অ্যাঙ্গোলায় ইঁদুর যেভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছে: মাইন শনাক্ত করে চাষাবাদের উপযোগী করছে জমি
'সামনে সাপ পড়ে গেলে ভড়কে যাবেন না, শান্ত হয়ে ওটা চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।' প্যারামেডিক হোয়াও এদুয়ার্দোর পরামর্শ শুনে আঁতকে উঠলাম। ভয় পাওয়ার কারণ, এ অঞ্চলে ভাইপার, গোখোঁড়া আর ভয়ানক ব্ল্যাক মাম্বা সাপ আছে এন্তার।
তবে এই শুষ্ক, বৃক্ষবিরল অঞ্চলে আসল বিপদ মাটির ওপরে বিপজ্জনক প্রাণীগুলো নয়, প্রকৃত বিপদ ওত পেতে আছে ভূগর্ভে। মাটির নিচে কয়েক মিটার পরপর, কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছাড়াই, পুঁতে রাখা হয়েছে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন।
১৯৭৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে যায় আফ্রিকার দেশ আঙ্গোলা। সে যুদ্ধের পর থেকেই আছে এসব মাইন। এই মাইনে গুরুতর আহত হয়েছে এবং হচ্ছে বহু মানুষ, প্রাণও গেছে অনেকের। তাই দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা একদল কর্মী আন্তর্জাতিক সহায়তায় এসব বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় ও অপসারণের কাজ করছে—যাতে মাইনমুক্ত করা জমিগুলো স্থানীয়দের জন্য আবাদি জমিতে পরিণত করা যায়।
সাপের সরীসৃপের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে যেখানে, সে জায়গায় ওত পেতে থাকা বিপদ, যেমন মিসাইল বা শ্র্যাপনেল সরাতে জমি পরিষ্কারের কাজ করছে জাপানি ও বেলজিয়ান তহবিলে পরিচালিত এনজিও আপোপো। আর এ কাজে দলের সদস্যরা মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহারের পাশাপাশি নিচ্ছেন বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ইঁদুরের সাহায্যও।
আপোপোর মুখপাত্র লিলি শালোম বলেন, এই 'নায়ক ইঁদুর' নামে পরিচিত সাউদার্ন জায়ান্ট পাউচড ইঁদুর অত্যন্ত 'গুরুত্বপূর্ণ' ভূমিকা রাখে। প্রাণীটি বিস্ফোরক যন্ত্রপাতির গন্ধ শনাক্ত করতে পারে। আবার এ ইঁদুরের ওজন কম হওয়ায় তাদের দেহের ভারে বিস্ফোরক যন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠার ঝুঁকি নেই। এই 'বিশেষ' জীবন্ত যন্ত্রের সাহায্যে আপোপো আরও নিখুঁতভাবে মাইন শনাক্ত করতে পেরেছে।
লিলি শালোম এল পাইসকে বলেন, 'এখন আমাদের প্রায় ১১০টি ইঁদুর গন্ধ শুঁকে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন খুঁজে বের করছে। এই ইঁদুরগুলো ক্রাইসেটোমিস অ্যানসোর্গেই (Cricetomys ansorgei) প্রজাতির। আকারে বড়, সর্বভুক। মূলত নিশাচর এবং গর্তবাসী। এদের মাথা ও শরীরের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার, লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার। সব মিলিয়ে এই ছোটখাটো নায়কদের ওয়জন ১ থেকে ২ কেজি।'
আপোপো ১০ সপ্তাহ বয়স থেকে এই ইঁদুরকে প্রশিক্ষণ শুরু করে। টিএনটির গন্ধকে কলা বা বাদামের মতো খাবারের সাথে মেলাতে শেখানো হয় এদের।
এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের মূল ভাবনাটি এসেছিল আপোপোর প্রতিষ্ঠাতা বার্ট উইটজেন্সের মাথা থেকে। তার মাথায়ই প্রথম এই প্রাণীকে বিস্ফোরক শনাক্ত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা আসে। এ ইঁদুরকে ল্যান্ডমাইন শনাক্তের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
