চরম জলবায়ু বছরের প্রথমার্ধ্বেই বাস্তুচ্যূত করেছে রেকর্ড ৭ মিলিয়ন মানুষকে
এ বছরের মে মাসে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ফুঁসে ওঠা ফনীর ভয়াল রূপ দেখবার আতঙ্ক আমাদের তাড়া করেছিল। আমাদের মনে আছে গত শতকের অসংখ্য ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর ভেসে যাওয়ার ছবি। মন থেকে মুছে যায়নি লাখো মানুষের বিপন্নতা আর মৃত্যুর মিছিলের স্মৃতি।
গত শতকের সত্তরের নভেম্বরে ভোলার উপকূলে আঘাত হানা ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। ভাবা যায়?
এর বাইরেও উইকিপিডিয়া ঘাঁটলে দেখা যাবে, গত কয়েকশ’ বছরে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এ অঞ্চলে ফি বছর ঘটে যাওয়া ঝড়গুলো কেড়ে নিয়েছে কয়েক লাখ প্রাণ।
আমরা জানি, এবার ফনী সেভাবে ছোবল দিতে পারেনি। অথবা দিতে চাইলেও সফল হয়নি। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারগুলো আগেভাগেই সাবধান ছিল। তিন থেকে চার মিলিয়ন মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ফনীর আঘাত হানার জায়গাগুলো থেকে। ফলে মাত্র শ’খানেক লোকের মৃত্যুর খবর এসেছে দেশ দুটো থেকে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মে মাসে ভারত-বাংলাদেশের ওপর ফনীর আঘাতের সময় প্রশাসনের সতর্কতার বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আগেভাগে ব্যবস্থা নিয়ে লাখো মানুষকে সরিয়ে নেওয়ায় অনেক মৃত্যু এড়ানো গিয়েছে।
তবে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের শিকারদের সরিয়ে নেওয়ার ফলে আপাতত তারা রক্ষা পেলেও, বিশ্বজুড়ে সব ধরনের দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টি ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’ ২০০৩ সাল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর বিষয়ে ডাটা সংগ্রহ করে রিপোর্ট তৈরি করে আসছে। এ বছরের প্রথমার্ধ্বের নানা দেশের দুর্যোগ ৭ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যূত করেছে, তাদের রিপোর্টে পাওয়া গেছে সে তথ্য। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ছিল এ রিপোর্ট।
প্রকৃতির খেলায় নিজ ঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের এই সংখ্যা গত বিশ বছরের যে কোনো প্রথমার্ধ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রের বাহামা দ্বীপপুঞ্জে ডোরিয়ানের আঘাত সাম্প্রতিক ঘটনা—বছরের দ্বিতীয়ার্ধ্বের। কিন্তু ডোরিয়ানের ছোবলের আগেই বিশ্বজুড়ে যেসব দুর্যোগ ঘটেছে তার ফলেই এত এত মানুষ ঘরহারা হলেন!
আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটি (‘দ্য ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’) যে রিপোর্ট তৈরি করেছে সেখানে তারা সরকার, জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো ও পত্রপত্রিকার রিপোর্ট ব্যবহার করেছে। এগুলো থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত নিয়ে তারা জানাচ্ছে যে, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের মতো দুর্যোগের ফলে অস্থায়ীভাবে নিজ নিজ এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন এই মানুষেরা।
সবচেয়ে ভাবনার হল, এটা এখন প্রায় স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ বাড়বে আর তাতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ সাজানো পরিপাটি গৃহস্থালী হারিয়ে অন্যত্র ঠাঁই নেবেন।
তথ্যগুলো একদিকে যেমন খারাপ তেমন খানিকটা ভালো দিকও রয়েছে এর। বিজ্ঞানীরা তো বহুদিন ধরে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে দুর্যোগপ্রবণ এশীয় শহরগুলোতে বিশেষ করে লাখো মানুষ প্রকৃতির খেয়ালের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছেন।
কিছু দেশ আগে থেকেই দুর্যোগের ঘনঘটার মধ্যে স্থানীয়দের সরিয়ে নিয়ে আপৎকালীন আশ্রয়স্থলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমাচ্ছেন। ফনীর বেলায় যেমনটা হয়েছে। কিন্তু আফ্রিকার দক্ষিণাংশে গত মার্চে আঘাত করেছিল ইদাই— যাতে মারা গিয়েছেন হাজারেরও বেশি মানুষ। মোজাম্বিক, মালাওয়ি, জিম্বাবুয়ে ও মাদাগাস্কারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই ঝড়ে বাস্তুচ্যূত মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ১৭ হাজারের বেশি।
ইরানে গত মার্চ ও এপ্রিলে সেখানকার বিশাল সমভূমি এলাকায় দেখা দিয়েছিল বন্যা। ৫ লাখ মানুষকে তখন অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নিতে হয়। ওদিকে, বছরের প্রথম চার মাসে দক্ষিণ আমেরিকান দেশ বলিভিয়ায় ভারী বৃষ্টি থেকে বন্যা ও ভূমিধস দেখা দেয়। তাতে ৭০ হাজার মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়।
প্রকৃতির রুদ্ররূপের বাইরে মানুষের ঘরহারা হবার বড় কারণ স্থানীয় নানা ধরনের সংঘাত ও সহিংসতা। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এ বছরের প্রথম ছ’মাসে দুর্যোগের কারণে ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা সংঘাত-সহিংসতার শিকার হয়ে ঘরছাড়াদের প্রায় দ্বিগুণ।
‘দ্য ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’-এর ডিরেকটর আলেকজান্দ্রা বিলাক নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, “জলবায়ু পরিবর্তনের যা অবস্থা তাতে পরিস্থিতি গুরুতরই হতে থাকবে। যে দেশগুলো বারবার এসবের শিকার হচ্ছে তাদের যদি এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়, অন্তত একই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতেই হবে।”
কিন্তু আরও বড় বিপদের আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে বলেই মনে করছে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুর্যোগের প্রাবল্য থাকে। বিশেষত ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতে। তাই দুর্যোগে মানুষের ঘরহারা হবার সংখ্যা এ বছর ২২ মিলিয়নে পৌঁছুবে বলে কেন্দ্রটি ধারণা করছে।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনায় স্থানচ্যূতি কয়েক মাসব্যাপীও হতে পারে। তবে সাধারণত এটি ভুক্তভোগীদের নিজ দেশের সীমানার মধ্যেই ঘটে থাকে।
রিপোর্টে যে সংখ্যাগুলো উঠে আসছে তা নিয়ে একটু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমনিতে যেসব দুর্যোগের মুখোমুখি মানুষ প্রতিদিনই হচ্ছে—যেমন, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বা তাপমাত্রার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোও মানুষকে বাস্তুচ্যূত করছে। এমনকি পরপর কয়েক বছর ফসল ভালো না পেলেও মানুষ বাক্সপেটরা গুছিয়ে আরও সচ্ছন্দে কোথাও থাকার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে। সমস্যা হল, রাজনৈতিক কারণে এসব ঘটনায় সরকারগুলো সাধারণত সঠিক ডাটা-পরিসংখ্যান তৈরি বা সরবরাহ করে না।
জাতিসংঘের একটি গবেষণা সংস্থার নাম ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান সিকিউরিটি। সেখানে জলবায়ু-উদ্ভূত বাস্তুচ্যুতি নিয়ে কাজ করেন কিস ভ্যান ডার জিস্ট। তিনি মনে করছেন, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটির প্রদত্ত এই হিসাবের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এটি এ যাবত পাওয়া সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসাব। তিনিও মনে করছেন, এখানে বাস্তুচ্যুতির যে হিসাবগুলো রয়েছে তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কমই হবে।