ভিস্তিওয়ালা নন, তারা পুরান ঢাকার ভাঁড়ওয়ালা
সবে ভোরের আলো ফুটেছে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে পুরান ঢাকার অলিগলি! দু-একটি চায়ের দোকানে শোনা যাচ্ছে টুংটাং শব্দ। শীত শীত আবহে চা পানের উদ্দেশ্যে সেখানে জড়ো হয়েছেন কেউ কেউ। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের চুমুকে শরীর-মন চাঙা করে তোলার উদ্দেশ্যেই হয়তো তাদের আসা। এরই মধ্যে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে মোঃ ইয়াকুবের। ভোর হতে না হতেই তিনি ছুটে চলেছেন এ-গলি থেকে ও-গলি। তার গন্তব্য এখন সদ্য খোলা চায়ের দোকানগুলো।
ইয়াকুবের কাঁধে ভার বহনকারী বাঁশের লাঠি। সে লাঠির দুপাশে ঝুলছে দুটি টিনের পাত্র। এসব পাত্রে রয়েছে পানি। এই পানিই তিনি সরবরাহ করেন দোকানে দোকানে। পানি সরবরাহের এ কাজে তিনি আছেন আজ প্রায় ত্রিশ বছর। পুরান ঢাকায় তার মতো অনেকেরই পেশা এটি। একটি পোশাকি নামও রয়েছে তাদের—ভাঁড়ওয়ালা!
সদরঘাট কোতোয়ালি থানার সামনে দশ-বারোজন মানুষ প্রাচীনতম এই পেশাকে বানিয়েছেন নিজেদের জীবিকার উৎস। এদের বেশিরভাগের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানায়। এছাড়াও আছেন বরিশাল, বিক্রমপুর, মাদারীপুর আর শরিয়তপুরের মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়া যখন লেগেছে সর্বত্র, তখনও বাপ-দাদার শেখানো এ পেশায় টিকে রয়েছেন তারা।
ভিস্তিওয়ালা থেকে ভাঁড়ওয়ালা
এই ভাঁড়ওয়ালাই মনে করিয়ে দেন তাদের পেশাগত পূর্বসূরি ভিস্তিওলাদের কথা। প্রাচীনকালে সুপেয় পানি সহজলভ্য ছিল না ঢাকায়। বাড়িতে বাড়িতে কুয়ো ছিল বটে, কিন্তু খাওয়া যেত না সেসব কুয়োর পানি। খাবার পানির একমাত্র উৎস তখন নদ-নদী। সে সময়ে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করতেন একদল পেশাজীবী, যাদের বলা হতো ভিস্তিওয়ালা।
তাদের পিঠে থাকত ছাগলের চামড়ায় তৈরি একধরনের কালো ব্যাগ। একেই বলা হতো ভিস্তি। অন্য নাম ছিল মশক। কাঁধে এই ভিস্তি নিয়ে ভিস্তিওয়ালা ঘুরে বেড়াতেন শহরজুড়ে, আর শোনা যেত তাদের হাঁক—'ভিস্তি আবে ভিস্তি'।
দুবেলা বাড়ি বাড়ি সুপেয় পানি সরবারাহ করতেন বলে তাদের বেশ কদরও ছিল ঢাকাবাসীদের কাছে। স্বয়ং মোগল সম্রাটের কাছ থেকেও নাকি পেয়েছিলেন বিশেষ সম্মাননা! ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' বইয়ে লিখেছেন, ঢাকা শহরে কল স্থাপনের আগে ভিস্তিওয়ালারা নদী থেকে পানি নিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে দিয়ে যেতেন। এমনকি, গত শতকের ষাটের দশকেও ঢাকায় তারা ছিলেন বহাল তবিয়তে।
