নিভৃত পল্লীতে দেশসেরা চিকিৎসকের সেবা পেলেন তিন শতাধিক রোগী
যশোর সদরের বারিনগর এলাকার ষাটোর্ধ রহিমা বেগম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত।
হতদরিদ্র এই নারীর গেল কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা চলছিল স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়াতে ভাল কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেননি এই নারী।
আজ শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের নাটুয়াপাড়াস্থ সমন্বিত প্রবীণ ও শিশু নিবাস 'আমাদের বাড়ি'তে বসে মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে স্বল্পমূল্যে রেজিস্ট্রেশন করে ঢাকার স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ'র চিকিৎসা সেবা পেয়ে খুশি তিনি।
রহিমা বলেন, 'চার বছর আগে স্ট্রোক করার পর গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছি। তবে টাকা-পয়সা না থাকায় ভাল কোনো ডাক্তার দেখাতে পারিনি। শুনেছিলাম ঢাকার বড় বড় ডাক্তাররা আসবে নাটুয়াপাড়ায়। তাই মেয়ের হাতে ভর দিয়ে এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি।'
তিনি বলেন, 'এসব নাম করা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার টাকা নেই। আবার গ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা সেবার খরচও অনেক। ওনারা গ্রামে এসে রোগী দেখছে, এতে আমাদের মতো গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের ভাগ্যের ব্যাপার।'
শুধু রহিমা নন; তার মতো তিন শতাধিক হতদরিদ্র ও গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা পেয়েছেন। এর আয়োজন করেছিলেন জিএমএসএস ফাউন্ডেশন ও সমন্বিত প্রবীণ ও শিশুদের নিবাস 'আমাদের বাড়ি'।
ঢাকা থেকে আসা ৯ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যশোর ছাড়াও পাশ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা থেকে আসা অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সেবা দেন। নিভৃত পল্লীতে দেশসেরা চিকিৎসকের সেবা পেয়ে খুশি চিকিৎসা নিতে আসা এসব মানুষেরা।
স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন নুর ইসলাম। তিনি বলেন, 'আমরা এলাকার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। অধিকাংশ মানুষ কৃষক, দিন মজুর। কোনো রোগের চিকিৎসা করতে আমাদের পক্ষে ঢাকা শহরে যাওয়া সম্ভব না। আল্লাহর অশেষ রহমত, এতগুলো বড় বড় ডাক্তার এখানে রোগী দেখছেন।'
তিন মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে সালমা খাতুন এসেছেন ক্যাম্পে।
তিনি বলেন, 'প্রতিযশা নামকরা চিকিৎসকরা এখানে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ঢাকায় তাদের কাছে চিকিৎসা নেওয়া অনেক ব্যয়বহুল। এখানে এসে নামকরা শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাতে পেরেছি।'
'আমাদের বাড়ি'র স্বপ্নদ্রষ্টা জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এমএ রশিদ বলেন, 'এখানকার মানুষ অসচ্ছল। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া তাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। এই জন্য চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় আনার চেষ্টা করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আপনারা জানেন, এখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের জন্য আমাদের বাড়িতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিতরা এখানে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা পায়। প্রতি বছর দেশের নাম করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে ক্যাম্প করি। সেখানে সদর উপজেলাসহ আশেপাশের জেলা উপজেলার মানুষ সেবা নেয়। এছাড়া, প্রতিমাসে আমি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। এলাকার মানুষের ভিতর ব্যাপক সাড়া রয়েছে। এরা অপেক্ষা করে আমি কখন আসব। সবচেয়ে বড় কথা হলো তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করি। সবার মনে রাখতে হবে ওষুধের চেয়ে জীবনযাত্রার প্রণালী মেনে চলা জরুরি।'
প্রসঙ্গত, যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার নাটুয়াপাড়ায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যাগে ২০২২ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় 'আমাদের বাড়ি'। সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের জন্য গ্রামীণ মনোরম পরিবেশে এক একর ৫ শতক জমির ওপর নির্মিত প্রতিষ্ঠানটিতে চারতলা ভবনে ১২০ জন বসবাস করেন।
প্রতিষ্ঠানটিতে বসবাসকারীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সকল সেবা। প্রবীণ ও শিশুদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসেবাসহ সবকিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় ধান-সবজি চাষের পাশাপাশি মাছের খামার, হাঁস-মুরগি ও গরুর খামারও রয়েছে।
কর্তৃপক্ষের আশা, এখানে প্রবীণরা যেমন স্বস্তি পাবেন, তেমনি শিশুরাও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় ফিরতে পারবেন।