‘প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে খেলবে, মাথা নোয়াবে না; তামিম ছিল এমন’
একটা পাশ নির্ভার, এই পাশের দায়িত্বটা তামিম ইকবালের। কিন্তু অন্য প্রান্তে সব সময় পরিবর্তনের হাওয়া লেগেই থেকেছে। আজ একজন তো, কাল আরেকজন। উদ্বোধনী জুটিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য কেউ-ই তামিমের সঙ্গী হতে পারেননি। যে কাজটি অনেকেই করতে পারেননি, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সেটা করে এসেছেন অভিজ্ঞ ওপেনার। পাওয়ার প্লেতে প্রতিপক্ষ বোলারদের চোখে চোখ রেখে দাপুটে ব্যাটিং কীভাবে করা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিমই সেটা প্রথম করে দেখিয়েছেন।
আক্রমণাত্মক তামিম একটা সময়ে এসে দায়িত্ব বুঝতে শিখেছেন, পাল্টেছেন খেলার ধরন। দলই যে আগে, সেটা মাথায় গেঁথে নিয়েছেন। এ কারণে চোট পাওয়ায় এক হাতেও ব্যাটিং করতে দেখা গেছে তাকে। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এমন আরও আইকনিক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন দেশের ইতিহাসের সেরা এই ওপেনার। যেসব মুহূর্ত আগামীতে আর কখনও দেখা যাবে না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তামিম জানান, তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধ্যায় শেষ।
খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেটের দীর্ঘ পথচলায় অনেকের সঙ্গে খেলেছেন তামিম। কার চোখে তিনি কেমন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। ব্যাটসম্যান ও ওপেনার তামিম, তার ব্যাটিংয়ের ধরন, ক্যারিয়ারের সাফল্য, মানুষ তামিমসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে টিবিএসের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলে তার প্রথম অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, দুই সাবেক সতীর্থ মোহাম্মদ আশরাফুল ও শাহরিয়ার নাফিস।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল
আমার চোখে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তামিম সফলতম ওপেনার। তামিমকে প্রথম চিনি আকরামের ভাতিজা হিসেবে। আমার মনে পড়ে, আমরা যখন টেস্ট ম্যাচ খেলতাম পাকিস্তানের সাথে, জিম্বাবুয়ের সাথে; আমার আমলে যে টেস্ট ম্যাচগুলো চট্টগ্রামে খেলেছি, তখন আমি বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতাম। তামিম সেখানে আসতো, তখন তো এতো কড়াকড়ি ছিল না। ওর সাথে আমি ইংরেজিতে কথা বলতাম। ওর সাথে খুব মজা করতাম। আমি জানতাম ও আকরামের ভাতিজা, ইকবাল ভাইয়ের ছেলে। আমি ওকে অনেক ছোট থেকে চিনি, ও মাঠে আসতো। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ওর সাথে মজা করতাম, ও খুব মজা পেতো। তখনই আমার মনে হতো, খুব প্রতিভাবান একটা ছেলে। আকরাম বলতো, "আমার একটা ভাতিজা আছে, খুব ভালো খেলোয়াড় হবে।' পরবর্তীতে তো জাতীয় দলে খেললো।
২০১৫ বিশ্বকাপ যখন অস্ট্রেলিয়াতে হলো, ল্যাংহাম হোটেলে ছিল। আমাকেসহ সবাইকে তামিম বলতো, "উনার বাংলাদেশে ফিরে কাজ করা উচিত।" নিজের ব্যাপারে বলার কারণ, ওর সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল সব সময়ই। ও ভাবতো আমি বাংলাদেশে গিয়ে হয়তো বেটার কাজ করতে পারবো। সে আমার অন্যতম সাপোর্টার, যে চাইতে আমি দেশে গিয়ে কাজ করি। এই জন্য ওর প্রতি সব সময়ই আমার আলাদা নজর ছিল। আগেও বললাম, আবার বলছি; তামিম সম্ভবত বাংলাদেশের সর্বকালে সেরা ওপেনার। তখন আশরাফুল জাতীয় দলে খেলে, তামিমও খেলে। আশরাফুল একদিন আমাকে বলছিল, "বুলবুল ভাই, তাড়াতাড়ি মাঠে যেতে হবে।" আমি জিজ্ঞাস করি কেন, আশরাফুল বলে, "তামিম ব্যাটিং করবে।" সে খুবই জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার। খেলোয়াড় হিসেবে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম।
ইমরান হামিদ পার্থর পরে সেই প্রথম পিঞ্চ হিটার। সব দেশের সাথে তার ভালো ইনিংস আছে, ওয়ানডেতে আট হাজার রান। সে পূর্ণাঙ্গ একজন ক্রিকেটার, আক্রমণাত্মক ওপেনার। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ওপেনার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলো। তার ব্যাপার যেন এখানে শেষ না হয়ে যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দেওয়ার জন্য যেন প্রস্তুত হয়। আরেকটা ব্যাপারে বলবো, ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে সব মিলিয়ে তার সাথে আমরা যে আচরণ করেছি, অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি, আমার কাছে মনে হয়; চার-পাঁচ বছর ধরে গড়া দলটাকে নষ্ট করে ফেলা। যাই হোক, তামিম খুবই আক্রমণাত্মক ওপেনার ছিল, কাউকে ভয় পেতো না। মাঠ ও মাঠের বাইরে কোথাও না। ক্রিকেট কৌশলের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বাঁহাতি।
