জাতীয় পার্টিতে কাদের-রওশন দ্বন্দ্ব: দলের ভবিষ্যৎ কোথায়?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের পদ ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদকে কেন্দ্র করে দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ছোটভাই জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার সকালে গুলশানে রওশন এরশাদের বাসায় জাতীয় পার্টির একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম ঘোষণা করেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদের ছোটভাই ও রওশনের দেবর জি এম কাদের হুমকি দিয়েছেন, যারা দলের কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে 'ব্যবস্থা নেওয়া হবে'।
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে দেবর-ভাবীর এই দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। তবে এরশাদ জীবিত থাকাকালীন সময়ে তিনি সবকিছু সামলে রাখায় এই দ্বন্দ্ব ততোটা সামনে আসেনি। এখন এরশাদ মারা যাওয়ার দুই মাস না পেরোতেই পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এলো। স্পষ্ট হয়েছে এই দুই নেতাকে কেন্দ্র করে দলের দুটি বলয়।
ঘটনায় সূত্রপাত হয় গত মঙ্গলবার। সেদিন (৩ আগস্ট) জি এম কাদের নিজেকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেন। এর একদিন পর গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদের নামে স্পিকারের কাছে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় যাতে বলা হয়, জি এম কাদেরের ওই চিঠি যেনো গ্রহণ না করা হয়।
চিঠি পাঠানোর ব্যাখ্যায় জিএম কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভাই এরশাদ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনিও সেভাবেই নিয়েছেন।
"বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন প্রশ্নে জোর করে কিছু করা হয়নি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চিঠি দেওয়া হয়েছে।"
তবে একইদিন রওশন এরশাদের বাড়িতে বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির কোনো বৈঠক ছাড়া স্পিকারকে দেওয়া জি এম কাদেরের চিঠিটির 'কোনো দাম নেই' তাদের কাছে।
তিনি বলেন, "জি এম কাদের পার্লামেন্টারি কমিটির কোনো বৈঠক না করেই লুকিয়ে এই চিঠি দিয়ে থাকলেও আমি ও আমরা সে বিষয়ে কিছু জানি না। আমি তো এক নগণ্য এমপি। আমাকে তো কোনো নোটিস বা ফোন দেওয়া হয়নি। যে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে শুনছি, সেটি প্রপার না।"
চুন্নুর এই অভিযোগের জবাবে কাদের বলেছিলেন, "আমরা ফোনে সংসদ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা সম্মতি দিয়েছে। লিখিত দিতে বলা হলে ১৫ জন সম্মতিপত্র দিয়েছে। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সম্মতি দিলে আর কিছু লাগে না। তাই অন্যদেরকে বলা হয়নি। এখন আরও অনেকে দিতে চাচ্ছে। প্রয়োজন নেই বলে নেওয়া হচ্ছে না।"
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসুস্থ্য থাকা অবস্থায় গত এপ্রিলে তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন তিনি।
১৪ই জুলাই এরশাদ মারা যাওয়ার চারদিন পর ১৮ জুলাই বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন।
তবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না দলের কো-চেয়ারম্যান ও এরশাদের স্ত্রী রওশন। রওশন অভিযোগ করেছিলেন, কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার আগে তার সাথে কোনও আলোচনা করা হয়নি। আর জাতীয় পার্টির 'ঘরোয়া বিবাদ' দেবর-ভাবীই মিটিয়ে ফেলবেন বলে আশাপ্রকাশ করেছিলেন কাদের।
তবে সেই আশায় গুড়েবালি দিয়ে বৃহস্পতিবার পার্টির একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকালে রওশন এরশাদের বাসায় এই সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঘোষণা দেন, "রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করব।"
তিনি জানান, এরশাদের ভাই জি এম কাদেরকে 'সম্মান দিয়ে' দলের কো-চেয়ারম্যানের পদটি দেবেন রওশন।
এরপরই দলের বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে যারা চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন, দলের 'গঠনতন্ত্র অনুযায়ী' তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন কাদের।
কি আছে দলটির ভবিষ্যতে?
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসনের পর ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরশাদ।
এরমধ্যেই জেনারেল এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগ নেন যার পরিক্রমায় ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তবে সে নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ১৯৮৭ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ ফের নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান সব বিরোধী দলই এ নির্বাচন বর্জন করে।
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর এরশাদের পতন হলে গ্রেপ্তার হন তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। এরমধ্যেই ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৫ টি আসন পায় দলটি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩২টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে এসে নেতৃত্বের কোন্দলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়। দলটি তখন এরশাদ গ্রুপ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গ্রুপ ও নাজিউর রহমান মঞ্জু গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়।
২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোট গঠন করে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জোট গঠন নিয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম দিলেও শেষ পর্যন্ত টানা তিনবারের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন।
নানা সংকট পেরিয়ে আসা দল জাতীয় পার্টি এরশাদের মৃত্যুর পর আরও সংকটে পড়বে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফজলুল হালিম রানা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "রাজনৈতিক দল হিসবে জাতীয় পার্টি এমনই একটি দল যার শুরু থেকেই এই ভাঙন, চড়াই-উৎরাই আছে এবং সেটার মধ্য দিয়েই এই দলটা চলছে। জাতীয় পার্টির প্রাণ ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।"
রাজনৈতিক এই বিশ্লেষকের মতে, সাধারণ মানুষের মাঝে দলটির যে 'রাজনৈতিক আবেদন' এখনো আছে, তা শীঘ্রই হারিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, "জাতীয় পার্টি এখন কয়েক খন্ডে বিভক্ত হবে। জাতীয় পার্টির যে পলিটিক্যাল গ্ল্যামার, জনগণের মাঝে দলটির যে আবেদন ছিলো সেটা আর থাকবে না। এটাই এই পার্টির নিয়তি।"