‘সুখ আমাদের কপালে নেই’: দেনার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশি জেলেরা
কালাম শেখের জীবিকা বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমের উপর নির্ভর করে। ইলিশ ধরার এ মৌসুম স্থায়ী হয় বছরের নির্দিষ্ট কিছুদিন।
ডিম ছাড়ার সময় ২২দিন, জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ২৪০ দিন এবং সাগরে মৎস্য সম্পদ রক্ষা করতে ৬৫দিন—এই তিন দফায় মোট ৩২৮ দিন সাগর বা নদীতে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে সরকারের।
বছরের বাকি সময়টা নদী ও সাগরে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ান ইলিশ সন্ধানী জেলেরা। পুরো বছর চলার জন্য আহরণ মৌসুমে হওয়া আয়ের উপরই নির্ভর করেন তারা।
যথেষ্ট পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়লে,আর ভালো দাম পেলে-দেনা শোধ করতে পারেন কালামের মতো জেলেরা। এমনকি বসতবাড়ি মেরামতির কাজটাও করাতে পারেন।
কোভিড অতিমারি আর্থিক নির্ভরতার দুর্বল সেই বার্ষিক চক্রতেও আঘাত হেনেছে এবছর। সঙ্গে ইলিশের বংশবিস্তারে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ তো ছিলই।
অক্টোবরে ইলিশের প্রজনন মৌসুম। অর্থাৎ, আবারো মাছ ধরা বন্ধ। ফলে আরো দেনার ফাঁদে পড়া নিয়ে চিন্তিত কালাম ও তার সহকর্মী জেলেরা।
''ভালো মাছ পেলে চিন্তা থাকে না, তা বেঁচে পুরো বছর চলতে পারি। বাড়ি মেরামতির কাজ, দেনা পরিশোধ আর ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া সবকিছুর খরচ চলে ইলিশ মৌসুমের আয় দিয়ে,''কালাম বলছিলেন।
তিনি জানান, ''ইলিশ ধরার মৌসুমের আয় দিয়ে করোনা মহামারির এ সঙ্কট কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, এবছর ইলিশ ধরাও পড়েছে কম। এপর্যন্ত আমাদের শুধু লোকসানই হয়েছে। আগামীদিনে বিপদ আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।''
এবছর শুধু মাছ ধরার সরঞ্জাম কিনতে কালাম ঋণ নেননি। লকডাউনের মাঝে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়েপরে বাঁচতে বাড়তি দেনাও করতে হয় তাকে।
এভাবেই বাঙ্গালী রসনার বিখ্যাত মাছটির যোগানদাতা জেলেরা আছেন ঘোর সঙ্কটের মধ্যে। আশার আলো ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে তাদের জন্য।
দেশে প্রায় ৩ লাখ জেলে ইলিশ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর ভোক্তাদের কাছে মাছটি পৌঁছে দেওয়ার নানা পর্যায়; পরিবহন ও বিপণনে জড়িত আছেন আরো প্রায় ২০ লাখ মানুষ।
জেলেরাই হচ্ছেন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের সরবরাহক। কিন্তু, স্থানীয় পাইকার ও মহাজনের কাছে কম দামেই ইলিশ বেচতে বাধ্য হন। ঋণ নেওয়ার সময়ই এমন একটা অলিখিত শর্তের বাঁধনে আটকা পড়েন তারা।
তাছাড়া, বিপদে-আপদে মহাজনের কাছে ঋণ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই সুযোগ নেই ন্যায্য দাম নিয়ে দর কষাকষির।
ওয়ার্ল্ড ফিশ নামক একটি এনজিও'র গবেষক আতিকুর রহমান বলেন, 'টাকা নিলেই কমদামে পরে মাছ বেচতে হবে, পাইকার এবং জেলেদের মধ্যে এমন একটা শর্ত থাকে।'
তিনি জানান, সচরাচর মৎসজীবিদের ঋণ দেয় না বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারাও আগ্রহ দেখান না। ফলে বাধ্য হয়েই স্থানীয় ব্যবসায়ী বা পাইকারের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয় তাদের। সঙ্গে কমদামে মাছ বিক্রির মতো কিছু কঠিন শর্ত থাকে।
