ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় কমছে বিক্রি
হঠাৎ করেই অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বেশকিছু পণ্য ও সেবার উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি) বাড়িয়ে দেওয়ায় বাজারে এ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে যে-সব প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্ট অর্থাৎ আগে থেকেই নিয়ম মেনে ভ্যাট আদায় করে আসছিলো, তারা বর্ধিত ভ্যাট আদায় শুরু করেছে। ব্র্যান্ডেড পোশাকের আউটলেটগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মোবাইল ফোন টকটাইম ও ইন্টারনেটেও বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে। সব ধরনের সিগারেটের খুচরা পর্যায়ে প্রতি স্টিকে দাম বেড়েছে দুই টাকা। সিগারেট বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা খরচ বাঁচাতে কম দামি সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার আহ্বান জানান ব্যবসায়ীরা। অতীতে ভ্যাট ইস্যুতে সরব ছিল পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এবারো তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী সংগঠনের একজন সদস্য আমির হোসেইন নুরানি বলেন, "আমরা গতকাল ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি তুলে ধরেছি। আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিষ্ঠানের চাবি জমা দিয়ে আসতে চাই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন বা আন্দোলনে নামবেন।"
এ সিদ্ধান্ত 'আত্মঘাতী'
ঢালাওভাবে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের ব্যবসায়ীদের নেতাদের একটি অংশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারকে আহ্বান জানান।
তারা গতকাল 'দ্য অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন রিফর্ম কাউন্সিল'-এর ব্যানারে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) কাছে এ দাবি জানান।
পরিষদের আহ্বায়ক জাকির হোসেন নয়ন বলেন, পরিষদ সরকারের কাছে অবিলম্বে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়, কারণ এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জুলাই বিপ্লবের চেতনার পরিপন্থি।
তিনি আরও বলেন, "আমরা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা ছাড়াই ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।"
ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে উল্লেখ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিও। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)।
গত ১৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে এফআইসিসিআই বলেছে, ভ্যাট, এসডি ও অন্যান্য ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে ব্যবসায় খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে যার প্রভাব ভোক্তার উপর পড়বে। এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসার কার্যক্ষম ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
ভ্যাট ও এসডি-এর কারণে দাম বৃদ্ধি
গত জুনে বেশকিছু পণ্য ও সেবার ভ্যাট এবং এসডি বাড়ানোর মাত্র সাত মাসের মাথায় এসে গত বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার উপর নতুন করে ভ্যাট ও এসডি বাড়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরপর থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে শুরু করেছে। তবে কিছু পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে এই প্রভাব বুঝার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর কল্যাণপুর, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল এলাকার প্রায় ১০ জন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপেল, মালটা, কমলা, নাশপাতির দাম কেজি প্রতি ২৫-৩০ টাকা বেড়েছে। আর আনারের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, নিম্ন বিত্ত পরিবার এ ফল বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিনতো না, আর এখন দাম বাড়ার ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
কল্যাণপুরের ফল বিক্রেতা হজরত আলি বলেন, "আগে ১,০০০ টাকায় যে ফল কিনতে পারতাম এখন সেই ফল কিনতে হয় ১,৩০০ টাকায়। ৩ দিন আগে প্রতি কেজি মালটা কিনেছি ২৮০ টাকা এখন কিনতে হয়েছে ৩০০ টাকা।"
কল্যাণপুরে আরেক বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম তাওহিদ বলেন, আমাদের বিক্রি এখন ২০ শতাংশ কমে গেছে। যারা উচ্চবিত্ত তাদেরতো কিনতে সমস্যা নেই। আর নিম্নবিত্তরাতো এ ফল কিনেই না। এখন মধ্যবিত্তরাও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।"
"আগে যিনি দুই প্রকার ফল দুই কেজি কিনতেন, এখন তিনি এক কেজি কিনছেন দুই প্রকার ফল মিলিয়ে। কেউ আবার একটা আনার কিনছেন, ৩ টি কমলা কিনছেন" –বলেন তিনি।
ফল আমদানির ওপর সরকার এসডি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করেছে।
মোসারফ হোসেন (৬৫) নামে এক ব্যক্তি গ্রাম থেকে ঢাকায় ছেলের বাসায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য। কল্যাণপুর থেকে ফল কিনেছেন তার নাতির জন্য। জানতে চাইলে বলেন, ৩ টি কমলা ও দুইটি ছোট আনার কিনেছেন। ওজনে এর দাম এসেছে প্রায় ৩৫০ টাকা। তিনি বলেন, দুই বছরের ছোট শিশু কমলা ও আনার পছন্দ করে কিন্তু এত দাম তাই বেশি নিতে পারি নি।"
চশমার ফ্রেম ও গ্লাসের ভ্যাট তিনগুণ বেড়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। রাজধানীর মৌচাকের চশমা বিক্রেতা এনামুল কবির বলেন, "প্লাস্টিক ফ্রেম যেটা কেনা দাম ছিল ১০০ টাকা সেটা এখন ১৩০ টাকা হয়েছে। আর মেটাল ফ্রেম যেটা ২২০ টাকা ছিল সেটা এখন ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।"
রাজধানীর উত্তরায় সেফ ট্রেডিং নামে একটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মুড়ির মোয়া, নাড়ু, নারকেলের নাড়ু সহ খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. মোস্তফা কামাল বলেন, "আমার প্রতিদিন ৩৫ কেজির একটি সিলিন্ডার গ্যাস প্রয়োজন হয়। আগে এটা চার হাজার ২০০ টাকায় কিনতাম এখন এর দাম হয়েছে চার হাজার ৬০০ টাকা।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া যত প্রকার কাঁচামাল আছে তার দাম বাড়বে। জিনিসপত্রের যখন দাম বেড়ে যায় তখন আমাদের প্রফিট মার্জিন কমে যায়। কারণ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়।"
রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকি
এদিকে রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকি দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ রেস্টুরেন্টস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেন, "আমাদের বিক্রি এখন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আমরা ১৬ জানুয়ারি এনবিআর-এর কাছে নতুন করে ভ্যাট প্রত্যাহারের আবেদন করে স্মারকলিপি দিব। আমাদের দাবি না মানলে ভ্যাট হার আগের মতো ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা না হলে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "এমনিতেই গ্যাসের দাম বেড়েছে, আমাদের ব্যবহার করা কাঁচামালের দাম বেড়েছে অথচ আমরা ক্রেতার সামর্থ্য বিবেচনায় পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না। এর উপর আবার নতুন ভ্যাটের চাপ। আর ক্রেতারা ভ্যাট দিতে চাচ্ছে না। কিছু বড় রেস্টুরেন্ট এর ক্রেতা দিয়েতো আর সারাদেশের বিবেচনা করলে হবে না।"
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট হোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি।