এড়িয়ে চলছে ব্যাংক ও বায়াররা, ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে বেক্সিমকো
গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংকিং সহায়তা ও কার্যাদেশ না পাওয়ার কারণ উল্লেখ করে, বেক্সিমকো গ্রুপ আজ তাদের গাজীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত ১৬টি পোশাক কারখানায় কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিতে পারে। এই সিদ্ধান্তে বিপন্ন হতে পারে ৪০ হাজার কর্মীর জীবিকা।
বর্তমানে আর্থিক চাপ মোকাবিলা করতে পারছে না শিল্পগোষ্ঠীটি; এমতাবস্থায় চলমান পরিস্থিতিকে অটেকসই বলে বর্ণনা করেছেন বেক্সিমকো গ্রুপের একজন পরিচালক ও বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী।
কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে আশ্বস্ত করেছিলেন যে আমাদের ব্যবসাকে সমর্থন দেওয়া হবে। যার ভিত্তিতে আমরা চার মাস ধরে কারখানা চালু রাখি। কিন্তু, কার্যত কোনো সহায়তা পাইনি।'
গত চার মাসে বেক্সিমকো ব্যয় করেছে ৩০০ কোটি টাকা, যার বেশিরভাগই গেছে শ্রমিকদের মজুরি দিতে, এরমধ্যে ১০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরির দিতে মাসে ৬০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বেতন বাবদ আরও ১৫ কোটি টাকা দরকার বেক্সিমকো গ্রুপের, গত চার মাস ধরে যারা বেতন পাননি।
ওসমান বলেন, 'অন্যান্য কারখানার সাথে সাব-কন্ট্রাক্টে আমরা মাসে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছি, যা মোটেও যথেষ্ট নয়। আগে এসব কারখানা মাসে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার আয় করতো।'
বেক্সিমকোর সাথে ব্যবসা করার বিষয়ে বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত
গত আগস্টের পর থেকে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের (বায়ার) থেকে নতুন কার্যাদেশ না পাওয়ায় বেক্সিমকোর সংকট আরও গভীর হয়েছে। ওসমান জানান, ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারলে প্রধান আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বজায় রাখবে বলে আভাস দিয়েছে। কিন্তু, বেক্সিমকোর আর্থিক অবস্থার কারণে ব্যাংকখাতও সমর্থন দিতে চাইছে না। ফলে আমরা বায়ারদের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারছি না।
তিনি বলেন, 'কিছু ব্যাংক হয়তো এলসি খুলতে দেবে, তবে সেক্ষেত্রে তারা ১০০ শতাংশ মার্জিন রাখবে। এবিষয়ে তারা সরকারের থেকেও পজিটিভ সিগন্যাল চায়। বর্তমানে এসব শর্ত পূরণ করার মতো ক্যাশ রিজার্ভ আমাদের কাছে নেই।'
কর্মী ছাঁটাইয়ের পর কারখানাও বন্ধ হতে পারে
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী নির্দিষ্ট শর্তপূরণ করা শ্রমিকদের ছাঁটাই বা লে-অফের ক্ষেত্রে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া এসব শ্রমিকের লে-অফের সব দিনের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৫ নং উপধারা বলছে, কোন পঞ্জিকা বৎসরে ওই শ্রমিককে ৪৫ দিনের বেশি সময়ের জন্য লে-অফ করা হলে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ওসমান জানান, শুরুতে লে-অফ বা ছাঁটাই ৪৫ দিনের জন্য করা হবে, এরমধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি নাহলে আরও ১৫ দিন বাড়ানো হবে। এরপরে স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানি হওয়ায় বেক্সিমকোর টেক্সটাইল শাখার লে-অফের সিদ্ধান্তটি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি, তার আগে বেশকিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ, অর্ধেকের বেশি খেলাপি
বেক্সিমকোর বর্তমান আর্থিক সংকটের সাথে তাদের বিপুল দেনার সরাসরি সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি হাইকোর্টে দাখিল করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৮ কোটি টাকারও বেশি। এসব ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি বা ২৫ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা ইতোমধ্যেই খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়েছে। গ্রুপের ১৮৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান ১৬ ব্যাংক ও ৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে ঋণ নিয়েছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি সংযুক্ত করে তা ব্যবস্থাপনায় ছয় মাসের জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. রুহুল আমিনকে রিসিভার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের অ্যাপারেল ইউনিট বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন মো. রুহুল আমিন। তিনি বলেন, 'খেলাপি ঋণের কারণে বেক্সিমকো এলসি খুলতে পারছে না, ফলে কার্যাদেশ পূরণের জন্য সাব-কন্ট্রাক্টের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কারখানা চালানো আমাদের কাজ না, তবে সাহায্য চাওয়া হলে আমরা তা করতে প্রস্তুত আছি।'
বেক্সিমকো গ্রুপের সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করার সমালোচনাও করেন তিনি। বলেন, গ্রুপটির কর্মকাণ্ডই এর জটিল আর্থিক অবস্থাকে আরও গুরুতর দিকে নিয়ে গেছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের সংকটের বৃহত্তর রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। অভিযোগ রয়েছে, নিজ প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি বেক্সিমকোর জন্য অনুকূল শর্তে বিপুল ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেন। গত ১৩ আগস্ট রাজধানী ছেড়ে নৌপথে পালানোর চেষ্টার সময় সদরঘাটে আটক হন সালমান, এখন তিনি জেলে রয়েছেন।
বর্তমানে শিল্পগোষ্ঠীটি আর্থিকভাবে দুর্বল, পরিচালনাতেও চাপের মধ্যে আছে, এই অবস্থায় বেক্সিমকোর পোশাক কারখানার বাইরে অন্যান্য খাতের ব্যবসাতেও তাদের দেনা সংকটের প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও শিল্পখাতের জন্য যা একটি উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।