কবি শামসুর রহমানও তার স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন ভিস্তিওয়ালাদের কথা। 'আর ভুলিনি সেই ভিস্তিকে, যে রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। তখন ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে কল ছিল না পানির। তাই অনেক বাড়িতেই ছিল ভিস্তির আনাগোনা। কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পেতলের কলসের ভেতর।'
ভিস্তিরা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও তাদের সেই পানি সরবারাহের পেশা এখনও টিকে রয়েছে অন্যরূপে, এই ভাঁড়ওয়ালাদের মাধ্যমে।
ওরা এ যুগের ভিস্তিওয়ালা
বাবার সঙ্গে মো: ইয়াকুব যখন ঢাকায় আসেন, তখন তার বয়স ষোল কি সতেরো হবে। থাকতেন বাংলাবাজারের কোতোয়ালী থানার পাশে। তখন থানার পাশেই ছিল মস্ত এক মাঠ। কালক্রমে সেই মাঠে গড়ে ওঠে বস্তি। সদরঘাট এলাকার লোকজন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজের সন্ধানে আসা মানুষ সেসব বস্তিতে বসবাস শুরু করে। ইয়াকুবের বাবা-চাচাদেরও এভাবে আসা। তখন থেকে বস্তিতে থাকতেন তারা।
থানার অপর পাশে কলপাড়া। সাধারণত এই কলের পানি সবার জন্য উন্মুক্ত। সোজা কথায়, 'পাবলিক কল'।
সদরঘাটের আশপাশের নিম্নবিত্তের সব মানুষের জন্য এই কল ছিল পানি পাওয়ার একমাত্র উৎস। কলপাড়া থেকেই তারা প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে যায় দীর্ঘকাল ধরে। এখন মোটর কল করা হলেও আগে ছিল 'ডিপকল' বা 'চাপকল'। পরে মানুষের সংখ্যার অনুপাতে পানির চাহিদা বাড়তে থাকলে মোটর কল স্থাপন করা হয়। ফলে কল থেকে পানি সংগ্রহ করা খুব একটা কষ্টের ছিল না ভাঁড়ওয়ালাদের জন্য। সকাল হলেই টিনের কৌটার ভাঁড় কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তারা। পানি ভর্তি করে দিয়ে আসতেন এ-দোকান ও-দোকান।
ইয়াকুবও বাবার সেসব কাজ দেখতেন মনোযোগের সাথে। জানতেন, একদিন তাকেও নামতে হবে এই পেশায়। সেই থেকে এই কাজে তার হাতেখড়ি। এখনো সমানভাবে এই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বয়স আটচল্লিশের আশেপাশে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সুখের সংসার।
ইয়াকুবের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। কাজের সুবাদে কোতোয়ালি থানার পাশেই বসবাস তার। ৩০ বছর ধরে ভাঁড়ে করে দোকানে দোকানে পানি দিয়ে আসার কাজ করছেন। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে কাজ। এই পুরো সময়জুড়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে তার অভাবের সংসার।
ভাঁড় হিসেবে টাকা
তবে এই আয়ে ছেদ পড়ে যায় মাঝেসাঝে। কারণ ইয়াকুবরা পানি দেন ফুটপাতের দোকানগুলোয়। প্রায় সময়ই পুলিশ এসে সেসব দোকানপাট তুলে দেয়। সে সময় তাদের পকেটের অবস্থারও বেহাল দশা হয়। 'এই যেমন আইজ যে চায়ের দোকানটা বইলো, কাল পুলিশ আইসা তুইলা দিল। তো সেদিন ইনকাম কইমা যায়,' বলেন ইয়াকুব।
