রাশিয়ায় তিনি বড় তারকা; দিয়েছেন ভারতের প্রথম ১০০ কোটি রুপি আয় করা সিনেমা
দেড় যুগ আগেও বলিউডের কোনো সিনেমার আয় ১০০ কোটি রুপির ঘরে প্রবেশ করা ছিল বিশাল অর্জন। কোনো ছবির এ ক্লাবে প্রবেশ করার অর্থ একটাই—সিনেমাটি সবার প্রত্যাশা ছাড়িয়ে বিপুল আয় করেছে। 'গজিনি', 'ওম শান্তি ওম', 'থ্রি ইডিয়টস'-এর মতো ব্লকবাস্টার সিনেমার হাত ধরে ১০০ কোটি ক্লাবের ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়। ছবিগুলো ভারতের বাজারে এই মাইলফলক অতিক্রম করে।
তবে এ মাইলফলক আদতে ১৯৮০-র দশকেই প্রথম অর্জন হয়ে যায়। আর মাইলফলকটি স্পর্শ করেন এমন একজন অভিনেতা যিনি অমিতাভ বচ্চন বা ঋষি কাপুরের মতো প্রচলিত সুপারস্টারদের ধাঁচের তারকা ছিলেন না।
এই মাইলফলকটি প্রথম স্পর্শ করেছিলেন 'ডিস্কো ড্যান্সার' নামে খ্যাত মিঠুন চক্রবর্তী ।
বাবর সুভাষ পরিচালিত মিউজিক্যাল ড্রামা ঘরানার ছবি 'ডিস্কো ড্যান্সার' ভারতের প্রথম ছবি হিসেবে বিশ্বজুড়ে ১০০ কোটি রুপি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
তবে ভারতের তুলনায় বিদেশে বেশি আয় করেছিল 'ডিস্কো ড্যান্সার'। তাই ছবিটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০০ কোটির ক্লাবে জায়গা দেওয়া হয়নি।
ভারতে ছবিটির আয় হয়েছিল ৬.৪ কোটি রুপি। সেই সময়ের হিসাবে এই আয় ছিল বিশাল।
ভারতে মুক্তি পাওয়ার দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে রাশিয়ায় (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) মুক্তি পায় 'ডিস্কো ড্যান্সার'। মুক্তির পরপরই ছবিটি ওই দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। রাশিয়ায় ছবিটির ১২ কোটিরও বেশি টিকিট বিক্রি হয়। এর মাধ্যমে 'ডিস্কো ড্যান্সার' রাশিয়ায় ওই বছরের সেতা হিট সিনেমা হয়ে ওঠে।
বিপুল টিকিট বিক্রির সুবাদে রাশিয়ায় 'ডিস্কো ড্যান্সারের' আয় দাঁড়ায় ৬০ মিলিয়ন রুবল—ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৪.২৮ কোটি রুপি। আর বিশ্বব্যাপী ছবিটির মোট আয় দাঁড়ায় ১০০.৬৮ কোটি রুপিতে।
মিঠুন চক্রবর্তীর 'ডিস্কো ড্যান্সার' সেই সময়ের সর্বোচ্চ আয় করা ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে রেকর্ড গড়ে এবং প্রথম ১০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে।
ছবিটিতে মিঠুনের পাশাপাশি রাজেশ খান্না, কিম, ওম পুরী, গীতা সিদ্ধার্থ ও করণ রাজদানও অভিনয় করেছিলেন।
এ ছবির তারকা মিঠুন চক্রবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে 'কাল্ট ফিগার' হয়ে ওঠেন। বছরের পর বছর রাশিয়া ও চীনে সাংস্কৃতিক আলোড়ন তৈরি করেছিল 'ডিস্কো ড্যান্সার'। বিশেষ করে ছবিটির 'জিমি জিমি' গানটি এ দুদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
আজও রাশিয়ার বিভিন্ন সিনেমা ক্লাবে 'ডিস্কো ড্যান্সার'-এর 'ভিনটেজ' প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরেলা, ডিস্কো সংগীত ছবিটির বিশেষ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
