ভেপ ও খোলা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করে আসতে পারে নতুন আইন
ই-সিগারেট বা ভেপ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি খোলা সিগারেট, বিড়ি ও জর্দা বিক্রি নিষিদ্ধ করে নতুন অধ্যাদেশ আসছে। এ অধ্যাদেশের আওতায় লাইসেন্স ছাড়া কোনো দোকানদার সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য বিক্রি করলে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
এসব বিধান রেখে 'ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪' বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। জানা গেছে, অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদের মিটিংয়ের এজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে।
খসড়া অধ্যাদেশটির একটি অনুলিপি দেখেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স গ্রহণ ছাড়া তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না।
লাইসেন্স ছাড়া সিগারেট বা তামাকজাত পণ্য বিক্রি করলে প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে, এবং একই অপরাধ বারবার করলে শাস্তির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হবে।
এছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশু পার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি করা যাবে না। এ ধারা লঙ্ঘন করলে প্রথমবার ৫০০০ টাকা জরিমানা করা হবে।
এছাড়া কোনো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ফেরি করে সিগারেট ও জর্দাসহ তামাকজাত পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না।
তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে কোনো মিষ্টিজাত দ্রব্য (যেমন মিষ্টি জর্দা), মশলা, সুগন্ধি বা রং ব্যবহার করা যাবে না। এ ধারা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্য ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
কোনো ব্যক্তি কুম্ভিপাতা, টেন্ডু পাতা বা অন্য কোনো গাছের পাতা দিয়ে মোড়ানো বিড়ি উৎপাদন, আমদানি, মজুদ, বিপণন, বিতরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন না। এ ধারা লঙ্ঘন করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা হবে।
কোনো কোম্পানি এ ধারা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল, আর্থিক লেনদেন স্থগিত বা জব্দসহ আর্থিক জরিমানা করা যাবে।
অনেক দেশেই খোলা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ হয়েছে। বিশ্লেষকেরা জানান, প্যাকেট কিনতে বেশি টাকার প্রয়োজন হওয়ায় নতুন করে তরুণ ও শিক্ষার্থীরা ধূমপানে আসক্ত হতে পারে না।
২০০৫ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়, যা ২০১৩ সালে এক দফা সংশোধন করা হয়।
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালে আইনটি আরও কঠোর করার জন্য সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই বছরের জুন মাসে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের জন্য সংশোধিত খসড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, যা এখন খসড়া অধ্যাদেশ আকারে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হচ্ছে।
ই-সিগারেটে জরিমানা হতে পারে ৫ হাজার টাকা
খসড়া অধ্যাদেশটিতে ভেপ বা ই-সিগারেট বিক্রেতা এবং ব্যবহারকারীদের জন্য নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব রয়েছে।
ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব তুলে ধরে খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, তার যন্ত্রাংশ বা অংশবিশেষ (ই-সিগারেট, ভেপ, ভেপিং, ভেপার ইত্যাদি), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস, হিট নট বার্ন, এবং ওরাল নিকোটিন পাউচ—যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করতে পারবেন না বা করাবেন না।'
একই সঙ্গে কোনো ব্যক্তি এসব ব্যবহারও করতে পারবেন না। তবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নিকোটিন থেরাপির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
এ ধারা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
খসড়া সংশোধনীতে আর কী আছে?
বর্তমান আইনে চারপাশে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্টে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ রয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশে যেকোনো ধরণের রেস্টুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউজ, চায়ের দোকান ও প্রাঙ্গণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে যান্ত্রিক যানবাহনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খসড়া আইনে অযান্ত্রিক যানবাহনও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে রিকশা ও ভ্যানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না
বর্তমান আইনে কোনো পাবলিক প্লেসে ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করলে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশে এ জরিমানা বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কোনো ব্যক্তি পুরো প্যাকেট বা কৌটা ছাড়া খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে ৫০০০ টাকা জরিমানা হবে। কোনো কোম্পানি এ ধারা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা হবে। বারবার একই অপরাধ করলে শাস্তির পরিমাণ ধীরে ধীরে দ্বিগুণ হবে।
বর্তমানে সিনেমা বা নাটকে ধূমপানের দৃশ্য থাকলে তাতে সতর্কতামূলক বার্তা 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' লেখা থাকে। খসড়া অধ্যাদেশ পাস হলে কোনো সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ও ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করা যাবে না।
ক্রেতার কাছে বিক্রির সময় ছাড়া বিক্রয়স্থলে সকল ধরণের তামাকপণ্য বা তার প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হবে।
এ ধারা লঙ্ঘন করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। বিদ্যমান আইনে এ জরিমানার পরিমাণ এক লাখ টাকা।
'আইন পাস হলে কমতে পারে মৃত্যুহার'
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর মতে, এ আইন পাস হলে তামাকের কারণে মৃত্যুহার কমবে। তাদের বিশ্বাস, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, তা অক্ষতভাবে পাস হলে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হবে।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা'র নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের টিবিএসকে বলেন, 'তামাকের কারণে প্রতি বছর ১.৬১ লাখ মানুষ মারা যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত সংশোধনী অক্ষতভাবে পাস হলে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে। এজন্য আমরা চাই, এ অধ্যাদেশটি পাস হোক।'
অন্যদিকে, তামাক কোম্পানিগুলো এ খসড়া অধ্যাদেশের বিরোধিতা করছে।
রোববার থেকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ এবং জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে।
গত ২১ অক্টোবর, বিএটি বাংলাদেশ এর কোম্পানি সেক্রেটারি এবং লিগাল কাউন্সেল সৈয়দ আফজাল হোসেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এ সংশোধনীতে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়নি।
সরকার আইন প্রণয়নে সফল হলেও, আইনের প্রয়োগে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে বলে চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়।
বিএটি বাংলাদেশ প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোকে 'অবাস্তব' বলে উল্লেখ করেছে। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সংশোধনী বিবেচনায় না নিয়ে, অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে নতুনভাবে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করেছে।