অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন: সাংবাদিকদের নামে মামলা করতে ব্রিটিশ ব্যারিস্টারের পরামর্শ চান হাসিনা
রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির একটি চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পেছনে থাকা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্রিটেনের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ডেসমন্ড ব্রাউন কেসি-র পরামর্শ নিয়েছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা মানহানি মামলার বিশেষজ্ঞ ব্রাউনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
সম্প্রতি দ্য সানডে টাইমস হাসিনার সাবেক বাসভবন গণভবন থেকে একটি দুমড়ানো-মুচড়ানো নথি উদ্ধার করেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ হাইকমিশনের ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতে সম্মত হন ব্রাউন। পরে তাদেরকে একজন সলিসিটরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সলিসিটর ব্রিটিশ আদালতে মামলা শুরু করতে পারতেন। সাক্ষাতের পরের মাসে এই দুজন হাসিনা সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
এই বৈঠকের কয়েকদিন আগেই আল-জাজিরা 'অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন' শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছিল। তাতে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই প্রকাশ্যে গর্ব করে বলেন, তিনি পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উঠিয়ে নিতে পারেন এবং ঘুষ নিয়েই কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারেন।
এই ডকুমেন্টারি প্রচারের পর জেনারেল আজিজ ও তার ভাইয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ইউটিউবে প্রায় দশ মিলিয়ন ভিউ পাওয়া ওই ডকুমেন্টারি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জেতে। শেখ হাসিনার শাসনামলের সর্বব্যাপী দুর্নীতির প্রমাণ উঠে এসেছে এতে।।
কিন্তু হাসিনার প্রশাসন ওই ডকুমেন্টারিকে প্রকাশ্যে 'মিথ্যা, মানহানিকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার' বলে দাবি করে।
ডকুমেন্টারিটি প্রচারের পরপরই প্রতিবেদনের প্রধান হুইসেলব্লোয়ার জুলকারনাইন সায়ের খানের ভাইকে লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ ডকুমেন্টারির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন দেশ ছাড়তেও বাধ্য হন।
ঢাকায় শেখ হাসিনার বাড়িতে পাওয়া নথি থেকে জানা যায়, ওই ডকুমেন্টারিতে অবদান রাখা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করছিল তার সরকার।
এই নথির তথ্য বলছে, হাসিনা সরকারের 'লাইবেল ট্যুরিজম', অর্থাৎ মানহানির জন্য বিদেশি আদালত ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল। এ পদ্ধতিতে বিদেশি বাদীরা ব্রিটিশ আদালতকে ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের বাইরে অবস্থিত ব্যক্তি বা প্রকাশনার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেন। অনেকেই মনে করেন, ব্রিটিশ আইনি ব্যবস্থা বাদীর প্রতি সহানুভূতিশীল, তাই দেশটির আদালতের মাধ্যমে অস্বস্তিকর তথ্য বা প্রতিবেদন প্রকাশ ঠেকানো সম্ভব। তবে হাউস অব কমন্স লাইব্রেরি ২০২২ সালের এক গবেষণা অনুসারে, এ ধরনের কাজ ঠেকানোর জন্য আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর প্রভাব খুবই সীমিত।
হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের লন্ডন ও আশপাশের এলাকায় কয়েকশো মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি রয়েছে।
গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ ট্রেজারির অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী ছিলেন তিনি, কিন্তু নিজেই বিত্তবান বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া বাড়ি নিয়ে তদন্তের মুখে পড়েন।
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা প্রথমে ইরানি আইনজীবী অধ্যাপক পায়াম আখাভানের পরামর্শে আল-জাজিরার ওই ডকুমেন্টারির বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ব্রাউনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আখাভান এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন।
ব্রাউন বাংলাদেশ সরকারের হয়ে আইনি সহায়তা দিতে সম্মত হন। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের ব্যারিস্টারদের সংগঠন বার কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান ব্রাউন সেই সময় ছিলেন লন্ডনের ফাইভআরবি নামক মিডিয়া আইন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ চেম্বারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ব্রাউন লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশ নেন, উদ্ধারকৃত নথিতে যার উল্লেখ রয়েছে। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করতে তিনি প্রস্তুত, তবে প্রথমে তাদের একজন সলিসিটার নিয়োগ করতে হবে, যিনি তাকে নির্দেশনা দেবেন।
ব্রাউন বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি এর আগে লন্ডনের আইনি প্রতিষ্ঠান পেনিংটন মাঞ্চেস কুপারের সুনাম রক্ষা ও গোপনীয়তা-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ জেরেমি ক্লার্ক-উইলিয়ামসের সঙ্গে কাজ করেছেন। এরপর হাসিনা প্রশাসন ক্লার্ক-উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি কয়েকদিন পর তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে সম্মত হন।
