যেভাবে চাঁদে অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব
একটি বিশাল গোলকের ভেতরে প্রকৌশলীরা তাদের যন্ত্রপাতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন। তাদের সামনে রঙিন তারে ঘেরা রুপার তৈরি একটি বাক্স। তাদের আশা, এটি একদিন চাঁদে অক্সিজেন তৈরি করবে।
প্রকৌশলীদের দলটি গোলকটি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর শুরু হল পরীক্ষা। বাক্সটি তখন ছোট পরিমাণে ধুলোমিশ্রিত রেগোলিথ (চাঁদের মাটি) গ্রহণ করতে শুরু করল। কিছু সময় পর রেগোলিথ গলে যেতে শুরু করল। কিছু বিশেষ উপাদান যোগ করার পর সেখান থেকে অক্সিজেন বের হতে শুরু করল।
সিয়ারার স্পেসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ব্র্যান্ট হোয়াইট বলেন, "আমরা এখন পৃথিবীতে যা কিছু পরীক্ষা করতে পারি, সবই পরীক্ষা করেছি। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে চাঁদে যাওয়া।"
এই পরীক্ষাটি নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে গত গ্রীষ্মে হয়েছিল। এটি একমাত্র প্রযুক্তি নয়, যা নিয়ে গবেষকরা কাজ করছেন। তারা এমন সিস্টেম তৈরি করছেন, যেটি চাঁদে বসবাসকারী নভোচারীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।
শুধু শ্বাস নেওয়ার জন্যই নয়, রকেট ফুয়েল তৈরি করতেও চাঁদের বাসিন্দাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে। এছাড়া, চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে তারা ধাতু আহরণও করতে পারবেন, যা ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
হোয়াইট বলেন, "এটি মিশনের ব্যয় থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। পৃথিবী থেকে অক্সিজেন এবং ধাতু চাঁদে নিয়ে আসা খুবই পরিশ্রমের কাজ এবং ব্যয়সাপেক্ষ।"
চাঁদের মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ধাতব অক্সাইড রয়েছে। তবে পৃথিবীতে ধাতব অক্সাইড থেকে অক্সিজেন সংগ্রহের বিজ্ঞান সহজ হলেও, চাঁদে এটি করা অনেক কঠিন। এর কারণ চাঁদের পরিবেশ।
এই বছর জুলাই ও আগস্টে সিয়েরা স্পেসের পরীক্ষা চালানোর বিশাল গোলাকার চেম্বারে চাঁদের মতো শূন্যতার পরিবেশ এবং তাপমাত্রা ও চাপের অনুকরণ করা হয়েছিল।
কোম্পানিটি জানিয়েছে, যন্ত্রটি চাঁদের মাটির তীক্ষ্ণ ও ক্ষয়কারী প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত করা হয়েছে। "এটি যন্ত্রের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সব ধরনের যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে," বলেন ব্র্যান্ট হোয়াইট।
তবে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীতে বা মহাকাশেও পরীক্ষা করা যায় না। এটি পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ। সম্ভবত ২০২৮ সাল বা তারপর সিয়েরা স্পেস চাঁদে কম মাধ্যাকর্ষণের পরিবেশে আসল রেগোলিথ ব্যবহার করে তাদের প্রযুক্তি পরীক্ষা করতে পারবে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. পল বার্ক বলেন, এটি সামলানোর মনোভাবে তৈরি না করা হলে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ অনেক অক্সিজেন সংগ্রহকারী প্রযুক্তির জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
এপ্রিল মাসে তিনি ও তার সহকর্মীরা একটি গবেষণায় দেখতে পান, কীভাবে চাঁদের দুর্বল মাধ্যাকর্ষণ অক্সিজেন সংগ্রহের একটি পদ্ধতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এই পদ্ধতির নাম 'মোল্টেন রেগোলিথ ইলেকট্রোলাইসিস'। এটি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চাঁদের মাটি থেকে অক্সিজেন আলাদা করে।
এই পদ্ধতিতে অক্সিজেন বুদবুদ তৈরি হয়। এটি মাটির মতো ঘন পদার্থের মধ্যে ইলেকট্রোডের ওপর জমা হয়। ড. বার্ক বলেন, "এটি মধুর মতো ঘন। বুদবুদগুলো দ্রুত ওপরে ওঠে না এবং ইলেকট্রোড থেকে আলাদা হতেও দেরি হতে পারে।"
এই সমস্যার সমাধানে যন্ত্রে কম্পন যোগ করা বা মসৃণ ইলেকট্রোড ব্যবহার করার মতো পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে।
সিয়েরা স্পেসের প্রযুক্তি কার্বোথার্মাল প্রক্রিয়া একটু আলাদা। এতে বুদবুদগুলো ইলেকট্রোডের ওপর নয়, বরং মাটির মধ্যে মুক্তভাবে তৈরি হয়। তাই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন ব্র্যান্ট হোয়াইট।
ড. বার্ক জানান, একজন নভোচারীর দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করতে প্রায় দুই থেকে তিন কেজি চাঁদের মাটির প্রয়োজন হতে পারে। তবে চাঁদের ঘাঁটিতে অক্সিজেন পুনর্ব্যবহার করা হলে মাটি প্রক্রিয়াকরণ করার প্রয়োজন হবে না।
তবে ড. বার্ক মনে করেন, অক্সিজেন সংগ্রহ প্রযুক্তির আসল কাজ হবে রকেট জ্বালানির জন্য অক্সিডাইজার তৈরি করা। এর ফলে বড় ধরনের মহাকাশ অভিযান সম্ভব হবে।
সিয়েরা স্পেসের পদ্ধতিতে কিছু কার্বন যোগ করতে হয়। তবে তারা বলছে, প্রতিটি অক্সিজেন তৈরির পর কার্বনের বেশিরভাগই পুনর্ব্যবহার করা যায়।
এদিকে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পিএইচডি ছাত্রী পলক প্যাটেল ও তার দল একটি পরীক্ষা চালান। তারা মোল্টেন রেগোলিথ ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতি ব্যবহার করে চাঁদের মাটি থেকে অক্সিজেন ও ধাতু সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
প্যাটেল জানান, "আমাদের লক্ষ্য হলো, চাঁদে যত কম রসদ পাঠাতে হয় তত ভালো।" যে কম মাধ্যাকর্ষণের কারণে বুদবুদ আলাদা হতে পারে না, সেই সমস্যা দূর করতে তারা "সনিকেটর" ব্যবহার করেন। এটি শব্দ তরঙ্গ দিয়ে বুদবুদ আলগা করে ফেলে।
চাঁদের মাটি থেকে লোহা, টাইটানিয়াম বা লিথিয়াম সংগ্রহ করা সম্ভব। এটি দিয়ে নভোচারীরা থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারবেন।
এখানেই শেষ নয়। পলক প্যাটেল আরও জানান, পরীক্ষায় তারা দেখেছেন চাঁদের মাটি গলিয়ে শক্ত, কালো কাচের মতো বস্তু তৈরি করা যায়। এই বস্তু থেকে শক্ত ইট বানানো সম্ভব, যা চাঁদে ভবন তৈরিতে কাজে আসবে।
তিনি মজা করে বলেন, "হয়ত একদিন চাঁদে বিশাল কালো মনোলিথ তৈরি করাও সম্ভব হবে!"