ব্যাংক অবসায়িত হলে কতোটা আমানতের নিরাপত্তা পাওয়া যাবে
গত দুই দশকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এ সময়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১৩টি ব্যাংক। অথচ আমানতকারীদের ঝুঁকির নিরাপত্তা গুরুত্ব পায়নি। ব্যাংক গুটিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গত ২৪ বছর ধরে প্রত্যেক আমানতকারীর বিপরীতে বিমার সীমা মাত্র ১ লাখ টাকাই রয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমানতের বিমা কাভারেজ সর্বনিম্ন হচ্ছে বাংলাদেশে; যে কারণে উদ্বেগে রয়েছেন আমানতকারীরা। এই উদ্বেগের অন্যতম কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনকালে ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে অন্তত ১০টি ব্যাংক এখন 'টেকনিক্যালি দেউলিয়া' হয়ে গেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য যা ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
বিমাযোগ্য আমানত বাড়তে থাকলেও ২০২১ সাল থেকেই কমছে বিমাকৃত আমানত, অন্যদিকে ২০০০ সালে আমানত বিমা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে আমানতকারীপ্রতি বিমা কাভারেজ মাত্র ১ লাখ টাকা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সম্পূর্ণ ব্যাংকখাতের মাত্র ১৯ শতাংশ আমানত—আমানত বিমা ট্রাস্ট তহবিল (ডিআইটিএফ) এর অধীনে সুরক্ষিত রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ ২০২১ সালেও সুরক্ষিত আমানত ছিল ২৩ শতাংশ।
কোনো ব্যাংক বিলুপ্ত হলে প্রত্যেক আমানতকারীকে আমানতের অর্থ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। তবে ব্যাংক বিমা আইনের বিধান অনুযায়ী, তা ১ লাখ টাকার বেশি হবে না।
প্রথমে বিমা কাভারেজের এই অর্থ প্রদান করা হবে। আইনে বলা আছে, এরপর 'অবসায়িত ব্যাংকে কোন আমানতকারীর একাধিক হিসাব থাকিলে এবং ঐ সকল হিসাবে একত্রে এক লক্ষ টাকার অধিক স্থিতি থাকিলেও তাহাকে তহবিল হইতে সর্বাধিক এক লক্ষ টাকার অধিক পরিশোধ করা হইবে না। তবে এইরূপ পরিশোধ অবসায়িত ব্যাংক-এর নীট সম্পদের বিপরীতে লিকুইডেটর কর্তৃক আমানতকারীদিগকে দেয় অংকের সহিত সমন্বয় করা হইব।'
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ডিআইটিএফের মোট পরিমাণ ১৫ হাজার ১৫২ কোটি টাকা, যা দিয়ে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা আমানত রাখা ৯১.২ শতাংশ ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকখাতে মোট বিমাযোগ্য আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে যে ১০টি ব্যাংককে 'টেকনিক্যালি দেউলিয়া' বলা হয়েছে, তাদের কাছে রয়েছে মোট আমানতের ২০ শতাংশ, যার অংক প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি স্টাডি অনুযায়ী, ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ট্রাস্ট ফান্ড (ডিআইটিএফ) বর্তমানে প্রত্যেক আমানতকারীর জন্য সর্বাধিক ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমাকৃত আমানতের ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে, যা সর্বাধিক ২৩টি ছোট ব্যাংকের অবসায়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তবে আমানতের পরিমাণ বেশি থাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংকে আমানতকারীদের সম্পূর্ণ কাভারেজ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২৩ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পিছিয়ে বাংলাদেশ
ব্যাংক আমানতের বর্ধিত মূল্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও আয় বাড়ার মতো বিভিন্ন বিষয়কে বিবেচনায় রেখে ভারতে ২০২০ সালে আমানত বিমার পরিধি ১ লাখ রুপি থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ রুপি করা হয়।
২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত, ভারতের ব্যাংকখাতের ৯৭.৮ শতাংশ হিসাব পুরোপুরি সুরক্ষিত, যা ৮০ শতাংশের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে।
একই সময়ে, বিমাকৃত আমানতের অনুপাত (আইডিআর) ছিল ৪৩.১ শতাংশ, অর্থাৎ মোট আমানতের ৪৩.১ শতাংশ বিমার আওতায় ছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর থেকে অন্তত ১৩টি ব্যাংক চালু হয়—যখন ৬ থেকে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধির সুবাদে আমানতের পরিমাণ ৭ গুণ বাড়লেও—দুই দশকেও আমানতের বিমা কাভারেজ সমন্বয় করেনি সরকার।
অর্থনীতির নানান সূচকে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানেও তফসিলি ব্যাংকগুলোর ৯৮ শতাংশের বেশি আমানতকারী ডিপোজিট প্রটেকশন কর্পোরেশন (ডিপিসি)-র অধীনে সুরক্ষিত। ডিপিসি একটি ব্যাংকের পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত আমানতকারীকে সুরক্ষা দেয়। মূল্যের হিসাবে দেখা যায়, এর সদস্য ব্যাংকগুলোর ৫৫ শতাংশ আমানতই সুরক্ষা পেতে পারে।
শ্রীলঙ্কায় ব্যাংক অবসায়নের ক্ষেত্রে আমানতের সর্বোচ্চ বিমা কাভারেজ ১১ লাখ রুপি।
