জলবায়ু সুরক্ষায় বৈশ্বিক পদক্ষেপ কতোটা সফল?
২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিলেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। এই লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হয়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার কয়দিন সময় বাকি আছে পরিবেশবিদরা তারই হিসাব রাখছেন নিউইয়র্কের একটি ঘড়ির মাধ্যমে। সময় বাকি আছে আর মাত্র ৭ বছর ১০০ দিন।
সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার জন্য নিউইয়র্কে জমায়েত হয়েছেন সরকারি প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী নেতা ও জলবায়ু ও পরিবেশ সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা।
নিউ ক্লাইমেট ইনস্টিটিউটের সহপ্রতিষ্ঠাতা জলবায়ু বিজ্ঞানী নিকলাস হোনে জানান, জলবায়ু সুরক্ষায় সব দেশই অত্যন্ত স্বল্প মাত্রায় কাজ করছে।
নিউ ক্লাইমেট ইনস্টিটিউট ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্স যৌথভাবে এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
নিকলাস জানান, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বজুড়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক দেশই এই অজুহাত দেখিয়ে জলবায়ু সুরক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষার কাছে বিনিয়োগের কোনো বিধানই রাখেনি, অন্যদিকে বিমানসংস্থার মতো পরিবেশ দূষণকারী খাতে সার্বিক সহায়তা করছে।
প্রতিষ্ঠান দুটির ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার (সিএটি) তে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছাড়াই কীভাবে রাশিয়ার নতুন শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে । মহামারিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে মেক্সিকো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বন্ধ করে জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। ক্রমবর্ধমান বন নিধনের ব্যাপারে ব্রাজিল তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, শিথিল হয়ে গেছে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন।
চীনের ঘোষণা
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ পরিকল্পনার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর দক্ষিণ কোরিয়াও কোরিয়ান গ্রিন নিউ ডিলের মাধ্যমে মহামারি পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ভারতের পরিকল্পনা কীভাবে প্রভাব রাখতে পারে তা এখনো অনুমান করা সম্ভব না বলে জানান নিকলাস।
বর্তমান সময় পর্যন্ত পরিবেশ দূষণের তালিকার শীর্ষে আছে চীন। তবে জাতিসংঘের সর্বশেষ সাধারণ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে ২০৬০ সালের মধ্যে চীনকে কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং।
এ প্রসঙ্গে নিকলাস বলেন, 'গত পাঁচ বছরে এটি বৈশ্বিক জলবায়ু নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। বিশ্বের এক চতুর্থাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী চীন যদি ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.২ থেকে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাবে।'
তবে ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকিংয়ের তথ্যানুযায়ী, চীনের নতুন এই লক্ষমাত্রা অর্জন হলেও, এই শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২.৪ থেকে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। এমনকি, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ফলে এবছর বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫ -৯ শতাংশ কমে আসলেও এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার কথা জানালেও, এখন পর্যন্ত মাত্র ১২ টি দেশ ঘোষণা দিয়েছে।
চিলি, নরওয়ের মতো ছোট দেশগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। রুয়ান্ডা গত মে মাসে আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা অন্তত ১৬ শতাংশ কমিয়ে আনবে।
সংকটকালীন শিক্ষা
ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের জলবায়ু ও অর্থনীতি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলেন মাউন্টফোর্ড জানান, পরিবেশগত সচেতনতার ক্ষেত্রে মহামারির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
শিল্পোন্নত দেশগুলো খাদ্য সরবারাহ সহ বিভিন্ন কারণে অন্য দেশের উপির নির্ভরশীল। পণ্য সরবরাহ বজায় রাখতে এবং অভিবাসন হার স্বাভাবিক রাখতে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন হতে পারে দেশগুলো।
জার্মান ওয়াচ, নিউক্লাইমেট ইনস্টিটিউট ও ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত জলবায়ু সুরক্ষা সূচকে দেখা যায়, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সব দেশই পিছিয়ে আছে। কোনো দেশই প্রথম থেকেই তৃতীয় স্থান পায়নি কারণ কোনো দেশই জলবায়ু সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করছেনা। চীনের নতুন ঘোষণার ফলে আগামী বছর দেশটি র্যাঙ্কিংয়ে এগুতে পারে, তবে ২০৬০ সাল পর্যন্ত অনেক সময় এবং কাজ বাকি।
এদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার সময়ও ক্রমাগত এগিয়ে আসছে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে