জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে সাহায্য করে যেসব ‘কার্বন-নিরোধক’ খাবার
আমরা জানি কম কার্বনযুক্ত খাবার খাওয়া প্রকৃতিতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করে। তবে আমরা কি জানি কিছু খাবার বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শুষে নিয়ে পৃথিবীর জলবায়ুকে আগের চেয়েও আরও ভাল অবস্থানে নিয়ে যায়।
বেশিরভাগ খাদ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তন ঘটায়। অসংখ্য উৎস থেকে এই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। যেমন- জ্বালানি পোড়ানো, ট্র্যাক্টর চালানো, সার উৎপাদন প্রভৃতি। সব মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী।
তবে এমন কিছু খাবার আছে যেগুলোর উৎপাদন ও খাওয়ার মাধ্যমে যতটুকু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, এগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করে। এসব খাবারকে সাধারণত 'কার্বন-নেগেটিভ' বা কার্বন-নিরোধক খাবার বলা হয়। তাই এগুলো উৎপাদন এবং খাদ্য হিসেবে গ্রহণের চর্চা বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের খাদ্যের কার্বন নিঃসরণের প্রভাব কমানো সম্ভব। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হতে পারে।
বেড়ে ওঠার সময় উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। তবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী যখন এই উদ্ভিদ খায় এবং সেগুলো পরিপাক করে, তখন সাধারণত এই কার্বন ডাই অক্সাইড আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে আমাদের স্থায়ীভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন নিরোধ করতে হবে এবং তা সমুদ্র, পাথর, মাটি বা গাছের গভীরে সঞ্চয় করতে হবে। কিছু খাবার এবং এগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া এই কাজটি করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে এখনও আমাদের পুরো খাদ্যাভ্যাসকে কার্বন নিরোধক করা সম্ভব। তবে বর্তমান পৃথিবীতে এটা করতে গেলে অধিকাংশ মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।
কেল্প
কেল্প এবং অন্যান্য সামুদ্রিক শৈবাল কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে। বড় হওয়ার পরে কেল্পের কিছু অংশ ভেঙে গভীর সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায়। এভাবে গভীর সমুদ্রের তলদেশে ভাঙা কেল্পের সঙ্গে কার্বনের কিছু অংশ সঞ্চিত হয়। তবে প্রতি কেজি কেল্প থেকে খুব সামান্য পরিমাণই সমুদ্র তলদেশে সঞ্চিত হয়।
এছাড়া কেল্পভিত্তিক খাবারগুলোর কার্বন নিরোধক গুণ বজায় রাখতে এর উৎপাদন এবং পরিবহন প্রক্রিয়া খুবই কার্বন-দক্ষ হতে হবে। এর অর্থ- যথাসম্ভব কম পরিবহন, প্যাকেজিং এবং প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে। তাই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কেল্প ব্যবহারেই অধিক কার্বন নিরোধ সম্ভব। তবে, বাণিজ্যিকরণের ফলে কেল্পের চাষাবাদ আরও বাড়বে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমা ছাড়াও, এর আরও অনেক বড় পরিবেশগত উপকারিতা রয়েছে।
ব্যাকটেরিয়াল পণ্য
মিথেন-অক্সিডাইজিং ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকার শক্তি পেতে মিথেন গ্রহণ করে। তাই পরিবেশের জন্য এটি খুবই উপকারী একটি ব্যাকটেরিয়া। মিথেন একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধরে রাখতে পারে, যার ব্যপ্তি প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত হতে পারে।
তাই যদি আমরা এই ব্যাকটিরিয়াগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি, এগুলোকে বিপাক করি; তাহলে তা আবার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড হিসেবে ফিরে যাবে।
তাই এই ব্যাকটেরিয়া-সমৃদ্ধ খাবার খেলে একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস (মিথেন), একটি তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী গ্যাসে (কার্বন ডাই অক্সাইড) রূপান্তরিত হয়। এই ব্যাকটিরিয়ার জন্য নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের মতো অন্যান্য পুষ্টিরও প্রয়োজন হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই ব্যাকটিরিয়াগুলো পুষ্টির উৎস হিসেবে খাদ্য বর্জ্য বা পশুর বর্জে্যর মতো পুষ্টিসমৃদ্ধ বর্জ্য ব্যবহার করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি পণ্যগুলো কার্বন নিরোধক হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।
