পর্যটন শিল্প ধ্বংসে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে: টুয়াক
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিকে ঘিরে গড়ে উঠা পর্যটন শিল্প ধ্বংস করতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করেছেন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক)।
শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজার রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড হলরুমে এক সংবাদ সম্মেলনে টুয়াক নেতারা এ দাবি করেছেন।
সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রীযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনায় করা সংবাদ সম্মেলনে টুয়াক নেতারা বলেন, কয়েক যুগ ধরে চলে আসা পর্যটনের গতি হঠাৎ করে থামিয়ে দেওয়া যায় না। সেন্টমার্টিনকে লক্ষ্য করে অনেক পর্যটক কক্সবাজার আসেন। এখনই যদি সেন্টমার্টিন যাওয়া রদ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কক্সবাজার পর্যটন বিমুখ হবেন ভ্রমণ পিপাসুরা।
তারা আরও বলেন, 'বছরে ৫ মাসের শুষ্ক মৌসুমকে কেন্দ্র করে পর্যটন সেবায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। সেন্টমার্টিনে পর্যটন সমাগম নিয়ন্ত্রিত হলে লগ্নি করা অর্থ ফিরে না আসার শঙ্কাই বেশি। দৈনিক ৩ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন গিয়ে অর্ধেক রাত্রীযাপন ও বাকি অর্ধেক ফিরে এলে সেন্টমার্টিনের প্রতিবেশ ক্ষতির মুখে পড়বে না। আমরা চাই টেকসই পর্যটনের পাশাপাশি সেন্টমার্টিনের পরিবেশও রক্ষা করতে।'
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পর্যটনশিল্প ও স্থানীয় জনগণ এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাই পর্যটনবিরোধী এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে টুয়াক।
সংগঠনটি জানায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ কিংবা পর্যটন সেবায় দুই শতাধিক ট্যুর অপারেটর ও পাঁচ শতাধিক গাইড এবং লক্ষাধিক পর্যটকসেবী কর্মকর্তা-কর্মচারি কাজ করছেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন শিল্প বিকশিত হওয়ার আগে স্থানীয় জনগণ সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ, প্রবাল উত্তোলন, প্রবাল পাথরকে নির্মাণ কাজে ব্যবহার, মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস, শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চলমান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে স্থানীয়রা পূর্বের পেশায় ফিরে যাবেন। তখন দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখিন হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ৭ মাস কোভিড-১৯-এর প্রভাবে পর্যটন স্পট বন্ধ থাকায় পর্যটন ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। অন্যদিকে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। এ অবস্থায়, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে পর্যটন শিল্পে ধস নামবে।
এসব বিবেচনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৩টি দাবি দিয়েছেন টুয়াকের সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ।
১। চলমান অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পর্যটকদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
২। স্বদেশি পর্যটকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অর্ন্তভুক্ত না করা এবং কোনো প্রকার সেবা বা ভ্রমণ চার্জ আরোপ না করা। শুধুমাত্র বিদেশি পর্যটকদের নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে সেবা বা ভ্রমণ চার্জ আরোপ করা যেতে পারে।
৩। টুয়াকের গৃহীত 'প্লাস্টিক ফ্রি ইকো ট্যুরিজম, কক্সবাজার' নামক প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়িত করার অনুমোদন ও সহায়তা প্রদান।
পর্যটন ও পরিবেশের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম বাস্তবায়ণের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে টুয়াকের আরও ১২টি প্রস্তাবনা রয়েছে।
১। সেন্টমার্টিনে পরিবেশ রক্ষার জন্য ক্ষতিকারক সকল ধরনের প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের ব্যবহার ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।
২। দ্বীপের ভাঙ্গন রোধে মূল ভূখণ্ড থেকে ৫০০ মিটার দীর্ঘ আধুনিক জেটি তৈরির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা।
৩। পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ইকো হোটেল, মোটেল এবং হোম স্টে মডেল তৈরি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা।
৪। দ্বীপে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং জেনারেটর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
৫। দ্বীপের একটি অংশকে পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ করে জীব বৈচিত্র্যের জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করা।
৬। পর্যটক ও স্থানীয়দের ময়লা-আবর্জনা একটি নির্ধারিত স্থানে সংগ্রহ করে অপচনশীল আর্বজনাগুলোকে দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা এবং প্লাস্টিক ফ্রি সেন্টমার্টিন ঘোষণার প্রকল্প গ্রহণ করা।
৭। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগের পরিবর্তে চারপাশে বেশি বেশি কেয়াবন তৈরি, নারিকেল গাছ ও ঝাউগাছের বেষ্টনি তৈরি করে বালিয়াড়ি রক্ষা করা।
৮। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূগর্ভস্থ ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সেন্ট্রাল এসটিপি বাস্তবায়নের প্রকল্প গ্রহণ করা।
৯। দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে সমুদ্রের পানিকে শোধন করে ব্যবহার উপযোগী করার প্রকল্প গ্রহণ করা।
১০। প্রবাল প্রাচীরের সুরক্ষা এবং প্রবাল পাথরের স্তর বৃদ্ধিতে দেশি-বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
১১। আন্ডারওয়াটার ন্যাচার সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ, সমুদ্র তলদেশের প্রবাল উত্তোলণ ও মৎস্য প্রজননে ব্যঘাত ঘটে- এমন কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা।
১২। ব্লু ইকোনমিতে মেরিন ট্যুরিজম বিকশিত করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম মডেল হিসেবে গড়ে তোলা।
পর্যটন বিষয়ক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমূহের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিনিধি, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবি, পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজারের সুশীল সমাজ, সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, পরিবেশ সংগঠন, কক্সবাজারের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিনিধি, কক্সবাজারের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, সেন্টমার্টিনের জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়িক প্রতিনিধি, সেন্টমার্টিন চলাচলকারী জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি এবং টুয়াকের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে সমীক্ষা চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণ, রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণ, চার্জ আরোপ ও নিবন্ধন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানান টুয়াকের প্রধান উপদেষ্টা মফিজুর রহমান মফিজ।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত তিন লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে বলে মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে টুয়াকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আনোয়ার কামাল, সহ-সভাপতি হোসাইন ইসলাম বাহাদুর, সাধারণ সম্পাদক আসাফ উদ দৌলা আশেক, সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক আজম, যুগ্ম সম্পাদক আল আমীন বিশ্বাস, এসএ কাজল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সম্পাদক মোঃ তোহা ইসলাম, শহিদুল্লাহ নাঈম, মোহাম্মদ ইউছুপ, মোহাম্মদ শিবলি সাদেক, মুহাম্মদ মুসা, জিল্লুর রহমান চৌধুরী, সাইম রহমান অভিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।