লেখক অনুভব পাল 'ডিস্কো ড্যান্সার: আ কমেডি ইন ফাইভ অ্যাক্টস' বইয়ে লিখেছেন: 'রাশিয়ায় ডিস্কো ড্যান্সার জিমির মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১০-১১ সালে মিঠুন কাজাখস্তানের আলমাতি শহর সফরে যান। তখন প্রায় দশ লাখ মানুষ হাজির হয়েছিল, বিমানবন্দরে তাকে বরণ করে নিতে। এ কারণে সেদিন রাষ্ট্রপতির জাতীয় ভাষণও বাতিল করতে হয়। টোকিওতে ডিস্কো ড্যান্সারের একটি উপাসনাস্থলও রয়েছে। আর মিশরে ভারতীয় পর্যটকদের ডিস্কো ড্যান্সার গানের মাধ্যমে বরণ করা হয়।'
'ডিস্কো ড্যান্সার'-এর এই সাফল্য ভারতীয় চলচ্চিত্রকে ১০০ কোটির মাইলফলক ছোঁয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ আয় করা ভারতীয় সিনেমা ছিল রমেশ সিপ্পির কালজয়ী 'শোলে'। ছবিটি বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি রুপি আয় করেছিল। তবে 'ডিস্কো ড্যান্সার' এর তিনগুণেরও বেশি আয় করে। পরের এক দশক সর্বোচ্চ আয়ের এই রেকর্ড ধরে রাখে 'ডিস্কো ড্যান্সার'।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে 'হাম আপকে হ্যায় কৌন' দেশে-বিদেশে মোট ১২৮ কোটি রুপি আয়ের নতুন রেকর্ড গড়ে। তার পরের বছর ১০৩ কোটি রুপির মাইলফলক স্পর্শ করে 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে'।
এরপর দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ১০০ কোটির ক্লাবে প্রবেশ করা সিনেমার মধ্যে অন্যতম ছিল 'কাভি খুশি কাভি গম', 'গদর', 'ধুম ২', 'কৃষ' ও 'কাভি আলবিদা না কেহনা'। এসব সিনেমার আয়ের বড় অংশও বিদেশি বাজার থেকে এসেছিল।
২০০৮ সালে 'গজিনি' শুধু ভারতের বাজার থেকেই ১২০ কোটি রুপি আয় করে। ছবিটির এই সাফল্যের মাধ্যমে '১০০ কোটির ক্লাব' কথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
চেহারার জন্য হয়েছেন অবজ্ঞার শিকার; তার সঙ্গে কাজ করতেন না প্রথম সারিরা নায়িকারা
হিন্দি সিনেমার স্বর্ণযুগে শ্যামলা, দীর্ঘদেহী, ঝকঝকে পোশাক পরা, কোঁকড়া চুলের তরুণ মিঠুন 'আই অ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার' ও 'জিমি জিমি' গানের সঙ্গে নেচে মাত করে দেন সিনেমা জগতকে। বাপ্পি লাহিড়ীর সংগীতায়োজনে ডিস্কো সুরের সঙ্গে জটিল স্টেপগুলো দক্ষতার সঙ্গে মিলিয়ে নেচে তিনি হয়ে ওঠেন পপ কালচারের এক বিশেষ আইকন। মিঠুনের সিনেমা ও গান 'পার্টি' জিনিসটাকে নিয়ে আসে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। স্থানীয় অলিগলি, সিনেমা হল, এমনকি বস্তি এলাকাতেও পৌঁছে যায় পার্টি করার এই ছোঁয়াচে 'রোগ'।
তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে মিঠুনকে বহুবার তার দাঁতের গড়ন, গায়ের রং ও ক্তহায় কড়া বাঙালি টানের জন্য সমালোচিত হতে হয়েছে। তাই বলিউডের আদর্শ নায়কদের কাতারে ছিল না তার জায়গা। তাকে বলা হতো 'গরিবের অমিতাভ বচন'। বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয়েছে বহু বি-গ্রেড চলচ্চিত্রে। যদিও প্রথম সিনেমা, মৃণাল সেনের 'মৃগয়া'তেই (১৯৭৬) দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
মিঠুন তার ক্যারিয়ারে বহু কম বাজেটের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এমনই একটি ছবি 'গুণ্ডা'। ১৯৯৮ সালের এই ছবি তাকে রিকশাওয়ালা, বাস কন্ডাক্টর, ট্রাক ড্রাইভার, কুলি ও কারখানার শ্রমিকদের আইকন করে তুলেছিল।
