সরকারের আশ্বাসের পরেও শ্রম অভিবাসনের খরচ কমেনি
'ভিসা বাণিজ্য' বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার খরচ কমানো হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সেই আশ্বাসের পরেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ কমেনি।
এ মাসের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর প্রকাশিত শ্বেতপত্রে অভিবাসনের উচ্চ খরচের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিদেশি কর্মসংস্থান খাতের ৭টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে 'অভিবাসনের উচ্চ ব্যয়' রয়েছে শীর্ষ স্থানে— যা গত এক দশক ধরে বেড়েই চলেছে।
শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদেরই বিদেশ যেতে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়।
গতকাল (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় শ্বেতপত্র কমিটির সভাপতি দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার খরচ বেড়েছে।
তিনি বলেন, "নেপাল থেকে একজন কর্মী পাঠাতে যে পরিমাণ খরচ হয়, বাংলাদেশে হয় তার তিনগুণেরও বেশি; এখানে রাজনৈতিক দুর্নীতি জড়িত।"
অভিবাসন খরচের মধ্যে রয়েছে— পাসপোর্ট ফি, প্রশিক্ষণ ফি, রিক্রুটিং এজেন্সির ফি এবং সাব-এজেন্ট ফিসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয়। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে এসব খরচ বেড়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অবৈধ সিন্ডিকেটের প্রভাবে এই খরচ লাগাতার বেড়েছে।
এদিকে, অভিবাসী কর্মীদের 'ভিআইপি সেবা' প্রদানের অংশ হিসাবে, গেল মাসে ঢাকা বিমানবন্দরে দুটি লাউঞ্জ উদ্বোধন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস। এর একটি টার্মিনালের ভিতরে– যেখানে বিশ্রাম নেওয়া এবং ভর্তুকি মূল্যে (কম দামে) খাবার পাওয়া যাবে এবং অন্যটি মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জ।
তবে অভিবাসন খরচ কমাতে গত ৫ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, একজন অভিবাসী কর্মীকে তার বিদেশ পাড়ি দেওয়ার খরচ ওঠাতে ১৭ মাস পর্যন্ত কাজ করতে হতে পারে।
সরকারের পদক্ষেপ
নিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল (১৭ ডিসেম্বর) টিবিএসকে বলেন, ভিসা বাণিজ্য ঠেকানো বেশ চ্যালেঞ্জিং।
অনেক লোক ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ভিসা পেয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে ভিসা বাণিজ্য রোধ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে জানিয়ে তিনি বলেন, "এরপরেও গন্তব্য দেশগুলোতে ভিসা বাণিজ্য ঠেকাতে নীতিগতভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে।"
এছাড়া, সরকারি মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকে আরও সক্রিয় করার প্রচেষ্টা চলছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। "এতে বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের খরচ কমাতে বাধ্য হবে," যোগ করেন তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকার সমস্ত রিক্রুটিং এজেন্ট এবং সাব-এজেন্টদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য কাজ করছে।
তিনি বলেন, সরকার কোনো সিন্ডিকেটকে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে না।
সরকার নির্ধারিত খরচ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি
২০১৭ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সিঙ্গাপুরে যেতে সর্বোচ্চ ২,৬২,২৭০ টাকা অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে।
সৌদি আরব যেতে সর্বোচ্চ ১,৬৫,০০০ টাকা; বাহরাইন যেতে ৯৭,৭৮০ টাকা; সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১,০৭,৭৮০ টাকা; কুয়েতে ১,০৬,৭৮০ টাকা; ওমান এবং কাতারে ১,০০,৭৮০ টাকা; ইরাকে ১,২৯,৫৪০ টাকা, মালদ্বীপে ১,১৫,৭৮০ টাকা; ব্রুনাইয়ে ১,২০,৭৮০ টাকা; লেবাননে ১,১৭,৭৮০ টাকা; জর্ডানে ১,০২,৭৮০ টাকা এবং জাপানে যেতে ১,৪৮,৫০০ টাকা অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে সরকার।
এছাড়া, ২০২১ সালে সরকার মালয়েশিয়া যেতে সর্বনিম্ন ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ৭৮,৯৯০ টাকা।
তবে খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সিঙ্গাপুর-সহ অন্যান্য প্রধান গন্তব্যে যেতে চাকরিপ্রার্থী স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের বর্তমানে খরচ হয় ৪ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা— ২০০৮ সালের আগে, যা ছিল ৮০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