বর্তমানে বাজারে এই ধরনের পণ্য পাওয়া যায় না। তবে, ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ডের সোলার ফুডস সিঙ্গাপুরে এক ধরনের আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেছে, যাতে একটি ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি প্রোটিন ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্লুবেরি ও সেলারি
আর্দ্র জলাভূমিতে উদ্ভিদের উপাদানগুলো পুরোপুরি পচে যায় না, এর ফলে সেখানে পিট জমা হয়। পিট হলো এক ধরনের মাটি যা জৈব কার্বনসমৃদ্ধ। ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি ও সেলারির মতো কিছু উদ্ভিদ এই ধরনের পিটল্যান্ডে উৎপন্ন হয়। যদি এগুলোর সরবরাহ শৃঙ্খল খুব কার্বন-দক্ষ হয়, তবে এভাবে উৎপন্ন খাবারগুলো কার্বন নিরোধক হতে পারে।
তবে সাধারণত তাজা ব্লুবেরিতে এই গুণমান থাকে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে বাজারজাত করা হয়। ফলে ক্রমে এগুলো অত্যন্ত উচ্চ কার্বনসমৃদ্ধ খাবারে পরিণত হয়।
বাদাম, জলপাই ও সাইট্রাস
ফসলী জমিতে গাছ লাগালে কার্বন সংরক্ষিত হয়। গত ২০ বছরে বিশ্বে বাদাম চাষের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফসলী জমিতে এই উদ্ভিদ চাষ করা হয়েছে। সরবরাহ শৃঙ্খল পার হওয়ার পরও আপনি দোকান থেকে যে বাদাম কেনেন, এই বাদামের প্রতি কিলোগ্রাম ১.৩ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করে।
গাছগুলো পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত এই কার্বন অপসারণ গুণ বিদ্যমান থাকে। এসব গাছ পরিপক্ক হতে সাধারণত প্রায় ২০ বছর সময় লাগে। আর যদি গাছগুলো জীবনকাল শেষে এগুলোর কাঠ থেকে টেকসই পণ্য তৈরি করা হয়, তাহলে এই কার্বন অনেক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকতে পারে।
পুনরুৎপাদনমূলক পদ্ধতিতে চাষ করা খাদ্য
বিভিন্ন পুনরুৎপাদনমূলক চাষবাদ পদ্ধতি ভূমিতে বা উদ্ভিদে আরও বেশি কার্বন সংরক্ষণে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- ব্রিটিশ কৃষি প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ডফার্মড তাদের চাষীদের উৎপাদিত প্রতি কিলোগ্রাম গমে ১.৫ কিলোগ্রাম অপসারণের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কার্বন দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবহার করা কিছু কোম্পানিও ইতোমধ্যে দাবি করেছে, তাদের পণ্যগুলো কার্বন নিরোধক। যেমন- লন্ডনের জিপসি হিল ব্রুয়ারি দাবি করেছে যে তারা কার্বন নিরোধক বিয়ার তৈরি করে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, গরুর মাংসের মতো উচ্চ কার্বন নিঃসরক খাবারের ক্ষেত্রে পুনরুৎপাদনশীল পদ্ধতিও সম্ভবত কার্বন নিরোধ করতে পারে না। এছাড়া, কিছু পুনরুৎপাদনশীল পদ্ধতি খাদ্য শৃঙ্খলের অন্য অংশে কার্বন নিঃসরণ আরও বাড়াতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ- আর্জেন্টিনার একটি খামারে গবাদি পশু প্রাকৃতিক পরিবেশে পালন করা হয়। এই খামারিরা তাদের গরুর মাংসের প্রতি কিলোগ্রামে ০.৩ কিলোগ্রাম কার্বন অপসারণের দাবি করেছে। এই কার্বন অপসারণ করতে প্রতি কিলোগ্রাম গরুর মাংস উৎপাদনে ৫০০ বর্গমিটার (৫,৪০০ বর্গফুট) চারণভূমি ও কৃষিজমির প্রয়োজন। যদি প্রতিটি গরুর মাংস উৎপাদনকারী খামার এই পরিমাণ জমি ব্যবহার করে, তবে আমাদের বর্তমান গরুর মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য আরও তিন বিলিয়ন হেক্টর (সাত বিলিয়ন একর), তথা আফ্রিকার আয়তনের সমান জমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করতে হবে।
কার্বন লেবেলের প্রয়োজনীয়তা