১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় হওয়া আলোচনায় হাসিনার প্রতিনিধি ওই আইনজীবীকে বলেন, আল জাজিরার ডকুমেন্টারির 'বিশেষ কোনো ভিত্তি' নেই। তবে এটি 'দুর্নীতিতে নিমজ্জিত' থাকার ভাবমূর্তি তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার 'গুরুতর' মানহানি করেছে।
ঢাকার সরকার তাদের নির্দেশ দিয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা ক্লার্ক-উইলিয়ামসকে জিজ্ঞেস করেন, সরকার নিজে, অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান (যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) অথবা কোনো ব্যক্তি (সেনাপ্রধান) মানহানির মামলা করতে পারেন কি না। তারা আরও ইঙ্গিত দেন, প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মামলা করাতে পারবেন—'যেমন, অবসরপ্রাপ্ত কোনো সেনা কর্মকর্তা, যিনি ডকুমেন্টারিতে নেই কিন্তু মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বা প্রধানমন্ত্রীর মানহানি করা হয়েছে।'
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা আরও জানান, তারা পৃথকভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও মামলা করতে প্রস্তুত আছেন। ডেভিড বার্গম্যানের নামও উল্লেখ করেন তারা। তাদের মতে, বার্গম্যান ছিলেন 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদটির মূল পরিকল্পনাকারী' এবং তাকে 'বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করা হবে'।
হাসিনা সরকারের সমালোচক বার্গম্যান একসময় বাংলাদেশে বাস করলেও তার ভিসা নবায়ন না করায় তিনি বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ওই সময় তখন লন্ডনে ছিলেন। এর আগে 'জাতির অনুভূতিতে আঘাত করার' অভিযোগে আদালত অবমাননার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। একসময় বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী তাকে 'ইহুদি' বলে কটাক্ষ করেছিলেন। তবে বার্গম্যান বলেন, হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেপর্যন্ত তিনি জানতেনই না যে তাকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল।
উদ্ধারকৃত নথিতে দেখা যায়, বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বার্গম্যান সম্পর্কে একাধিক ভিত্তিহীন দাবি করেন। তার স্ত্রী সারা বাংলাদেশি ব্যারিস্টার।
তবে এসব মিথ্যা দাবিও ব্রাউনের পছন্দের আইনজীবী ক্লার্ক-উইলিয়ামসনকে দমাতে পারেনি। নথির তথ্য অনুযায়ী, তিনি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মামলার প্রস্তুতির জন্য ফি কত হবে এবং ব্যারিস্টার ও সলিসিটরের মধ্যে সম্পর্ক কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করেন। ক্লার্ক-উইলিয়ামস বলেন, 'আপনারা আমাকে নির্দেশ দেবেন', এবং এরপর তিনিই একজন সিনিয়র ব্যারিস্টার নিযুক্ত করবেন।
তবে শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যে মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর বদলে তারা ইউটিউব ও ফেসবুকের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে, যাতে আল-জাজিরার ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঢাকার উচ্চ আদালত সরকারের পক্ষে রায় দিলেও গুগল ও মেটা উভয়েই সরকারের এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ভিডিওটি এখনও দুই প্ল্যাটফর্মেই রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। হাসিনা ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বিক্ষোভকারীরা এরপর তার প্রাসাদোপম বাসভবনে ঢুকে পড়েন। ওই বাড়ির ভেতরে হাজারো অপ্রকাশিত নথি, ছবি এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পড়ে ছিল।
হাসিনার শাসনামলে ব্রিটিশ আইনজীবীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগের প্রমাণ এসব নথি হাসিনার ঘরেই পাওয়া যায়। ধুলোয় ঢাকা নথিগুলো বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে নথিগুলো কে ছাপিয়েছিল বা সংরক্ষণ করেছিল, তা এখনও অস্পষ্ট।
এই বিষয়ে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া ডেসমন্ড ব্রাউনের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি দ্য সানডে টাইমসকে বলেন, 'ক্যাব র্যাংক রুল' অনুযায়ী, ব্যারিস্টাররা কোনো ক্লায়েন্টের বিশ্বাস বা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একমত না হলেও তাকে আইনি সহায়তা দিতে বাধ্য।
ব্রাউন বলেন, 'শুধু খারাপ ভাবমূর্তির কারণে একজন ব্যারিস্টারের পক্ষে কোনো ক্লায়েন্টকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আঠারো শতকের লর্ড আরস্কিনের সময় থেকে আমাদের পেশার একটি মৌলিক নিয়ম।'
তিনি আরও বলেন, '১০ ফেব্রুয়ারি আমার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা এবং পরে ক্লার্ক-উইলিয়ামসের পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা হাইকমিশনকে আইনি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলাম। তবে আমার জানামতে, সেই পরামর্শ দেওয়ার পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।'
এ বিষয়ে ক্লার্ক-উইলিয়ামসের মন্তব্য জানতে চেয়ে দ্য সানডে টাইমসের তরফ থেকে একাধিকবার ফোন ও ইমেইল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।