ঢাকার অজানা অতীত: প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে এলো নতুন ইতিহাস
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৬১০ সালে বাংলাদেশের বর্তমান রাজধানী ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা অঞ্চলে নিযুক্ত মুঘল সুবাহদার ইসলাম খান। ১৬০৮ সালে রাজমহল থেকে তিনি রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন৷ আর এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু মুসা খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে তার এখানে আগমন দুই বছর পিছিয়ে যায়।
পরবর্তীতে ঢাকাকে কমপক্ষে আরও চারবার এই অঞ্চলের রাজধানী নামকরণ করা হয়। প্রথমবার ১৬৬০ সালে মীর জুমলা, দ্বিতীয়বার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে।
কিন্তু এখন পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নতুন এক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এই সময়ের আগেও অন্তত দুইবার ঢাকা ছিল এই অঞ্চলের রাজধানী। এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে 'পুরোনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন: ঢাকার উৎপত্তির বিশ্লেষণ' শীর্ষক একটি পাবলিক বক্তৃতায় নতুন এই তথ্য জানানো হয়।
আগের ইতিহাসের বইগুলিতে বলা হয়েছে যে, ঢাকা ৪০০ বছরের পুরোনো শহর। তবে আবিষ্কারটি থেকে জানা যায়, ঢাকা প্রায় ২৫০০ বছর ধরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসার কেন্দ্র ছিল।
খননের কাজ যেভাবে শুরু
আবিষ্কারটি সাধারণভাবে বলতে একেবারে 'নতুন' নয়। অনুসন্ধানটি ২০১৬-১৭ সালে শুরু হয়েছিল; পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করার পর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিরাপত্তা সেবা বিভাগ 'পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ' নামে একটি প্রকল্প চালু করে।
এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও তার দলকে খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "ইসলাম খান ঢাকায় আসার পর একটি দুর্গে বসবাস করতেন। অনেক স্থানীয় ঐতিহাসিক এই দুর্গটিকে মুঘল দুর্গ বলে উল্লেখ করেছেন।"
তিনি আরও বলেন, "কিন্তু খানের একজন অ্যাডমিরাল মির্জা নাথান 'বাহারিস্তান-ই-গায়বি' (অদৃশ্যের বাগান) নামে একটি বই লিখেছেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ঢাকায় আগে থেকেই একটি দুর্গ ছিল।"
সেক্ষেত্রে অধ্যাপক সুফি পাল্টা প্রশ্ন করেন যে, "ইসলাম খানের আসার আগে থেকেই যদি দুর্গটি থেকে থাকে, তবে তা মুঘল দুর্গ হবে কীভাবে?"
জেল চত্বরের অধিকাংশ এলাকা কংক্রিট বা ব্রিটিশ-পরবর্তী অন্যান্য কাঠামো দিয়ে আবৃত ছিল। এক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের পর খননের জন্য ১১টি স্থান নির্ধারণ করা হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা কী খুঁজে পেলেন
প্রায় সব খননকৃত জায়গায় ইট রয়েছে; যা দেয়াল ও মেঝেতে ব্যবহৃত হত। নতুন পাওয়া এই ইটগুলি আকার ও নকশা উভয় ক্ষেত্রেই আধুনিক ইটগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
দুর্গ থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুর বয়স অনুমান করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিটা অ্যানালিটিক টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে চারকোলের পাঁচটি ভিন্ন নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। প্রাপ্ত ফলাফলগুলি থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীনতম নমুনাগুলি ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের। যার অর্থ ঢাকায় মুঘলদের আগমনের প্রায় ২০০ বছর আগে দুর্গটি সেখানে ছিল।
জায়গাটিতে পাওয়া অন্যান্য প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে কয়েন, চুড়ি, বিভিন্ন আকারের পাথর, চীনামাটির বাসন, টেরাকোটা, মৃৎপাত্র ইত্যাদি।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "জায়গাটি থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল রঙিন চকচকে মৃৎপাত্র। যেগুলি উয়ারী-বটেশ্বর ও মহাস্থানগড়ে পাওয়া গিয়েছিল। এই মৃৎপাত্রগুলি সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাওয়া মৃৎপাত্রগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যা সাসানীয় যুগের ইঙ্গিত দেয়।"
অধ্যাপক সুফি আরও বলেন, "গোলাকার মৃৎপাত্র আরেকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। কারণ এটি শ্রীলঙ্কা, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানেও পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে ঢাকার একটি অংশে এটি খুঁজে পাওয়া বেশ জোরালো ইঙ্গিত দেয় যে, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুট অর্থাৎ বিখ্যাত সিল্ক রুটের সাথে যুক্ত ছিল।"