ইয়াকুব দোকানে পানি দেন টিন বা ভাঁড় হিসেবে। এক টিনে পানি ধরে ১৫ কেজি করে। দুই টিন অর্থাৎ মোট ৩০ কেজি পানির বিনিময়ে তারা পান ২৫ টাকা। মাঝেমধ্যে সেটা ৩০ টাকাও হয়।
'আমরা দোকানে গিয়া জিজ্ঞেস করি, কত ভাঁড় পানি লাগবে? কেউ বলে দুই ভাঁড়, কেউ বলে তিন ভাঁড়। ওই হিসাবে পানি দেই,' যোগ করেন ইয়াকুব।
সকাল থেকেই চলে পানি দেওয়ার কাজ। ফুটপাতের নানারকম চা, খাবার, ফুচকা-চটপটির দোকানে দোকানে এভাবে পানি দিয়ে দিনে আয় করেন ৫০০-৭০০ টাকা। কখনো কখনো ৭০০ টাকার বেশিও হয়।
দায়িত্বের রদবদল
যেসব দোকানে পানি আনা-নেওয়ার কাজ করেন, সেসব দোকানির সঙ্গে আগেই চুক্তি করা থাকে ভাঁড়ওয়ালাদের। এমনকি প্রতিজনের জায়গা বা এলাকাও ভাগ করা থাকে। যেমন কেউ মোড়ের দক্ষিণ পাশে দিলে অন্যজন দেবেন উত্তর পাশের দোকানগুলোয়। এভাবে চলে কাজ। মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে জায়গাও পরিবর্তন করেন তারা।
আগে দলের সর্দার থাকতেন একজন। তিনিই ঠিক করতেন কার কোন এলাকা হবে, কে কোথায় কাজ করবে, এবং কার পরিবর্তে কে করবে। এখন অবশ্য আর সর্দার নেই। বিলুপ্ত এই প্রথা। তাই সবাই মিলেমিশে কাজ করেন। একে অপরের প্রয়োজনে বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত।
তবে এই কাজ তারা মাসের পুরোটা সময় ধরে করেন না। এখানেও আছে অভিনব এক নিয়ম। একজন ভাঁড়ওয়ালা কাজ করেন মাসের ১৫ দিন। বাকি ১৫ দিন থাকেন গ্রামের বাড়িতে। ওই ১৫ দিনের জন্য আর জায়গায় আসেন অন্য একজন। তিনিও এভাবে পনেরো দিন কাজ করে বাড়ি চলে যান। এভাবে হয় কাজের রদবদল।
তবে মাসের বাকি পনেরো দিন যে তারা বসেন থাকেন, তা কিন্তু নয়। বাড়িতে গিয়ে কৃষি কাজে যুক্ত হন। নিজেদের জমিতে কাজ তো রয়েছেই, আশপাশের কাজও করেন।
ইয়াকুবের মতো ভাঁড়ওয়ালাদের প্রায় সবার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। থাকেন একসাথে, একই রুমে। খাওয়াদাওয়াও হয় মিলেমিশে। সবাই সবার পরিচিত। তাদের সবার পূর্বপুরুষের পেশা ছিল এটি। ফলে তাদেরও এই পেশায় আসা।
বর্তমানে এই কাজে আছেন ১০-১২ জন। প্রায় সবাই ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কাজে আছেন। নতুনও অনেকে আসছেন এই পেশায়। তাদের কাজের বয়স ৭ কি ৮ বছর হবে। হয়তো আরও অনেকেই যুক্ত হবেন এ কাজে।
এমনই একজন মো: রতন। বয়স ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ। তিনিও ফরিদপুরের ভাঙ্গার লোক। থাকেন ইয়াকুবদের সাথে। আগে তার বাবা করতেন এই কাজ। এরপর চাচারা।