১৯৭৯ সালে 'সুরক্ষা' ছবি তিএ তারকাখ্যাতি পেতে শুরু করেন মিঠুন। তারপর 'পিয়ার ঝুঁকতা নেহি', 'কসম পয়দা কারনেওয়ালে কি', 'কমান্ডো'-র মতো ছবিগুলো তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়।
একবার এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমাকে দেখে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তারা ভাবতে শুরু করে, তাদের গ্রামের ছেলেটিও অভিনেতা হতে পারবে। আমি সাধারণ মানুষের নায়ক হয়ে উঠেছিলাম। সাধারণ মানুষের সুপারস্টার হওয়া আমার জন্য একটি বড় ব্যাপার ছিল।'
মিঠুনের পারিবারিক নাম গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। কলকাতার মিঠুন যখন প্রথম মুম্বাইয়ে পা রাখেন, তখন তার যাওয়ার কোনো ঠিকানা ছিল না। রাস্তায় ঘুমাতেন, খেতেনও রাস্তায়। শুধু গোসলের সুবিধার জন্য মাতুঙ্গা জিমখানায় ভর্তি হন।
কম বাজেটের ছবিতে জনপ্রিয়তা পেলেও এ-গ্রেড চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছিল মিঠুন চক্রবর্তীকে। কিন্তু বলিউড তার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। প্রথম সারির কোনো অভিনেত্রী তার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হতেন না। একটি অনুষ্ঠানে মিঠুন বলেন, 'আমার গায়ের রঙের জন্য সবসময় আমাকে অপমান করা হয়েছে। বছরের পর বছর গায়ের রঙের জন্য অবজ্ঞা করা হয়েছে আমাকে।'
ওই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেন, 'কোনো বড় নায়িকা আমার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হতেন না। তারা ভাবতেন, আমি "ছোট তারকা"। "এ কখনও হিরো হতে পারবে?"'
বি-গ্রেড অভিনেতা হিসেবে সেই সময়ের সংগ্রামের কথা মনে করে তিনি বলেন, 'অনেক সময় ছবির ঘোষণা দেওয়া হয়ে যাওয়ার পরেও অভিনেত্রীরা কাজ ছেড়ে দিতেন। অন্যান্য অভিনেতারাও ওই নায়িকাদের সাবধান করতেন, "এর সাথে কাজ করলে আমাদের সঙ্গে আর কাজ করতে পারবে না।"'
একের পর এক প্রত্যাখ্যান ও প্রতিকূলতার পর অবশেষে মিঠুনের ভাগ্য খোলে ১৯৮৩ সালে। পরিচালক ব্রিজ সাদানা যখন 'তকদির' ছবির জন্য জিনাত আমানকে মিঠুনের বিপরীতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, তিনি সানন্দে কাজ করতে রাজি হয়ে যান। মিঠুন বলেন, 'জিনাতজি সেই দুর্দশার চক্র ভেঙেছিলেন। তিনি ওই সময়ের শীর্ষস্থানীয় নায়িকা ছিলেন। তার দেখাদেখি অন্য অভিনেত্রীরাও আমার সাথে কাজ করতে রাজি হতে শুরু করেন। "তকদির" মুক্তির পর আমি এ-ক্যাটাগরি অভিনেতা হয়ে উঠি।' এরপর মিঠুন ও জিনাত জুটি আরও কয়েকটি সফল ছবিতে অভিনয় করেন।
প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে মিঠুন চক্রবর্তী হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগুসহ বিভিন্ন ভাষার ৩৩০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। পেয়েছেন দুটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। 'মৃগয়া' (১৯৭৬), 'তাহাদের কথা' (১৯৯২) ও 'স্বামী বিবেকানন্দ' (১৯৯৮) ছবির জন্য জিতেছেন তিনটি জাতীয় পুরস্কার।