উয়ারী-বটেশ্বর, মহাস্থানগড় ও তমলুকসহ একাধিক স্থানে পূর্ববর্তী অনুসন্ধানে একই ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদেরা এক্ষেত্রে একমত যে, এই মৃৎপাত্রগুলি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ২০০-১০০ খ্রিষ্টপূর্বে আমদানি করা হয়েছিল।
পরে ভারতীয় অঞ্চলের কারিগররাও এমন জিনিসপত্র তৈরি করতে শিখেছিল। যদিও তা ভূমধ্যসাগরীয় আমদানিকৃত পণ্যগুলির মতো উচ্চমানের নয়।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "সিল্ক রুট সম্পর্কিত পণ্যের উৎপত্তি, ঢাকায় আনা নতুন চকচকে ও গোলাকার মৃৎপাত্র বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্থানটি বাণিজ্য রুটের একটি অংশ ছিল।"
এইভাবে নতুন উন্মোচিত আবিষ্কারের মাধ্যমে অধ্যাপক সুফি দাবি করেছেন, ঢাকা পূর্বের গৌরব হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। মূলত স্থানটি প্রায় ২৫০০ বছর আগের।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "আড়াই হাজার বছর আগে ঢাকায় প্রথমবারের মতো মানব বসতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বলে দাবি করা হয়েছে। এটিই প্রথম দাবি যে, ঢাকা সিল্ক রুটের সাথে যুক্ত ছিল।"
অধ্যাপক সুফি মনে করেন, ইসলাম খানের আগমনের আগে ঢাকা বাংলা অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে অন্তত দুইবার ছিল। প্রথমবার ঐতিহাসিক যুগে (আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) আর অন্যটি ১৫ শতকে।
ঢাকা কেন বারবার রাজধানী হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে?
অধ্যাপকের সুফির মতে, ঢাকাকে রাজধানী ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে এই অঞ্চলের অবস্থান ও জলবায়ু ছিল দুটি মূল কারণ।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থান খুবই অনন্য। যা বিশ্বের অন্যসব শহরের মতো নয়। যদিও ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত বলে মনে করা হয়। তবে ঢাকার মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০টি নদী ও খাল প্রবাহিত ছিল।"
অধ্যাপক আরও বলেন, "ঢাকা থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যাতায়াতই ছিল বেশ সহজ। একইসাথে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার এই যে, এই নির্দিষ্ট অঞ্চলটি বন্যামুক্ত। যা এটিকে চট্টগ্রামের মতো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা সুবিধা দিয়েছে।"
এই অঞ্চলের মাটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, "মাটি ঘরের দেয়াল তৈরিতে কাজে এসেছিল। তার উপরে মধুপুর থেকে কাঠের সহজলভ্যতা ঢাকাকে বসতি স্থাপনের জন্য একটি আদর্শ স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছিল।"
তবে আবিষ্কারটি যদি ২০১৬-১৭ সালের হয়, সেক্ষেত্রে কেন এই আবিষ্কারটি আগে প্রকাশ করা হয়নি?
অধ্যাপক সুফির অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, যিনি কি-না সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি জেল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করেছেন যাতে প্রকল্পটি আর এগোতে না পারে।
অধ্যাপক সুফি বলেন, "পরবর্তী অর্থবছরেও অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য একটি বাজেট ছিল। কিন্তু কোন আপাত কারণ ছাড়াই প্রকল্পটি বন্ধ হয়। আমাকে আমার ফলাফলগুলিও উপস্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।"
অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক মামুন বলেন, "খনন প্রকল্প বন্ধ করা ছিল কমিটির সিদ্ধান্ত। আমি কমিটির সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করিনি বা প্রভাবিত করিনি। আমি শুধু কমিটির সদস্য ছিলাম।"
তিনি আরও বলেন, "তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) কমিটির প্রধান ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে কেন প্রকল্পটি বন্ধ করা হয়েছে।"
অধ্যাপক সুফি প্রকল্পটি নিয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "আমি মনে করি খোঁজ করার মতো আরও অনেক কিছু আছে। এখনও অনেক নিদর্শন রয়েছে যা আমাদের অতীত সম্পর্কে আরও বিষয় জানাতে পারবে। যদি মন্ত্রণালয় আমার সাথে ফের যোগাযোগ করে, তবে আমরা আরও অনুসন্ধান চালাবো।"
তিনি আরও বলেন, "প্রকল্পটি নিয়ে আরও কাজ করা হলে আমরা আমাদের না জানা আরও গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য পেতে পারি। রোসেটা স্টোন যেভাবে মিশরের অজানা ইতিহাসকে উন্মোচন করেছিল, একইভাবে চকচকে ও গোলাকার মৃৎপাত্র ঢাকার জন্য একই ফলাফল নিয়ে আসতে পারে।"