প্রধান সাক্ষি থেকে ফাঁসির আসামি মিন্নি
বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। গতকাল বুধবার দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আছাদুজ্জামান এ রায় প্রদান করেন। একই সাথে মিন্নিকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডও দেয়া হয়। এ রায়ের মাধ্যমে মিন্নি এ মামলার প্রধান সাক্ষি থেকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত হয়।
আইনজীবীদের মাধ্যমে জানা গেছে- রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রিফাতের উপর হামলার সময় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিফাতকে বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মিন্নির সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুবসমাজ, দেশের সব বয়সের মানুষ তাদের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছেন। এমতাবস্থায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার অশঙ্কা থাকবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্চনীয়।
গত বছরের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বরগুনার কিশোর গ্যাং- বন্ড বাহিনী। পরে ওইদিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন রিফাত।
এ ঘটনার পরের দিন বরগুনা সদর থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৫-৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এতে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষি করা হয়।
এদিকে রিফাত শরীফের উপর হামলার একটি ভিডিও ভাইরাল হলে মিন্নির প্রতি সহমর্মিতা জেগে ওঠে। পাশাপাশি হামলাকারী নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর হাত থেকে রিফাত শরীফকে বাঁচাতে মিন্নির আপ্রাণ প্রচেষ্টার জন্য দেশব্যাপী সাহসীকন্যা খ্যাতিপান মিন্নি। স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির প্রচেষ্টার জন্য বাহবা পায় সর্বত্র।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর গত বছরের ২৮জুন গণমাধ্যমে মিন্নি ও নয়ন বন্ডের বিয়ের খবর প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও নয়ন বন্ডের বাসায় মিন্নির যাওয়ার খবর। এতে মুহুর্তেই মিন্নির অবস্থান উল্টে যায়। এরপর থেকেই মিন্নির ওপর সন্দেহের চোখ যায় পুলিশের। আর তখন থেকেই মিন্নির বাড়িতে মোতায়েন করা হয় পুলিশ সদস্যদের।
রিফাত হত্যাকাণ্ডের ১৭দিন পর গত বছরের ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে এ হত্যাকাণ্ডের মাষ্টারমাইন্ড উল্লেখ করে তাকে গ্রেফতারের জন্য সংবাদ সম্মেলন করেন এ মামলার বাদি ও নিহত রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এরপর ওইদিন রাতেই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন মিন্নি। এর পরের দিন ১৪ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন মিন্নির বাবা মোঃ মোজ্জাম্মেল হোসেন কিশোর। তিনিও রিফাত হত্যাকাণ্ডের মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
দুই পরিবারের পাল্পাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন গত বছরের ১৫ জুলাই বরগুনার সরকারি কলেজের সামনে থাকা একটি সিসি ক্যামেররার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পায়। এতে দেখা যায়, হামলার আগ মুহুর্তে রিফাত শরীফ ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে চাইলেও গড়িমসি করে সময় ক্ষেপণ করেন মিন্নি। এরপর দলবদ্ধভাবে বন্ড বাহিনী রিফাত শরীফকে মারতে মারতে কলেজ গেট থেকে সামনের দিকে নিয়ে গেলেও তখন মিন্নি স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিলেন হামলাকারীদের সাথে।
ওই সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আরো দেখা যায়, রিফাত ফরাজির নেতৃত্বে যখন রিফাত শরীফকে কিলঘুষি মারা হচ্ছে তখন নয়ন বন্ড দৌড়ে এসে হামলা করে রিফাত ফরাজীর উপর। এসময়ও রিফাতকে বাঁচাতে কোন ভুমিকাই রাখেনি মিন্নি। এরপর রিফাত ফরাজি দৌড়ে গিয়ে দুটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে এসে একটি দিয়ে নিজে কোপাতে থাকেন রিফাত শরীফকে আর অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে কোপাতে শুরু করেন নয়ন বন্ড। এ সময় মিন্নি রিফাততে বাঁচাতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেন। রিফাতের উপর হামলা শেষে বন্ড বাহিনী চলে গেলে রিফাতকে নিয়ে হাপাতালেও যান মিন্নি।
এদিকে রিফাতের মৃত্যুর ১৯ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর ওইদিন রাতেই এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের দিন ১৭ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মিন্নির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বামীর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা শিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর থেকে টানা ৪৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন মিন্নি। আর মিন্নির কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার দুদিন আগে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকালে মিন্নিকে প্রাপ্তবয়স্ক আসামীদের মধ্যে সাত নম্বর অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। চার্জশিটে মিন্নিকে এ হত্যার মাষ্টারমাইন্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু জানান, মিন্নি প্রথমে এ মামলার সাক্ষী ছিলো এটা সত্য। কারণ যখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেখানে নিহত রিফাতের বাবা উপস্থিত ছিলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুত্রবধু আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তখন সরল মনে রিফাত শরীফের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ পুত্রবধু মিন্নিকে এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী রাখেন। পরে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে মিন্নির সাথে হত্যাকারী নয়ন বন্ডের বিয়ে এবং সখ্য ছিলো, যখন তিনি এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মিন্নির পূর্বপরিকল্পনার বিষয়টি বুঝতে পারেন তখনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানান।
অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু আরও বলেন, এ হত্যাকান্ডের আগে এবং পরে নয়ন বন্ডসহ হত্যাকারীদের সঙ্গে মিন্নির একাধিক যোগাযোগ হওয়ার বিষয়টি আদালতের কাছে প্রমাণিত হযেছে। তাছাড়া রিফাত শরীফের আগে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের কাবিনসহ সংশ্লিষ্ট কাজিও আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজি, আল-কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান এবং নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- রাফিউল ইসলাম রাব্বি, কামরুল ইসলাম সাইমুন, মো. সাগর ও মো. মুছা।
আসামিদের দণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভুবন চন্দ্র হালদার।