প্রথমে ২০০৩ সালে মোজাম্বিকে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে পরীক্ষা চালানো হয়। এতে দারুণ ফলাফল পাওয়া যায়। এরপর থেকে গত ২০ বছরে অ্যাঙ্গোলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার হেক্টর জমি থেকে বিস্ফোরক যন্ত্রপাতি সরাতে সহায়তা করেছে জায়ান্ট পাউচড ইঁদুর।
অ্যাঙ্গোলার কেন্দ্রস্থল লিবোলো শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে ঘন ক্যানভাসের তাঁবু ও সামরিক স্টাইলের বেজ কম্ব্যাট বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণকারীদের উপস্থিতি জানান দেয়। ওই দলের প্রধান আয়ারোঁ ডস সান্তোস জানান, 'আমরা ইতিমধ্যে ২২টি মাইন শনাক্ত করেছি। অপসারণ করেছি আটটি।'
লম্বা ওভারঅল ও প্লাস্টিকের মাস্ক দিয়ে তৈরি সুরক্ষা ইউনিফর্ম পরে এই মাইনফিল্ডে প্রবেশ করতে হয়। পথে তিনটি রঙের চিহ্ন দেওয়া খুঁটি পোঁতা দেখলাম। লাল রঙের খুঁটির অর্থ সেখানে মাইন রয়েছে; খুঁটিতে হলুদ থাকার অর্থ আগে এখানে মাইন ছিল; এবং খুঁটিতে সাদা রং থাকার অর্থ জায়গাটি নিরাপদ।
মাইন নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়বহুল। এই বিস্ফোরক যন্ত্রের দাম খুব কম হলেও এগুলো নিষ্ক্রিয় করতে ব্যাপক হ্যাপা পোহাতে হয়। এ কাজের জন্য প্রতিটি এলাকাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলতে হয়, তারপ মেটাল ডিটেক্টর চালাতে হয় অনুসন্ধান। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মাটি খোঁড়াতে হয়। শেষে বিস্ফোরক যন্ত্রগুলো হয় বের করে নেওয়া হয় অথবা বিস্ফোরিত করে ফেলতে হয়, যাতে আশপাশে কোনো ক্ষতি না হয়।
এছাড়া আশপাশের শহরগুলোতে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। ৩৭ বছর বয়সি হোয়াও এদুয়ার্দো জানালেন, 'কয়েক দিন আগে এক কৃষাণী একটা মাইনে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। বিস্ফোরণে তার দুই পা উড়ে যায়।'
কিছু জমি খুঁটি ও প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। দূর থেকে ওই জমিগুলোতে জায়গায় জায়গায় পোঁতা বিস্ফোরক চোখে পড়ল। ডোস সান্তোস বললেন, হেন জায়গা নেই যেখানে বিস্ফোরক পোঁতা হয়নি।
পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর অ্যাঙ্গোলার ক্ষমতা দখলের জন ২৭ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয় ও বিদেশী গোষ্ঠী লড়াই করেছে। তারা সবাই এসব বিস্ফোরক পুঁতেছে জমিতে।
সেই গৃহযুদ্ধের ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে অ্যাঙ্গোলা। মাটির তলায় শুধু অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইনই থেকে যায়, পথের পাশে পড়ে আছে মাটি অর্ধেক পোঁতা বাতিল ট্যাংক।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তথ্যমতে, অ্যাঙ্গোলার জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।
হোয়াও এদুয়ার্দো বলেন, 'এখনও আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। তবে এর মধ্যেই আমরা সামনে এগিয়েছি। … শান্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।'
