রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে যেভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে
স্বাভাবিক সময়ে অগ্রণী, সোনালী, জনতা, রূপালী ও কৃষি– রাষ্ট্রায়ত্ত এই বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ৫ ব্যাংকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে— অগাস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে তার দ্বিগুণেরও বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তাদের ডলার সংকট মেটাতে রেমিট্যান্সের ডলারের বিপরীতে বেশি রেট অফার করতে শুরু করায় ডলারও বেশি পেতে শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ১২০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২২.২০ টাকা থেকে ১২২.৪০ টাকা মূল্য পরিশোধ করছে। অন্যদিকে, বেসরকারী ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে ১২২ টাকা থেকে ১২২.২০ টাকাদিচ্ছে বলে জানান তার।
আর এসব ডলার সরকারি আমদানি এলসির ওভারডিউ পেমেন্ট (বকেয়া) পরিশোধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ অর্থবছরে ব্যাংকখাতে রেমিট্যান্স এসেছে ২৩.৯২ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পেয়েছিল ৩.৪ বিলিয়ন ডলার বা মোট রেমিট্যান্সের ১৪.২৩ শতাংশ।
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মাসে ২০২৫ অর্থবছরের আগস্ট–অক্টোবর পর্যন্ত পুরো ব্যাংকখাত রেমিট্যান্স পেয়েছে ৭.০৩ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই পেয়েছে ২.০৬ বিলিয়ন ডলার বা মোট রেমিট্যান্সের ২৯.২৭ শতাংশ।
অর্থাৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ২০২৪ অর্থবছরে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়েছিল, ২০২৫ অর্থবছরের তিন মাসেই তার ৬০ শতাংশ রেমিট্যান্স পেয়ে গেছে।
ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডলারের বাজারে রেমিট্যান্স সবসময়ই রেট সেন্সিটিভ প্রোডাক্ট। অর্থাৎ, যে ব্যাংক বেশি রেট অফার করবে, সে ব্যাংকই বেশি রেমিট্যান্স পাবে। নিজেদের চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এই সুযোগটিই লুফে নিয়েছে। অন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বেশি অফার করে তারা বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স পেয়েছে গত অগাস্ট-অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে।
এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্তত ৩টি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার যেসব আমদানি এলসি খোলে, তার সিংহভাগই খোলা হয় এসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ডলার সংকট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় অনেক আমদানি বা ইমপোর্ট পেমেন্ট ওভারডিউ (বকেয়া) হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ, ইমপোর্ট পেমেন্টের ম্যাচুরিটি ডেট চলে গেলেও ব্যাংকগুলো সময়মতো এসব পেমেন্ট করতে না পেরে বকেয়া রেখেছিল।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিয়োগ দেওয়া নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর চলতি বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব ওভারডিউ পেমেন্টগুলো ক্লিয়ার করার দিকে মনযোগ দেন। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এই ওভারডিউ পেমেন্টের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে তিনি বলে দেন, এসব পেমেন্ট ক্লিয়ার করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার দেওয়া হবে না, বরং ব্যাংকগুলোর নিজেদেরকেই এসব ডলার ম্যানেজ করতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল নির্দেশনা মেনেই সোনালী ব্যাংক রেমিট্যান্স ডলার সংগ্রহ করছে।
তিনি বলেন, "আমাদের ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা দেরিতে হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এছাড়া, আমরা সেবার মান উন্নত করেছি— যা আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করেছে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই রেমিট্যান্স ডলার ব্যবহার করা হচ্ছে ওভারডিউ সরকারি আমদানি এলসির পেমেন্ট মেটাতে এবং নতুন এলসি খুলতে।"
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, সরকারি ব্যাংকগুলো সাধারণত ডলারে রপ্তানি আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। ফলস্বরূপ, তাদের কাছে ডলার সংগ্রহের দুটি উপায় রয়েছে: একটি আন্তঃব্যাংক বাজার এবং অন্যটি রেমিট্যান্স।
কর্মকর্তারা জানান, বকেয়া ইম্পোর্ট এলসি পেমেন্টের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কিছুটা বেশি রেট অফার করছে; মূলত এ কারণেই তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে কার্যরত অন্যতম প্রধান একটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের কান্ট্রি হেড বলেন, "আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করি। এসব রেমিট্যান্স বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কাছে আমরা রেট অফার করে থাকি। যে ব্যাংক আমাদের বেশি রেট দেয়, আমরা ওই ব্যাংককেই রেমিট্যান্স ডলার দিয়ে থাকি।"
তিনি জানান, "অন্য সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশি রেট দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করলেও গত কয়েকমাস ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আমাদের কাছে থেকে অনেক ডলার নিচ্ছে।"
"গত ৭ নভেম্বর আমরা ১২২.২০ থেকে ১২২.৪০ টাকা রেটে ব্যাংকগুলোর কাছে রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করেছি। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রেমিট্যান্সের ডলারের রেট আরও ১০-২০ বেসিস পয়েন্ট বেশি ছিল, যদিও সেটি এখন কমে এসেছে," যোগ করেন তিনি।
সেপ্টেম্বর মাসভিত্তিক তুলনা থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংক মিলে রেমিট্যান্স পেয়েছে ৭৪৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের একই মাসে এই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স পেয়েছিল মাত্র ১৫৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৩৮৬ শতাংশ।
এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরের ৪৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৩২২ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পায়, রূপালী ব্যাংক ৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে পায় ১১৪ মিলিয়ন ডলার, সোনালী ব্যাংক ৩৩ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৯৫ মিলিয়ন ডলার, জনতা ব্যাংক ৩৩ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১০৬ মিলিয়ন ডলার এবং কৃষি ব্যাংক ৩৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১১০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা
চলতি অর্থবছরের অগাস্ট-অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪৩ শতাংশ— যার প্রায় পুরোটাই পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। রেমিট্যান্সের বাজারে প্রভাবশালী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব বেশি বাড়েনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ অর্থবছরে এই বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিমাসে গড়ে ১.৭১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে।
২০২৫ অর্থবছরের অগাস্ট-অক্টোবর সময়ে রেমিট্যান্সের সামগ্রিক গ্রোথ থাকলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই মাসগুলোতে গড়ে রেমিট্যান্স পেয়েছে ১.৬৬ বিলিয়ন ডলার— যা আগের অর্থবছরের গড় রেমিট্যান্স থেকে কম।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশি রেমিট্যান্স সংগ্রহ করাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ছে কিনা জানতে চাইলে একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, "আমাদের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এখন ওভারডিউ পেমেন্ট খুব বেশি নেই। কারণ, ডলার সংকট শুরু হওয়ার দিকে আমরা ডলারের যোগান নিয়ে যে সমস্যা পড়েছিলাম, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ডলার ইনফ্লো বিবেচনায় আমদানি এলসি খোলা শুরু করেছিলাম।"
"ফলে, আমাদের যেসব পেমেন্ট বাকি আছে, ওসব ডলার আমরা ইতোমধ্যে ম্যানেজ করে রেখেছি; তাই এখন আমাদের কোনো বাড়তি চাহিদা নেই।"
এছাড়া, বর্তমানে ইমপোর্ট এলসি খোলার চাহিদাও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এসব কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশি রেমিট্যান্স নেওয়াতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ কমে আসছে মন্তব্য করে অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার আরও বলেন, "রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে প্রতিযোগিতা না করলে আমার ধারণা ডলারের রেট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ১২০ টাকার কাছাকাছি চলে আসতো। তবে, আশার কথা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ এখন আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এটি পুরোপুরি কেটে গেলে পুরো ব্যাংকখাতই উপকৃত হবে।"
তিনি বলেন, "বিদেশি করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের যেসব পেমেন্ট কমিটমেন্ট আছে, সেগুলো করে ফেললে বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ভালো হবে। পাশাপাশি আমাদের ট্রেড ক্রেডিটের লিমিটও বাড়বে, যেটি দিনশেষে আমাদের অফশোর ও অনশোর বুক মেন্টেইন করতে সুবিধা দেবে।"
"নতুন গভর্নর ইতোমধ্যে শতাধিক বিদেশি করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে পেমেন্টের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কিছুটা বেশি রেট অফার করে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করলেও এটি দিনশেষে আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচকই হবে," যোগ করেন তিনি।