বৈশ্বিক পর্যায়ে, আমানত বিমাকারীরা মোট আমানতের প্রায় ৪১ শতাংশকে কাভারেজ দেয়, আর ৫৯ শতাংশ বিমাকৃত নয় বলে জানিয়েছে আইএডিআই।
সাধারণত, উন্নত অর্থনীতি দেশগুলোয় বিমাকৃত আমানতের অনুপাত বেশি থাকে।
আইএডিআই এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে ৭ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ প্রদান শুরু করা আমানত বিমাকারীদের অনুপাত ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে; ২০১৩ সালে তা ৩০ শতাংশের কিছু বেশি থাকলেও—তা বর্তমানে প্রায় ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে।
ইউরোপে ৭০ শতাংশ আমানত বিমাকারীরা সাত দিনের মধ্যেই অর্থ প্রদান করে, এশিয়ায় তা ৪০ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক অবসায়নের ঘোষণা দেওয়ার পর আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের সময়সীমা বর্তমানে তিন মাস নির্ধারিত রয়েছে।
আমানতের আইন সংশোধনের উদ্যোগ
'ব্যাংক আমানত বিমা আইন' সংশোধনের মাধ্যমে বিমা কাভারেজ বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করে 'আমানত সুরক্ষা আইন' করতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২ সালের খসড়া এই আইনটিকে অনুমোদন দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা, আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষানিরীক্ষার পরে তা সংসদেও পাঠানো হয়। এটি সংসদে অনুমোদন লাভ করেনি।
আইনটি কার্যকর করা হলে, বিমা কাভারেজ দ্বিগুণ হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এর আমানতকেও বিমা সুরক্ষা দিবে এ আইন।
অন্তর্বর্তী সরকার আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরে তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে খসড়া এই আইনটি সংশোধন করে এটিকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডিপোজিট ইন্স্যুয়ার্স (আইএডিআই) এর মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার নির্দেশ দেন।
তাঁর নির্দেশের প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক খসড়া আইনটি সংশোধন করে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণের সময়সীমা বিদ্যমান তিন মাস থেকে কমিয়ে ৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে আইএডিআই এর সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।
দেশে কোনো ব্যাংক এখনও অবসায়িত হয়নি
বাংলাদেশে এপর্যন্ত কোনো ব্যাংককে অবসায়ন করা হয়নি। কিছু ব্যাংক আংশিকভাবে দেউলিয়া হলেও–আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অবসায়নযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি।
যেমন এর আগে, ফার্মার্স ব্যাংক হিসেবে পরিচিত পদ্মা ব্যাংক দুর্নীতির কারণে অস্থিরতা ও তারল্য সংকটে পড়ে, যার ফলে অনেক আমানতকারী তাদের আমানতের উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হন।
তবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংকটিকে অবসায়ন না করে অন্য ব্যাংকের সাথে মার্জার বা একীভূত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান—পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে অবসায়নের সুপারিশ করে। তবে সরকার শুধু পিপলস লিজিংকে অবসায়নের অনুমতি দেয়। তবে এই অবসায়নও বাস্তবায়ন করা হয়নি, ফলে আমানতকারীরাও তাদের টাকা ফেরত পাননি।
সুরক্ষা তহবিলে ব্যাংকগুলোর অবদান
ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০ অনুযায়ী, প্রতিটি তফসিলি ব্যাংককে একটি বিমা ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং সদস্য ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত সময়ে তাদের মোট বিমাকৃত আমানতের উপর ভিত্তি করে অর্ধ-বার্ষিক প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়।
২০০৭ সালের আগে প্রিমিয়ামের হার নির্ধারণ করা ছিল ০.০৭ শতাংশ। ২০১২ সালে ঝুঁকির ভিত্তিতে আমানত বিমার প্রিমিয়ামের হার চালু করা হয়, তখন আগের হার সংশোধন করে ক্যামেলস (CAMELS) রেটিংয়ের ভিত্তিতে ০.০৮ শতাংশ থেকে ০.১০ শতাংশ করা হয়। কোনো ব্যাংক কতটা শক্তিশালী তার ছয়টি ক্যাটাগরি–মূলধনের পর্যাপ্ততা, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা, আয়, তারল্য ও সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে ক্যামেলস রেটিং করা হয়।
২০১৩ সাল থেকে সংকট-কবলিত ব্যাংকগুলো ক্যামেলস রেটিংয়েও পিছিয়ে পড়ে, যেকারণে তাদের বেশি বা ০.১০ শতাংশ হারে প্রিমিয়াম দিতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সদস্য ব্যাংকগুলোর থেকে মোট প্রিমিয়াম আদায় করা হয় ৯১৭ কোটি টাকা, আগের বছরের ৮৬৬ কোটি টাকার চেয়ে যা ৫.৮ শতাংশ বেড়েছে।
এই তহবিলের সমুদয় অর্থ সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়। আর আমানত বিমা ট্রাস্ট তহবিল (ডিআইটিএফ) এর ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।