২৫ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে নয়জন মানুষ জমিতে বিস্ফোরকের সন্ধান করছেন। একটি মেটাল ডিটেক্টর মাটি স্পর্শ করতে করতে এগোচ্ছেন তারা; অ্যালার্ম বেজে উঠলেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। মেটাল ডিটেক্টর বিপ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ৪০ বর্গ সেন্টিমিটারের মতো জায়গা টেপ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার পর সরানো হয় এ ঘেরাও। বা ধ্বংসের জন্য যথাযথ উপকরণ দিয়ে কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত অটুট থাকবে
আর ইঁদুর দিয়ে কাজটি করা হলে প্রাণীগুলো গানপাউডারের গন্ধ শুঁকে জায়গা চিহ্নিত করে।
যত্রযত্র পোঁতা হয়েছে মাইন। এসব জমি পরিষ্কার করার জন্য বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন। এই সহায়তা আসে দেশ থেকে। আপোপো ২০১৩ সালে আঙ্গোলায় মাইন সরানোর কাজ শুরু করে। এ পর্যন্ত তারা 'নিরাপদে' ৩০৬টি ল্যান্ডমাইন, ৭১৪টি বিস্ফোরকের অবশিষ্টাংশ এবং ৭ হাজার ৮৮০টি ছোট অস্ত্র ও গুলি অপসারণ করেছে। শালোম বলেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদে 'অঙ্গহানি, গুরুতর দগ্ধ, এমনকি মৃত্যুও' হয়েছে।
আঙ্গোলার দীর্ঘ বর্ষা মৌসুম ও ঘন গাছপালা মাইন অপসারণের কাজ আরও কঠিন করে তোলে বলে জানান তিনি।
লোম আরও বলেন, মাইন অপসারণ কার্যক্রম আক্রান্ত অঞ্চলে 'বিশ্বাস ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে অপরিহার্য'। বিস্ফোরক সরানোর ফলে মানুষ যে শুধু ঝুঁকিমুক্ত হয় তা-ই নয়, সেইসঙ্গে বিপদের বধ্যভূমিগুলো ফের কৃষিজমিতে পরিণত করা সম্ভব হয়।
শালোম জানান, তাদের প্রচেষ্টায় বেশ অনেকটা জমি ফের বসবাস এবং চাষাবাদের উপযোগী হয়েছে। আপোপোর মাইন অপসারণকারী দল গত এক বছরে কুয়াঞ্জা সুল প্রদেশ ও ইবো শহরে ৭৪টি মাইন খুঁজে পেয়েছে, এবং ৯ লাখ ২১ হাজার ২৩২ বর্গমিটার জমি পরিষ্কার করেছে।
ডোস সান্তোস জানালেন, তিন মাসে তার দল প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার বর্গমিটার জমি পরিষ্কার করেছে। আপোপো জানিয়েছে, এই কার্যক্রমের ফলে অ্যাঙ্গোলার বিভিন্ন অঞ্চলে ফের কৃষিকাজ শুরু করা গেছে। মোট ২৩ হাজার কৃষক পরিবার সরাসরি এবং ৮০ হাজার পরিবার পরোক্ষভাবে এ কার্যক্রমের সুফল পেয়েছে।
লিবোলোর এ অঞ্চলের জমিতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সবজির চাষ করা হয়েছে। ৩৬ বছর বয়সি কৃষক আন্তোনিও ব্যারিস্টো প্রায় ২৩৬ মাইল দূরের এলাকা হুয়াম্বো থেকে এখানে এসে কৃষিকাজ করছেন। ছয় সন্তানের জনক ব্যারিস্টো এখন এই মুক্ত জমিতে চাষাবাদ করতে পেরে খুশি।
আপাতত কৃষকরা এ অঞ্চলে শুধু টমেটো, পেঁয়াজ ও মরিচ চাষ করবেন। গত দুই বছর ধরে দেশটির বিভিন্ন বাগান তদারকি করা একজন কিউবান কৃষি প্রকৌশলী বলেন, অ্যাঙ্গোলা ফসলের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে কফি, কাসাভা, আলু, বিন এবং স্ট্রবেরি, তরমুজ, বা কলা-জাতীয় ফল ভালো ফলে।
অ্যাঙ্গোলার মানুষের আশা, শীঘ্রই গোটা দেশের মাটি থেকে বিস্ফোরক সরানো সম্ভব হবে।
- ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