব বেশি না কমলেও জ্বালানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ খাতের বকেয়া বিল পরিশোধ করছে সরকার।
জ্বালানি খাতে বকেয়া ১.৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল
সূত্রমতে, আগস্টের শুরুতে জ্বালানি খাতে বকেয়ার পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। ওই সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোও ডলার সংকটে পড়ে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে বকেয়া পরিশোধ না করায় গত ২ ও ৯ সেপ্টেম্বর এলএনজির দুটি কার্গো পণ্য খালাস না করে ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে ওই কার্গো দুটি খালাসের ব্যবস্থা করে জ্বালানি বিভাগ।
তারপর থেকে তেল-গ্যাসের মতো স্ট্র্যাটেজিক পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি খাতে বকেয়া বিলের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে তেল আমদানির বকেয়া ২৭০ মিলিয়ন ডলার, এলএনজি আমদানির বকেয়া প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ও শেভরনের বকেয়া ২২৫ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ আমদানিতে ১.১ বিলিয়ন ডলারের বিল বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপের পাওনা ৫০০ মিলিয়ন ডলার। আর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পাওনা ৫৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ত্রিপুরা সরকারের পাওনা ১০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য বলছে, ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে বাংলাদেশকে।
পাওনা আদায়ের জন্য চাপ দিচ্ছে ভারতের আদানি গ্রুপ
আদানি গ্রুপ ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বকেয়া পাওনা পরিশোধে তাগাদা দিয়েছে বলে ভারতের সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। এর আগেও আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে বকেয়া পাওনা পরিশোধের তাগাদা দিয়েছেন। পাশাপাশি পাওনা পরিশোধ করা না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলেও সতর্ক করেন তারা।
আদানির ঝাড়খন্ড বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারত সরকার কিনতে পারবে বলে গত আগস্টেই আইন করেছে দেশটি। সম্ভবত পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরির জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিপিডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। যদিও এই কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট।
এছাড়া ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশকে অনেকদিন ধরে ৬০ থেকে সর্বোচ্চ 100 মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। যদিও ত্রিপুরার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা।
আর ভারত সরকারের জাতীয় গ্রিড থেকে বাংলাদেশকে ভেড়ামারা এইচভিডিসি ইন্টারকানেক্টরের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও অনেকদিন ধরেই ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে বিপিডিবির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
অন্যদিকে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ অর্থ বিভাগের কাছে বকেয়া পাওনার পরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব গ্রহণের পর জানিয়েছেন, এ দুই খাতে আমদানির প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার বকেয়া আছে। এই বকেয়া বিল পরিশোধ করতে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ২ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে সরকার।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক সরকার বন্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি পরিশোধের পরও বর্তমানে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভর্তূকি বাবদ ৪২ হাজার কোটি টাকার বকেয়া সৃষ্টি হয়েছে।
বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কোনো কোনোটির মালিক পাওনা পরিশোধ করা না হলে কেন্দ্র চালু রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বন্ড ছেড়ে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ না করতে সরকারকে শর্ত দিয়েছে।
আরও ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ
জ্বালানি বিভাগের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি খাতের বৈদেশিক সরবরাহকারীদের বকেয়া পরিশোধের জন্য ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনকে (আইটিএফসি) অনুমোদিত ঋণ থেকে আরও ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করা আছে। এরমধ্যে ১.৬ বিলিয়ন ডলার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য, আর বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার এলএনজি আমদানির জন্য। আইটিএফসি থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার পর জ্বালানি তেল ও এলএনজি সরবরাহকারীদের বকেয়া পাওনা দেওয়া হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আগামীতে একাধিক সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমেও ঋণপত্র (এলসি) খোলা হবে।
এতদিন শুধু সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলা হতো। সোনালী ব্যাংক ডলার দিতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে এলসির পাওনা পরিশোধ করা হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ বন্ধ করায় জনতা, অগ্রণী, রূপালীর পাশাপাশি প্রাইম ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার বিষয়ে আলোচনা চলছে।