অকালবোধন থেকে বিজয়া: দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক প্রতিফলন
সকলকে প্রথমেই জানাই বিজয়া দশমীর প্রীতি ও শুভেচ্ছা। বাঙালি হিন্দুদের পুরাণকালের পর থেকে ধর্মীয় উৎসব দিক থেকে প্রাধান্য পেয়ে আসছে দেবী দুর্গার বন্দনা। দর্পণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দেবী দুর্গার পুজো অর্চনা। একাধিক পুরাণ ও লোককথা প্রচলিত রয়েছে দেবী বন্দনা নিয়ে। বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন অর্থাৎ দেবতা'কে জাগ্রত করতে হয়।
একাধিক পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, রাবণ বধের পূর্বে রাম বিল্ববৃক্ষতলে দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। শরৎকাল দেবপূজার উপযুক্ত সময় নয় বলে রাম কৃত দেবী পার্বতীর যে বোধনটি হয় তা 'অকালবোধন' নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, শাস্ত্রমতে বসন্তকাল দুর্গাপূজার উৎকৃষ্ট সময় হলেও, আধুনিক যুগে শারদীয়া-ই অধিকতর প্রচলিত।
বসন্ত কালের চৈত্র মাসে দেবী পার্বতী কে পুজো করে সন্তুষ্ট করলে দেবী রাবণকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু যদি দেবীর পূজা মন্ত্রে 'শ্রী শ্রী চন্ডিতে' কোনো রকমের ত্রুটি থাকে তবে দেবী রাবণকে ত্যাগ করবেন। ফলত রামের সকল অস্ত্র রাবণের ওপর বিফল হয়ে যায়।
ব্রহ্মা রামচন্দ্রকে দেবী পার্বতীর পুজো করতে আদেশ দেন। কারণ দেবী এই সময় মর্ত্যে তাঁর মাতা পিতার গৃহে গমন করেন। রাম দেবী পার্বতীর পুজো করলে দেবী কর্তৃক তাঁর উদ্দেশ্যে আনা একটি পদ্ম তিনি হরণ করেন। তখন রামচন্দ্র নিজ চক্ষু দেবী কে দান করতে চাইলে দেবী পার্বতী তাঁকে বিরত করেন ও বর দেন।
"তারপর হনুমান দশমী তিথিতে রাবণ কল্যাণে শ্রী চন্ডী পাঠ রত বৃহস্পতি কে অজ্ঞান করে শ্রী চন্ডী অশুদ্ধ করলে রাবণ কে ত্যাগ করেন দেবী। রাবণ দেখে দেবী তাকে ত্যাগ করে কৈলাসে চলে যাচ্ছেন রাবণের শত মিনতি সত্ত্বেও দেবী পার্বতী আর ফিরে তাকালেন না। তারপর রামচন্দ্র রাবণ বধ করেন।"
বর্তমান যুগে দেবীর অকাল বোধন রূপটির পূজা করা হয়ে থাকে।
দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব,তবে আমাদের আলোপাত থাকে শেষ পাঁচ দিনে। আশ্বিনের পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের পূজা বাসন্তিক বা বসন্তকালীন দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন 'দুর্গাষষ্ঠী', 'দুর্গাসপ্তমী', 'মহাষ্টমী', 'মহানবমী' ও 'বিজয়াদশমী' নামে পরিচিত।
আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় 'দেবীপক্ষ'। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। বিশ্বাসীগণ তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা, এই দিন দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়।
কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, "অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী উগ্রচণ্ডা তথা দশভুজার বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, ষোড়শভুজা ভগবতী ভদ্রকালীর বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এবং চতুর্ভুজা ও দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহের বোধন করা হবে যথাক্রমে শুক্ল প্রতিপদে এবং শুক্লা ষষ্ঠীতে।"
