অতিরিক্ত ডাব বিক্রি: নারিকেল সংশ্লিষ্ট ৫ শিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ডাব যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জনৈক ব্যবসায়ীর মতে, এই ডাবের বাজারমূল্য কমপক্ষে ৭০-৮০ লাখ টাকা।
ডাব ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মীপুরে স্থানীয়ভাবে ডাব সংগ্রহ করে সারা দেশে রপ্তানি করে। তবে সবচেয়ে বেশি ডাব যায় ঢাকার যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা ও কারওয়ান বাজারের আড়তে।
গরমকালে সারা দেশেই ডাবের চাহিদা থাকে। আর বিপুল এই চাহিদার কারণে বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায়। ফলে বেশি দামে ডাব বিক্রি হওয়ায় লক্ষ্মীপুরের কৃষকরা গাছ শূন্য করে ফেলছেন। প্রতিদিন ট্রাক বোঝাই করে ডাব চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
এতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে নারিকেল সংশ্লিষ্ট শিল্পে। সবুজ ডাব পরিপক্ক নারিকেলে পরিণত হওয়ার পর সেই নারিকেল থেকে পাঁচ ধরনের পণ্য তৈরি হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, গাছেই ডাব বিক্রি হয়ে যাওয়ার কারণে নারিকেলের উৎপাদন কমে গেছে। নারিকেল সংকট দেখা দিয়েছে নারিকেল তেল উৎপাদন শিল্পে। এর সঙ্গে ক্ষতির মুখে পড়েছে নারিকেলজাত পণ্য, যেমন- ছোবড়া শিল্প, মশার কয়েল ফ্যাক্টরি, কোকোডাস্ট এবং মালা শিল্প।
এরইমধ্যে লক্ষ্মীপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলেও উল্লেখিত নারিকেল কেন্দ্রিক ৫টি শিল্পে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) লক্ষ্মীপুরের নারিকেলের জন্য বড় বাজার হিসেবে পরিচিত হায়দরগঞ্জ, দালালবাজার, পানপাড়া এবং মিরপুর এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী, কারখানা মালিক, শ্রমিক এবং চাষীদের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, নারিকেলের অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বেশ কিছু কারখানা। ফলে কয়েক হাজার মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুর উপজেলায় ৮টি ছোবড়া মিল এবং আরও ৩টি নারিকেল প্রসেসিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে নারিকেল না পাওয়ায়। এসব মিলের প্রত্যেকটিতে নারী-পুরুষ মিলে প্রতিদিন অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করতেন। পুরো জেলায় এ রকম মিল রয়েছে ২৩টি।
কারখানা শ্রমিক সেলিম জানান, নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে জাজিম, পাপোস, রশি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের সৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়। বেডিং শিল্পেও ছোবড়ার ব্যবহার রয়েছে।
তিনি আরও জানান, নারিকেলের মালা বা কোকোনাট শেল একটি বাই প্রোডাক্টস। নারিকেলের মালা ব্যবহার করে মশার কয়েলসহ অনেক রকম পণ্য তৈরি হয়।
নার্সারির মালিক মো. আনোয়ার জানান, মাটি ছাড়া শাকসবজির চাষের জন্য কিংবা ছাদ বাগানের জন্য কোকোমাস ও কোকোডাস্ট তৈরি করা হয় ছোবড়া থেকে। তারাও ছোট চারা উৎপাদনের জন্য এখন মাটির পরিবর্তে কোকোডাস্ট ব্যবহার করেন।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীতে ২টি নারিকেল তেল মিল রয়েছে। শিল্প নগরীরর সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহরিয়ার ইসলাম খান জানিয়েছেন, ওই কারখানাগুলো নারিকেলের অভাবে প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।
নারিকেল উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের নারিকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানান, কোমল পানীয় হিসেবে অতীতে সব সময়ই কম বেশি ডাবের চাহিদা ছিল। কিন্ত করোনা প্রাদুর্ভাবের পর দেশব্যাপী প্রচুর পরিমাণে ডাবের চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর ডাবের দাম বেড়ে যাওয়ায় নারিকেল হওয়ার আগেই চাষীরা গাছ শূন্য করে ফেলছেন ডাব বিক্রি করে। এতে নারিকেল উৎপাদন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে, আগে শুধু রাস্তার পাশে ডাবের দোকান দেখা যেত; এখন ফলের দোকান ও সুপার চেইন শপগুলোতেও ডাব পাওয়া যাচ্ছে।
হায়দরগঞ্জের ব্যবসায়ী ইউছুপ জামান জানান, রায়পুরের চর বংশী ইউনিয়ন থেকে আগে তিনি প্রতিদিন প্রায় ১০-১৫ হাজার নারিকেল ক্রয় করতেন। কিন্তু গত এক বছর যাবত সেখান থেকে একটি নারিকেলও আসে না। উল্টো প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার ডাব বিক্রি হয়ে যায়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের নারিকেল চাষী রহমান (৪০) জানান, বর্তমানে প্রতিটি নারিকেল বিক্রি হচ্ছে ২৭-৩০ টাকায়। কিন্তু প্রতিটি ডাব বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়।
'যেখানে একটি ডাব উৎপাদনে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দুই মাস। সেখানে একটি নারিকেল উৎপাদনে সময় লাগে কমপক্ষে ৪ মাস। আবার দামও কম। তাই কৃষকরা এখন ডাবই বিক্রি করে দিচ্ছেন,' বলেন তিনি।
ডাব ব্যবসায়ী মো. আবদুল কাদের জানান, তিনি প্রতিদিন ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার ডাব পাঠান। জেলাব্যাপী তার মতো আরও প্রায় ২০ জন ডাব ব্যবসায়ী রয়েছেন।
ডাব ব্যবসায়ী মো: শিপন জানান, লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত দুই লাখ ডাব বিক্রি হচ্ছে। যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ৭০-৮০ লাখ টাকা।
এদিকে, গত বছর লক্ষ্মীপুর থেকে প্রায় সাড়ে তিশ কোটি টাকার নারিকেল বিক্রি হয়েছিল, তবে গত বছর শুধু ডাবই বিক্রি হয়েছে ৪শ কোটি টাকার বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তা আবুল হোসেন।
তিনি আরও জানান, দেশে নারিকেল উৎপাদনকারী জেলার মধ্যে লক্ষ্মীপুর অন্যতম। এ জেলা বিগত বছরগুলোয় বছরে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার নারিকেল বিক্রি করেছে।