ওর অনেক ইনিংস আছে, সবাই হয়তো লর্ডসের কথাই বলবে। লর্ডসের ইনিংসগুলো এবং খুলনাতে পাকিস্তানের সাথে দ্বিতীয় ইনিংসে ওর একটা সেঞ্চুরি আছে। এসব চোখে লেগে থাকার মতো ইনিংস। আবার বিপিএলের ফাইনালে ওর একটা সেঞ্চুরি আছে। সে ফাইনেস্ট একজন ক্রিকেটার। পরবর্তী প্রজন্ম যারা ওপেন করব, ওকে দেখে শিখতে পারে। মানুষ হিসেবেও তামিম অনেক উদার। অনেক সময়ই সে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, উদাহরণ দিলে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। আমি হয়তো সব জানি না, দবে যা জানি সেসব কম নয়। নামও জানে না, এমন একজনের চিকিৎসার জন্য তামিম টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেট বোর্ডে যারা চাকরি করে, তাদেরকে দুটি করে জামা দিয়েছিল তামিম ওর বিয়ের সময়। আমি এতো কিছু জানি কারণ, ভালো খবর চুপচাপ ছড়ায়। আর খারাপ খবর বাজেভাবে ছড়ায়।
হাবিবুল বাশার
সে অসাধারণ একজন ক্রিকেটার, ড্রিম ক্যারেক্টার। অনেক কিছু পাওয়ার মতো একজন ক্রিকেটার সে। তামিম ইকবাল যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এলো, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ট্রেন্ড হয়ে গেল। উপরের দিকে ব্যাটিং করে কীভাবে পাওয়ার প্লে ব্যবহার করা যায়, তামিম সেটা করে দেখিয়েছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে সিগনেসার কিছু শট ছিল তামিমের, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সে নতুন কিছু ছিল। যা আমরা আগে কখনও দেখিনি। এরপর তামিম অনেক ভালো ভালো ইনিংস খেলেছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছে, অনেক বড় ইনিংস খেলেছে। তামিমের ব্যাট থেকে কিছু অসাধারণ সেঞ্চুরি দেখেছি, ম্যাচ জেতানো ইনিংস দেখেছি অনেক। এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনার তামিম।
দলের প্রয়োজনে সব সময় সে এগিয়ে এসেছে, প্রয়োজনে এক হাতে ব্যাটিংও করেছে। তার ক্যারিয়ারই একটা ক্যারেক্টার। শেষটা মাঠ থেকে হলে খুবই ভালো হতো, এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। তবে একজন ক্রিকেটারের কাছে শারীরিক দিক থেকে মনটা আসল। মনটা কী চাচ্ছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো তার মন বলেছে, দ্রুত জার্সিটা তুলে রাখার জন্য। সবাইকে সেটা সম্মান করা উচিত, আমি সেটা সম্মান করি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিম ইকবালের নামটা একেবারে উপরের দিকে লেখা থাকবে। একজন ক্রিকেটার প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে খেলবে, মাথা নোয়াবে না; তামিম ছিল এমন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করতে কিছু এক্স-ফ্যাক্টর লাগে, সাহস লাগে; তামিম ইকবাল এমন একজন খেলোয়াড় ছিল। কোনো দিন পিছপা হবে না। সে একজন ফাইটার, বুক উঁচু করে চোখে চোখে রেখে ফাইট করবে। এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে সে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনার।
মোহাম্মদ আশরাফুল
বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের নতুন বলে ব্যাটিং করা, তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৫ হাজার রান করা, দাপট দেখিয়ে খেলা, লর্ডসে সেঞ্চুরি করা, ইংল্যান্ডে টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি; এক কথায় অসাধারণ। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে সে ডমিনেট করে খেলেছে। নতুন বলে ব্যাটিং করার দিক থেকে বিশ্বের সেরা চার-পাঁচ জনের একজন তামিম। তার এসব সাফল্য বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিরাট বড় সাফল্য।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সে। সেরার তালিকায় আছে সে, সবার উপরেই থাকবে। বিশেষ করে ওপেনার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন বলে ব্যাটিং করা, সেরা বোলারদের বিপক্ষে ব্যাটিং করে ২৫টা সেঞ্চুরি করা অনেক বড় অর্জন। শেষ ২০ বছরের ক্রিকেট যদি দেখি, ওপেনার হিসেবে সেরা চার-পাঁচের মধ্যে থাকবে তামিম। আমার দেখা তামিমের সেরা ইনিংস লর্ডসের সেঞ্চুরিটি।
শাহরিয়ার নাফিস
দারুণ ক্যারিয়ারের জন্য তাকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট ব্যাটসম্যান, সম্ভবত সেরা ওপেনার এবং সেরা ব্যাটসম্যান। আমি সৌভাগ্যবান যে তার সঙ্গে খেলার সুযোগ হয়েছে আমার। বাংলাদেশের হয়ে তার অনেক অর্জন এবং আমি মনে করি ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের জন্য রোল মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানছে। আমার কাছে মনে হয়, একজন আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যান হিসেবে যে জায়গায় যেতে চাইতাম বা আমার যে স্বপ্ন ছিল, তামিম সেই জায়গাতে গেছে, সেটা করে দেখিয়েছে। সে অসাধারণ ক্রিকেটার, তার ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা।
নিজের সময়ে তামিম বিশ্বের ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট ওপেনার ছিল। ওপেনিং ব্যাটিং খুব কঠিন কাজ, ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছে। ভবিষ্যতের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছে। এটা কেবল বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডে না, গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে সে একজন সুপারস্টার ক্রিকেটার। ওর কাছ থেকে মানুষ অনেক অনুপ্রেরণা নিতে পারে। রেকর্ড ওর হয়ে কথা বলে, সবকিছু মিলিয়ে দুর্দান্ত একটা ক্যারিয়ার ছিল। আশা করি ও ক্রিকেট খেলা অবস্থায় যেভাবে বাংলাদেশের জন্য অবদান রেখেছে, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবদান রাখতে পারবে।