আলী খামেনি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কখনো কি সাক্ষাৎ হবে?
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে চারটি মূল স্লোগানে পরিচালিত হচ্ছে ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র; এগুলো হলো - আমেরিকা ও ইসরায়েল ধ্বংস হোক, ইসলামী বিপ্লব অন্যত্র রপ্তানি করো, আর পর্দা করো – নয়তো দুর্ভোগ পোহাও (নারীদের প্রতি নিপীড়নমূলক পর্দা তথা হিজাব নীতি)। কালক্রমে এগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সংশোধন করা হয়েছে, নয়তো বাস্তবায়নের শক্তি-সামর্থ্যও হ্রাস পেয়েছে; তবু ইরান পুরোপুরি এই মূল নীতিগুলো পরিত্যাগ করেনি। কারণ এসব ছাড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অবশিষ্ট কী থাকবে – এমন প্রশ্ন তুলে থাকেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সমর্থকরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও ছাড় দেওয়ার বান্দা নন। ট্রাম্প যখন ২০১৭ সালে প্রথম দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর সাথে ইরানের সংঘাতে জড়ানোর কথা ছিল না। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জেসিপিওএ' চুক্তির সংশোধন চেয়েছিলেন ট্রাম্প। কারণ তাঁর পূর্বসূরী বারাক ওবামার আমলে করা এই চুক্তি আলোচনার সময়ে ইরানকে বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে ট্রাম্প দাবি করেন। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান সমর্থিত প্রক্সি সংগঠনগুলোকেও দুর্বল করতে চেয়েছিলেন, তবে তিনি সবচেয়ে যা বেশি চেয়েছিলেন– তা হচ্ছে খোমেনির সাথে বৈঠক ও একসাথে ছবি তোলার সুযোগ, যেমনটা পেয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বেলায়।
ট্রাম্প বিশ্বনেতা হতে কতোটা ব্যাকুল ছিলেন— যদি ইরানের শাসকগোষ্ঠী তা বুঝতো, তাহলে খোমেনি তেহরানে আমন্ত্রণ জানাতেন ট্রাম্পকে, স্বাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বিবাদ মেটানো যেত অনেকটাই। যার সুফল পেয়ে সমৃদ্ধ হতো ইরানের অর্থনীতি, থাকতো না নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। কিন্তু, সামনে এগোনোর পথে বাধা হলো অতীত ইতিহাস। ইরানের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় ক্ষমতায় রয়েছেন খামেনি, তবু খোমেনীর ভূত তিনি মাথা থেকে নামাতে পারেননি। ফলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কোনো ধরনের বার্তা আদান-প্রদানেরও যোগ্য নন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের দর্শন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ধমক দেওয়ার অধিকার কেবল তাঁরই, ইরান কেন পাল্টা-জবাব দেবে। ফলে তেহরানের সাথে ওয়াশিংটনের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় সংঘাতের দিকে হাঁটতে থাকে। দেওয়া হয় ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানিতে আরও নিষেধাজ্ঞা, এমনকী ইরানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ জেনারেল কাশেম সুলাইমানিকে প্রতিবেশী ইরাকের মাটিতে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে নিজস্ব পরমাণু কর্মসূচির আরও বেগবান করে তেহরান, এমনকী পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে যায়, সুলেমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকারও করে। তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, কিন্তু ইরান সম্ভবত তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা ভোলেনি। ২০২৪ এর নির্বাচনী প্রচারণাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, হত্যা পরিকল্পনার জন্য একজনের বিরুদ্ধে গত ৮ নভেম্বর অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। হত্যার ছকে ইরানের সংশ্লিষ্টতা থাকার দাবি করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এবার খোমেনিকে কি তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে পস্তাচ্ছেন? ইসরায়েলের সাথে সংঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাইডেন আমলেও মুখোমুখি অবস্থান থাকায়– ইরান ও তাঁর আঞ্চলিক মিত্ররা এখন আগের চেয়ে দুর্বল। অর্থনীতিতে তো সুবাতাস নেই কবে থেকে। ২০১৬ সালের পর থেকে ইরানি রিয়ালের দর ডলারের বিপরীতে ৯৫ শতাংশ পতন হয়েছে। এরমধ্যে ডান ও মধ্যপন্থীদের বাদ দিয়ে উদারপন্থী মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বেঁছে নিয়েছেন খামেনি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, বিপ্লবের ওই চার স্লোগান থেকেও পিছু হটেছেন। তাঁর আশীর্বাদে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধবিরতি ও সংঘাত- ঝুঁকি হ্রাসের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে স্বদিচ্ছার বার্তাও দিয়েছেন। বস্তুত, এতেই বোঝা যায়, আঞ্চলিক প্রক্সি সংগঠনগুলোর ওপর নির্ভর করতে পারছে না ইরান। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি এতদিনকার কঠোর অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি হিজাব মেনে চলার কড়াকড়িও শিথিল করা হয়েছে।
তবে ইরানের যেসব আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে – সেগুলো পরিত্যাগ না করলে, ট্রাম্পের প্রশাসনে এবার যারা রয়েছেন, তাঁরা নিষেধাজ্ঞার বজ্র আঁটুনি আরও কঠোর করারই পরামর্শ দেবেন। ইরানের তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাও নতুনরূপে ফিরতে পারে। এমনকী এদের কেউ কেউ ইরানে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তনের তাগিদও দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে।
শিগগিরই তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব নিতে চলেছেন ট্রাম্প। ইরানের বিষয়ে এখনও তিনি অনমনীয় বলেই বোধ হচ্ছে। তবে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ইরানের সাথে একটু চুক্তিতে পৌঁছানো দরকার, কারণ কোনো ধরনের সমঝোতা না থাকার পরিণাম হবে 'অকল্পনীয়' (অর্থাৎ ভয়াবহ)। ইরান তাঁর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করলেই ট্রাম্প এইক্ষেত্রে অগ্রসর হবেন, গত ৫ নভেম্বর ভোট প্রদানকালে তিনি বলেন, "তাহলে আমি অত্যন্ত সফল দেশ হিসেবে (ইরানকে) দেখতে চাইব।" এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্পের সাথে ফোটোসেশনের জন্য খামেনি কতোটা প্রস্তুত থাকবেন।
ইকোনমিস্ট থেকে ভাবানূবাদ: নূর মাজিদ