সামগ্রিকভাবে আজকের দিনে কার্বন নেতিবাচক খাবার চিহ্নিত করা খুব কঠিন। তবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে পণ্যের সম্পূর্ণ জীবনচক্র বিবেচনায় নিয়ে শক্তিশালী কার্বন মনিটরিং এবং লেবেলিং স্কিম চালু করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- নিউজিল্যান্ডে এখন প্রতিটি গরুর খামারিকে তার খামার থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ পরিমাপ করতে হয়। এছাড়া ফরাসি সরকার একটি জাতীয় কার্বন লেবেলিং প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা করছে। এই স্কিমগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত এবং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলে সবার জন্য কার্বন নিরোধক খাবার চিহ্নিত করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ভূমি-সংরক্ষণকারী খাবার
কার্বন নিরোধক খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এগুলো দ্বারা আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার একটি ছোট্ট অংশের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ কার্বন নিরোধক হওয়ার সম্ভাবনা থাকা পণ্যের সংখ্যা খুবই কম। এছাড়া পুনরুৎপাদশীল চাষাবাদ পদ্ধতিও উচ্চ কার্বন নিঃসরক খাবারগুলো ক্ষতি কমাতে সম্ভবত সক্ষম নয়। তাই কার্বন প্রতিরোধের জন্য আমাদের অন্যান্য আরও কৌশল প্রয়োজন।
যদি আমরা জমি চাষাবাদ বন্ধ করে দেই, এগুলো সম্ভবত আবার বন বা প্রাকৃতিক ঘাস জমিতে পরিণত হবে। তাই যদি আপনি একই পরিমাণ খাবার কম জমিতে উৎপন্ন করতে পারেন, তবে মুক্ত হওয়া জমিটুকু সম্ভবত কার্বন শোষণ করবে।
জমি বাঁচানোর একটি উপায় হলো ফলন বাড়ানো: একই পরিমাণ জমিতে আরও বেশি ফসল উৎপাদন করা। তবে, ফলন বৃদ্ধির হার বছরে কয়েক শতাংশের বেশি বাড়ে না। এই সামান্য উদ্বৃত্ত যথেষ্ট জমি খালি করতে বা কোনো পণ্যকে কার্বন নেতিবাচক করার জন্য যথেষ্ট নয়। এর জন্য আরও বেশি কার্যকরী কোনো কৌশল প্রয়োজন।
কিছু পণ্য তাদের বিকল্পের তুলনায় অনেক বেশি জমি ব্যবহার করে। তাই এগুলো উৎপাদন বন্ধ করলে কার্বন নিঃসরন কমতে পারে। কারণ এসব জমি বাঁচানোর মাধ্যমে আপনি জমি মুক্ত করছেন। এরপর আপনি সেই জমিতে পুনরায় উদ্ভিদ লাগাতে, যা তারপর বায়ু থেকে কার্বন শোষণ করবে। উদাহরণস্বরূপ- গড়ে গরুর মাংস থেকে প্রোটিন পেতে ১০০ বর্গমিটার (১,১০০ বর্গফুট) জমি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, মটরশুটি বা তোফুর মতো উদ্ভিদভিত্তিক খাবার থেকে একই পরিমাণ প্রোটিনের জন্য প্রায় ৫ বর্গমিটার (৫০ বর্গফুট) ব্যবহার হয়।
শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু মডেল ব্যবহার করে করা এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমরা যদি সবাই প্রাণী খাওয়া বন্ধ করি এবং স্থায়ীভাবে উদ্ভিদভিত্তিক খাবার খাই, তাহলে আমরা ৩.১ বিলিয়ন হেক্টর (সাত বিলিয়ন একর) কৃষিজমিতে বন এবং প্রাকৃতিক তৃণভূমি ফিরিয়ে আনতে পারি। এই পরিমাণ স্থান যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়ার সম্মিলিত আয়তনের সমান।
আপনি যদি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকান তবে একটি বিপ্লবী রূপান্তর দেখতে পারবেন। এর ফলে প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রতি বছর আট বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ হবে। এর কারণ এই বিপুল জমিতে পুনরায় গাছপালা জন্মাবে এবং পুনরায় মাটিতে কার্বন সঞ্চিত হবে। এই বিশাল পরিমাণ কার্বন অপসারণের ফলে খাদ্য থেকে হওয়া সমস্ত কার্বন নিঃসরণের ভারসাম্য ফিরে আসবে এবং আমাদের খাদ্যাভ্যাস কার্বন নিরোধক হয়ে যাবে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গড়ে প্রতি ব্যক্তির খাদ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কেজির সমান কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরিত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নিঃসরণ কমে মাইনাস ১৬০ কেজিতে নেমে আসবে।
কার্বন লেবেলিং এবং নতুন প্রযুক্তি আমাদের কার্বন নিরোধক অভিযাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেসব পণ্য অনেক জমি ব্যবহার করে (সাধারণত মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্য) উৎপাদিত হয়, সেগুলোর পরিবর্তে কম জমি ব্যবহার করে (সাধারণত উদ্ভিদভিত্তিক খাবার) উৎপাদিত খাবার খাওয়া সম্ভবত আমাদের খাদ্যাভ্যাসকে কার্বন নিরোধক করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়।
* জোসেফ পোর অক্সফোর্ড মার্টিন প্রোগ্রাম অন ফুড সাসটেইনেবিলিটির পরিচালক।