কুয়েতে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাব-এজেন্ট মোস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তিনি সম্প্রতি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে একজনকে কুয়েতে পাঠিয়েছেন— যার মোট খরচ হয়েছে ৭ লাখ টাকা।
সংস্কার কমিশনের দাবি
এ খাতের দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করে পরিবর্তন আনতে একটি সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। যদিও এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কমিশন গঠন করা যায়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি কর্মখাত বড় ভূমিকা রাখে; এ খাত থেকে বছরে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আয় হয়।
এদিকে সরকারও বলেছে, অবৈধ ভিসা বাণিজ্য অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। কেননা এ কারণেই বাংলাদেশি কর্মীদের বড় দুই গন্তব্য মালয়েশিয়া ও ওমানের ভিসা বন্ধ হয়ে গেছে।
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অফ বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টস (ওয়ারবি) ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক টিবিএসকে বলেন, "এই খাতকে আদম ব্যবসা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে— যেখানে বছরের পর বছর ধরে চুরি, চামারি, লুটপাট, হুন্ডি, সিন্ডিকেট ইত্যাদির অভিযোগ আমরা শুনে আসছি।"
তিনি বলেন, "বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দুর্ভোগ লাঘবে একটি আমূল সংস্কার দরকার ছিল। কিন্তু এরজন্য আমরা একটি কমিশন গঠনের দাবি করে আসলেও কোনো উদ্যোগ দেখতে পেলাম না।"
ফুলে-ফেঁপে উঠছে রিক্রুটিং এজেন্সি
শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতির কারণে গত দশকে রিক্রুটিং এজেন্সির অগ্রগতি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই এজেন্সিগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার ফলে অভিবাসনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকার ৯৩৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে লাইসেন্স প্রদান করেছে। প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০টি নতুন এজেন্সি লাইসেন্স পেয়েছে, তবে কিছু অনিয়মিত এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল।
তবে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১,১৮৫টি নতুন লাইসেন্স দেওয়া হয়, যার মধ্যে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ৮০০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
শ্বেতপত্রে প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, "রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা যুক্তিসংগত স্তরে আনা উচিত। অপ্রদর্শিত এবং প্রতারণামূলক এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা প্রয়োজন। রিক্রুটিং লাইসেন্স প্রদানের হঠাৎ বৃদ্ধি তদন্ত করা উচিত, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।"
তিনি আরও বলেন, "অভিবাসনের খরচ কমানোর জন্য সরকারকে বহুপাক্ষিক ফোরাম এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভিসা বাণিজ্যের বিষয়টি তুলতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, যাতে ভিসার মূল্য অপ্রত্যাশিতভাবে না বাড়ে এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সুষ্ঠু থাকে।"
ভিসা কেনার খরচ নিয়ে অস্পষ্টতা
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অভিবাসন খরচের দুটি প্রধান উপাদান চিহ্নিত করেছে– ভিসা কেনা এবং ইকামা ফি (মূলত সৌদি আরবের ক্ষেত্রে)।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রিক্রুটিং এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব শামিম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, "বিদেশ থেকে চাকরির ডিমান্ড লেটার (চাহিদা পত্র) পেতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মার্কেটিং খরচ আছে। কিন্তু এই খরচের কোনো বৈধ স্বীকৃতি নেই। আমরা বহুদিন ধরে দাবি করে আসছি, এটার একটি আনুষ্ঠানিক চ্যানেল তৈরি করা হোক। তাহলে কত টাকা ভিসা বাণিজ্যে ব্যয় হচ্ছে, সেটা সুস্পষ্ট থাকবে এবং খরচ বেধে দেওয়া যাবে।"
তাছাড়া, অভিবাসনের খরচ কমাতে একটি ডেটাবেজভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা এবং বাধ্যতামূলক ব্যাংকিং লেনদেনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত দশকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ভিসা কেনার জন্য অবৈধ হুন্ডি লেনদেনের মাধ্যমে ১৩.৪ লাখ কোটি টাকা পাঠিয়েছে।