মহাকাল সংহিতার দিকে তাকালে দেখতে পাই, "প্রতিমাভেদে উগ্রচণ্ডার কৃষ্ণনবম্যাদিকল্পে, ভদ্রকালীর প্রতিপদাদি কল্পে ও কাত্যায়নী দুর্গার ষষ্ঠ্যাদি কল্পে পূজার অনুষ্ঠান বিধেয়।" বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো আলাপ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে যে, ভগবান কৃষ্ণই প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন। সৃষ্টির আদি যুগে, কৃষ্ণ স্বয়ং বৈকুণ্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর, মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের আতঙ্কে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। শিব ত্রিপুর নামের এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে বিপদে পড়লে তৃতীয়বারের মতো দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মী হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজা করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। তারপর থেকে মুনি-ঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা এবং সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজা পালন করে আসছেন।
দেবীভাগবত পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে, ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মাটির মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করেন। সেই সময় মনু 'বাগ্ভব' বীজমন্ত্র জপ করতে করতে একশ বছরের কঠোর তপস্যা করেন। তিনি আহার ও শ্বাসগ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে কঠোর সাধনা শুরু করেন। এই তপস্যার ফলে, মনু ক্রোধ ও কাম জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানামের ধ্যান করতে করতে গভীর সমাধিতে লীন হন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা মনুর সামনে আবির্ভূত হন এবং তাঁকে বর প্রদান করেন। মনু তখন দেবতাদের জন্য দুর্লভ এক বর প্রার্থনা করেন। দেবী দুর্গা তাঁর সেই প্রার্থনা পূরণ করেন এবং মনুর রাজ্যশাসনের পথ সুগম করেন। সঙ্গে তাঁকে পুত্রলাভের বরও প্রদান করেন।
দুর্গা এবং দুর্গাপূজার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম গ্রন্থে। এটি মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি অংশ, যেখানে তেরোটি অধ্যায়ে সাতশো শ্লোক রয়েছে। এই গ্রন্থে তিনটি ভিন্ন কাহিনি এবং দুর্গাপূজার প্রচলনের একটি কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি গল্পেই দুর্গা প্রধান চরিত্র। শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
প্রতিমার মধ্যে থাকা সকল নন্দন, রং, বেরং, কিংবা প্রতিমার প্রতিমা হয়ে ওঠার দিকটিকে আরও অর্থবহ করে তোলে। বিজয়া দশমী যেন আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে যায় জীবনের চক্র।
প্রথমত, রূপ রস গন্ধ দিয়ে পরমা প্রকৃতির ছাপ নিয়ে গড়ে ওঠা মৃন্ময়ী প্রতিমা তে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে পূজোর পরে বিসর্জন করা হয় এটা অনেকটা প্রতীকী। এটা বোঝায় পৃথিবীর কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, দেবী দুর্গার সাথে সাথে অসুরেরও বিসর্জন ঘটে।
এই অসুর আমাদের মনের অন্ধকারের প্রতীক। আলো আর আঁধারের মিশেলেই আমাদের জীবন, প্রকৃতি এবং পরকাল। তাই একসাথে দেবী এবং অসুরের বিসর্জন হয়। মৃন্ময়ী প্রতিমাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মানে শুধু এই না যে, ওই প্রতিমাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হলো। এর মানে এটাও যে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ।
আমাদের বর্তমান সমাজে, দর্পণ বিসর্জনেই আমরা সকলে ক্ষান্ত। দেবী দুর্গা কেমন যেন একটি ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির প্রতীক, এই ট্র্যাজেডির ইতি টানা এখনো সম্ভব নয়, কারণ হাজারো অসুর জীবিত। কাজেই বর্তমানে শুধু দুর্গাদের বিসর্জন ঘটে (মৌমিতা, তনু)। অসুররা দিব্বি ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে দেবতার বেশে। প্রতিটি নারী আমাদের দুর্গা, আমাদের শক্তি, চালিকা। নারী শক্তির উদযাপনই দেবী দুর্গার বন্দনা।
"মাগো চিন্ময়ী রূপ ধ'রে আয়"।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।