কালাম শেখ জানান, কেউ ভালো দাম দিতে চাইলেও তার কাছে বেচতে পারি না। এটাই দেনার শর্ত। এর ফলে একদিন যে সম্পূর্ণ দেনা শোধ করব, দিনে দিনে সে সুযোগ কমছে। প্রতিবছর একই মহাজনের কাছে নতুন ঋণের জালে বাধা পড়ছি।
জেলে সমাজের আর্থিক সঙ্গতির এ হালচিত্র নতুন কিছু নয়। তবে কোভিড মহামারি শুধু সঙ্কটে নতুন মাত্রা যোগ করছে মাত্র।
ইতোপূর্বে, টানা ৩০ বছরের বেশি সময় অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে বাংলাদেশে ইলিশের মজুদ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়। এরপর ২০০৩ সাল থেকে নির্দিস্ট কিছু মেয়াদে মাছ ধরা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইলিশের কিছু বিচরণ ক্ষেত্রও ঘোষণা করা হয়েছে অভয়ারণ্য হিসেবে। এরপর থেকে ইলিশ ধরা পড়ার পরিমাণ বেড়েছে।
তবে পেশায় যারা প্রকৃত জেলে তারা এ আহরণের সুযোগ পান না। বেশিরভাগ সময়ে প্রভাবশালী স্থানীয় পাইকার বা মহাজনের লোকেরা বঙ্গোপসাগরে ইলিশ ধরে বলে জানান, আতিকুর রহমান।
নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে অবৈধভাবে মাছ ধরে অনেক প্রভাবশালী। এতে ইলিশ সুরক্ষায় নেওয়া সরকারি চেষ্টা যেমন সফল হয় না, ঠিক তেমনি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও ক্ষমতাহীন জেলেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন, বলে জানান তিনি।
জেলেরা যখন সাগর বা নদীতে ইলিশ আহরণ করতে পারে না, ওই সময় তাদের সরকার থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। এবছর ১০ হাজার টনের বেশি চাল বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। কিন্তু, শুধু খাদ্য সহায়তা যথেষ্ট নয়। কারণ, ঋণচক্র ভাঙ্গতে জেলেদের দরকার নগদ অর্থ সহায়তা।
''সারা জীবন কস্ট করেও এতটুকু সুখী হওয়ার সুযোগ পাই না আমরা। অর্থসঙ্কট আমাদের সব সময়ের সাথী। দেনা নিয়েই শেষে একদিন মরতে হয়,''বলছিলেন উপকূলীয় জেলা ভোলার বাসিন্দা বশির উদ্দিন। নদীর কাছে চায়ের দোকানে বসে আক্ষেপের সুরে একথা বলেন ৪৮ বছরের এ মৎসজীবি।
কালাম শেখের মতো বশিরও লকডাউনের সময় সংসার চালাতে বাড়তি দেনা করেছিলেন।
মহাজনি দেনার এ চক্র অবশ্য শৈশব থেকেই দেখে আসছেন বশির। আরো অনেক জেলে পরিবারের সন্তানের মতো কৈশোরে পা দিতেই পরিবারের আয় বাড়াতে মাছ ধরা শুরু করেন তিনি।
''অন্য বাচ্চারা যখন খেলতো, আমি তখন নদীতে মাছ ধরতে যেতাম। আমার ছোটবেলার অনেক খেলার সাথী স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমি সে সুযোগ পাইনি।''
এই বাস্তবতা আবহমান কালের। আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জেলেরা প্রজন্মের তরে দেনার ফাঁদে জড়ায়। ফলে বাচ্চাদের শিক্ষিত করার সুযোগটাও তারা পায় না। আর এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন ঝড়-তুফান ও প্রতিকূল আবহাওয়া, মাছ ধরার মৌসুমে তাদের নদী ও সাগর থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।
আতিকুর জানান,দিনে দিনে আয় কমা এবং দেনার কারণে শিক্ষার আলো বঞ্চিত জেলে পরিবারের শিশুরা। জেলে পরিবারে জন্ম নিয়ে তারা অন্যকিছু হতে পারবে, এমন আশা এখন আর কেউ করে না।
জেলে সমাজের দূর্গতির জন্য মহাজনি ঋণের বড় কিস্তি পরিশোধের চাপ এবং জেলেদের জীবিকার উৎস নিয়ন্ত্রণকেই তিনি দায়ী করেছেন।
জেলেরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। মহাজন আর পাইকাররা দিনে দিনে আরো সম্পদশালী হচ্ছে। এই শোষণে সহযোগী অনেক স্থানীয় প্রভাবশালীর কপাল খুলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান