চাহিদা বাড়ায় একমাসে রডের দাম বেড়েছে ৫ হাজার টাকার উপরে
টানা ছয় মাস পর চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে ইস্পাতের বাজারে। চাহিদা বাড়ার কারণে গত তিন সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে নির্মাণপণ্য এমএস রডের দাম বেড়েছে টনপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে ব্যক্তি পর্যায়ে বাড়ি-ঘর নির্মাণের কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা বেড়ে রডের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে রডের চাহিদা এখনও অনেকটা শূন্যের কোঠায়। তাই উৎপাদন খরচের সাথে দামের সমন্বয় না হওয়ায় হতাশ ইস্পাত কারখানা মালিকরা।
রড কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে মিল পর্যায়ে প্রতিটন ৭৫-গ্রেডের এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৮ হাজার টাকায়। এর আগে জুলাইয়ে ৯৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হওয়া রড ক্রমাগত কমে ডিসেম্বরে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ৮০-৮২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এর আগে, ২০২১ সাল থেকে দফায় দফায় বেড়ে ২০২২-২৩ সালে পণ্যটির দাম টনে এক লাখ টাকা পার হয়েছিল।
বর্তমানে বাজারে বিএসআরএম ৮৮ হাজার, জিপিএইচ ৮৬ হাজার এবং কেএসআরএম ও একেএস ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলছেন, প্রতিটন ৭৫-গ্রেডের রড উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৯০ হাজার টাকার উপরে। ফলে দাম বৃদ্ধির পরে এখনও তাদের প্রতিটন রডে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কারখানা পর্যায়ে প্রতিটন ৬০-গ্রেডের রড বিক্রি হয়েছিল ৭৬ থেকে ৭৮ হাজার টাকায়। টনে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে ৬০-গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৮৪ হাজার ৫০০ টাকায়।
৬০-গ্রেডের রডের মধ্যে এইচএম ও গ্লোডেন ৮৪ হাজার এবং এসএস, মুনতাহা, জুলফিকার, ফ্রেশ ও আল আকসা ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি রড ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম আসাদগঞ্জ এলাকার মেসার্স খাজা স্টিলের স্বত্বাধিকারী নুরুল মোস্তফা বলেন, প্রায় এক মাস ধরে রডের চাহিদা ও বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। মূলত শুষ্ক মৌসুমে (নির্মাণ মৌসুম) মানুষের ঘর-বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় রডের এই চাহিদা বেড়েছে।
"তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি অনেক কম। আগের বছরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে দিনে গড়ে ২৫০-৩০০ টন রড বিক্রি হতো। অথচ এ বছর দিনে বিক্রি ১৫০ টনের নিচে," বলেন তিনি।
উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি
দাম বৃদ্ধির পরও এখনেও রডের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম-ভিত্তিক এইচ এম স্টিলের পরিচালক সরওয়ার আলম। বর্তমানে প্রতিটন রডে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী।
সরওয়ার আলম বলেন, "দেশের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ ইস্পাত ব্যবহার হয় সরকারি নির্মাণ প্রকল্পে। বাকি ৩০ শতাংশের গ্রাহক ব্যক্তি পর্যায়ে। তাই ব্যক্তি পর্যায়ে চাহিদা বাড়লেও সেটা বাজারে খুব বেশি প্রভাব ফেলছে না।"
এই কারখানা মালিক আরও বলেন, "লোকসান জেনেও কারখানার মিনিমাম উৎপাদন চালিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও কর্মীদের বেতনসহ ফিক্সড খরচ বন্ধ রাখা যায় না।"
এইচএম স্টিল এবং গোল্ডেন স্টিল মিলে বর্তমানে তাদের মাসে ১০ কোটি টাকার উপরে লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান সরওয়ার আলম।
ইস্পাত খাতের অপর উদ্যোক্তা কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন বলেন, "রডের চাহিদা ও দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানা মালিকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। কারণ কারখানার লোকসান কমে এসেছে।"
"তবে এই মুহূর্তে কারখানার উৎপাদন চালু করবো কি না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না," বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, এর আগে উৎপাদন খরচের সঙ্গে দামের সমন্বয় না হওয়ায় আগস্ট থেকে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখে কেআর স্টিল— যে কারখানাটিতে দিনে গড়ে ২৫০ থেকে ২৭০ টন রড উৎপাদন হত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। একইসাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণে দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের নির্মাণকাজেও ধীরগতি। এতে চাহিদা ও বিক্রি কমে নির্মাণকাজের প্রধান উপকরণ রড বিক্রিতে ধস নামে।
এরপর ইস্পাত কারখানাগুলো রডের উৎপাদন তাদের ক্যাপাসিটির চেয়ে ৪০-৬০ শতাংশে নামিয়ে আনে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানায়, দেশে ইস্পাত কারখানার সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪০টি।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। যদিও দেশে বার্ষিক রডের ব্যবহার ৭৫ লাখ টন।
এখন পর্যন্ত এই খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। বছরে লেনদেনের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।