রতন জানালেন, তার দাদাও ছিলেন এই পেশায়। বাপ-দাদার এই কাজ তিনি শুরু করেছেন আট বছর হলো। চোখেমুখে কোনো অভিযোগ নেই তার। সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। ইতিমধ্যে এই কাজে পাকাপোক্ত করেছেন নিজেকে। দিন শেষে যা মেলে তাতেই তার স্বস্তি। আর দিন দুয়েক পরেই শেষ হবে তার ১৫ দিনের দায়িত্ব। ফিরতে পারবেন বাড়ি। জানালেন, বাকি ১৫ দিন গ্রামের বাড়িতে চাষাবাদের কাজ করবেন তিনি।
'অনেকেই ফজরের আজানের পরে কাম শুরু করে। আমি অত ভোরে আসি না। সকাল ৭টার দিকে আসি, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাম করি। কোনো কোনোদিন ৫০০ টাকা পাই, কোনো কোনোদিন এরচাইতে বেশি,' বলেন রতন।
১৫ টাকার টিন এখন ১০০ টাকা
এই কাজে তাদের প্রয়োজন হয় দুটি জিনিসের। বাঁশের লাঠি, আর তেলের টিন। এই পেশার শুরুর দিনগুলো থেকেই টিনের বড় এক কৌটায় করে পানি সংগ্রহের কাজ করতেন ভাঁড়ওয়ালারা।
তাদের ভাষ্যমতে, 'আমাদের বাপ-চাচারাও টিনের পটেই পানি ভর্তি করত। তারও আগে যারা পানি নিত, তারা কীভাবে নিত, সেটা আমরা জানি না। আগে মেয়েরাও পানি দিত। তারা কলস ভরে দিত।'
ইয়াকুবের কাছ থেকে জানা গেল, ৩০ বছর আগে দুটি টিনের কৌটার দাম ছিল ৩০ টাকা। অর্থাৎ একটার দাম ছিল ১৫ টাকা করে। এখন একটার দাম ১০০ টাকা। টিনের কৌটাগুলো কিনে আনেন সোয়ারীঘাট থেকে। প্রথমে তেলের টিনগুলো ভালোমতো পরিষ্কার করে নিতে হয় তাদের। পানি ভরার জন্য ওপরের দিকের কোনায় ছিদ্র করতে হয়। এরপরই ব্যবহারোপযোগী হয় সেগুলো।
কমে যাচ্ছে আয়
আগেরদিনে ভাঁড়ওয়ালাদের আয় ছিল বেশি। দিনে হাজার টাকা পর্যন্ত পেতেন তারা। তখন অবশ্য পুরো বাংলাবাজারজুড়ে তারাই ছিলেন পানি আনা-নেওয়ার একমাত্র উৎস।
শুধু কলের পানি নয়, আগে বুড়িগঙ্গার পানিও দিতেন তারা। ধোয়া-মোছা কিংবা কারখানায় কাপড়ে রঙ করার জন্যেও তাদের থেকে পানি নিতেন সবাই।
দিন পাল্টেছে এখন। বোতলে করে ওয়াসার পানি চলে যায় দোকানে দোকানে। এই কারণে আয় কমছে ভাঁড়ওয়ালাদের। এমনকি দোকানিরাও কয়েকটা টাকা বেশি দিতে নারাজ।
এখন যারা আছেন, তারা শুধু কলের পানিই দেন। তাদের বেশিরভাগ গ্রাহক এখন চায়ের দোকানগুলো। তবে যখন শুরু করেছিলেন, তখনকার তুলনায় টাকার অঙ্কে আয় বেড়েছে ঠিক। কিন্তু জীবন-যাত্রার মান বেড়েছে, এ কথা বলা মুশকিল।
৩০ বছর আগে ইয়াকুবরা এক ভাঁড় পানির জন্য পেতেন ২ টাকা। এখন পান ২৫ টাকা। তবু তাদের মুখে আগেরদিনে ভালো থাকার গল্পই উঠে আসে বারবার। তখন তাদের ক্রয়ক্ষমতা ছিল। সাধ্যের মধ্যে কিনতে পারতেন সুখ। এখন আর তা পারেন না।
ঢাকায় নিজেদের খরচ চালিয়ে পরিবারের ঘানি টাকা বেশ কষ্টসাধ্য বলেই জানান ইয়াকুবরা। তবে বাস্তবতা হলো, প্রতিদিন এই পানির বিনিময়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে ভাঁড়ওয়ালাদের সংসার।