ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা পুতিনকে সন্তুষ্ট করবে: ট্রাম্পের বিশেষ দূত
যুক্তরাষ্ট্রের নন-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিথ কেলগকে ইউক্রেন-রাশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত করেছেন। ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল চ্যানেলে একটি পোস্টের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়েছেন, কীভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হতে পারে।
পোস্টে তিনি বলেন, "আমি খুবই আনন্দিত, কারণ আমি জেনারেল কিথ কেলগকে প্রেসিডেন্টের সহকারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত করেছি। আমরা একসঙ্গে শক্তির মাধ্যমে শান্তি অর্জন করব এবং আমেরিকা ও বিশ্বের নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করব।"
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য একটি নির্দিষ্ট শান্তি পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যা কেলগ এপ্রিল মাসে 'আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউট' এ উপস্থাপন করেছিলেন।
কেলগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি দিয়ে ফ্রন্টলাইন স্থগিত করা হবে এবং উভয় পক্ষকে আলোচনা করতে বাধ্য করা হবে। তিনি এই যুদ্ধকে "এড়ানো যায় এমন সংকট" বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, বাইডেন প্রশাসনের অদক্ষ নীতির ফলে এটি আমেরিকাকে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে।
এটি একটি বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে, যেহেতু শান্তির পথ অনেক জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে।
কেলগের পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিবর্তন
কেলোগের পরিকল্পনায় বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনার পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়েছে । পরিকল্পনায় কেলগ বলেন, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সহায়তা যথেষ্ট দেরিতে দিয়েছে।
তার মতে, ট্রাম্পের ২০১৮ সালে ইউক্রেনকে প্রথমবারের মতো লিথাল এইড (বিদ্ধ্বংসী অস্ত্র) দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুতিনকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চারিত করেছিল। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের নরম দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাইডেনের মতো পুতিনকে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন না করা তাকে একটি সফল শান্তি চুক্তি করতে সাহায্য করবে।
কেলগ আরও বলেন, রুশ আক্রমণের আগে এবং পরপরই আরও বেশি অস্ত্র সরবরাহ করা উচিত ছিল, যাতে ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ী হতে পারে।
কিন্তু পরিকল্পনার যে অংশটি ইউক্রেনের পছন্দের নয় তা হলো, আমেরিকা আর কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না এবং ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের মজুদ কমে যাও। এটি চীনের সাথে সম্ভাব্য তাইওয়ান সম্পর্কিত যুদ্ধে আমেরিকাকে বিপদে ফেলতে পারে।
কেলগের মতে, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ স্থগিত করা উচিত এবং "একটি ব্যাপক এবং যাচাইযোগ্য শান্তি চুক্তি"র বিনিময়ে এটি করা উচিত।
পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক নীতি হিসেবে শান্তিচুক্তির প্রতি আগ্রহী হওয়া এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা।
ভবিষ্যতের ইউক্রেনকে মার্কিন সহায়তা হিসেবে সম্ভবত ঋণ দেওয়া হবে। কিন্তু তা ইউক্রেনের রাশিয়ার সাথে আলোচনার ওপর নির্ভর করবে এবং আমেরিকা কেবলমাত্র ইউক্রেনকে ততটুকু পরিমাণ অস্ত্র সহায়তা দেবে, যতটুকু তারা নিজেদের রক্ষা করতে এবং শান্তিচুক্তির পরে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে ব্যবহার করতে পারে।
২০২৩ সালে রিচার্ড হাস এবং চার্লস কাপচানের একটি প্রবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কেলগ এই পরিকল্পনায় কিছু অংশ যুক্ত করেছেন।
শান্তি পরিকল্পনায় ফ্রন্টলাইন স্থগিত রাখার প্রস্তাব
কেলগের শান্তি পরিকল্পনায় ফ্রন্টলাইন স্থগিত রাখতে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে এবং একটি বেসামরিক জোন স্থাপন করা হবে। এর বিনিময়ে, রাশিয়া সীমিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে এবং সম্পূর্ণ শিথিলতা তখনই পাওয়া যাবে, যখন ইউক্রেনের পক্ষে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির ওপর একটি শুল্ক আরোপ করা হবে, যা ইউক্রেনের পুনর্গঠন তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
ইউক্রেনকে দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম থামাতে বলা হবে না, তবে তা কেবল কূটনৈতিক উপায়ে অর্জনের জন্য সম্মত হতে হবে। তবে এটি একটি কূটনৈতিক সাফল্য দাবি করে, যা হয়ত পুতিনের ক্ষমতা ছাড়ার আগে ঘটবে না।
যদিও পরিকল্পনাটি সহজ এবং দ্রুত, এটি রাশিয়ার পূর্বের অভ্যাসকে উপেক্ষা করেছে, যেখানে তারা আগের শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে।
নিরস্ত্রীকৃত এলাকা কার্যকরভাবে রক্ষা করা কঠিন হবে এবং সম্ভবত ন্যাটো বা নিরপেক্ষ বাহিনীকে এসব অঞ্চলগুলিতে অবস্থান করতে হবে। ইউক্রেনকে যথাযথভাবে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে আরও অস্ত্র দেওয়ার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং, কারণ বর্তমানে সংস্থাগুলো ইউক্রেনের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দিতে সক্ষম নয়।
ইউক্রেনকে যতটা সম্ভব রাশিয়ার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করাও কঠিন হবে।
কেলোগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র মাসে ১ কোটি ৪০ লাখ ১৫৫ মিমি কামানের গোলা তৈরি করে। ইউক্রেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় এটি শেষ করে ফেলবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেলগ ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র সরবরাহ করতে চান। তবে তিনি স্বীকার করেন, আসলে এটি সম্ভব নয়।
মূল্যবোধের পরিবর্তন
পরিকল্পনায় আমেরিকার বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাইডেনের উদার আন্তর্জাতিক নীতির সাথে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তার বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করা হয়েছে।
বাইডেনের নীতি পশ্চিমা মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয়। কেলগ মনে করেন, ইউরোপীয় নিরাপত্তায় সমঝোতা করার জন্য একটি কঠিন ভিত্তি।
এই পরিকল্পনাটি রাশিয়ার সাথে একটি প্রক্সি যুদ্ধের সম্ভাবনা তুলে ধরে, যা পরবর্তীতে পারমাণবিক সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে। এতে যুক্তি দেখানো হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে এমন কিছু মূল্যবোধ কাজ করছে, যা হয়ত স্থায়ী করার যোগ্য নয় এবং আমেরিকার পারমাণবিক উত্তেজনা থেকে পিছু হটে যাওয়া উচিত।
এই পরিকল্পনা ইউক্রেনের জন্য শান্তির একটি সম্ভাব্য পথ দেখাচ্ছে, বিশেষ করে যখন দেশটি সৈন্য সংকট এবং হারানো ভূমির সমস্যার সম্মুখীন।
তবে যুদ্ধবিরতির সুযোগ এবং পশ্চিমাদের ক্লান্তি পুতিনের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে। পরিকল্পনাটি পশ্চিমের অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এবং পশ্চিমা মূল্যবোধের অকার্যকরতা স্বীকার করে।
যদিও এই পরিকল্পনা সাময়িকভাবে সহিংসতা বন্ধ করতে পারে, তবে এটি সংঘাতের সমাধান নাও হতে পারে। বরং এটি একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে, যেখানে পশ্চিমা ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পুতিন তার কূটনৈতিক এবং সামরিক লক্ষ্য অর্জনের দিকে আরও এগিয়ে যাবেন।